প্রশ্নঃ সত্তাদর্শন প্রসঙ্গে একাত্ববাদের একটি সমালােচনামূলক ব্যাখ্যা দাও। নব্য বাস্তববাদী বহুত্ববাদের সাথে কোনো সম্পর্ক আছে কী?
অথবা, সত্তাদর্শন প্রসঙ্গে একাত্ববাদের ব্যাখ্যা তুলে ধর। নব্য বাস্তববাদী বহুত্ববাদে সাথে সম্পর্ক আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ দর্শন জগৎ ও জীবনের মৌলিক সমস্যা নিয়ে আলােচনা করে। দর্শনের আলােচিত অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে বিশ্বজগতের গঠন ও সংগঠনের সমস্যা বা বিশ্বতন্ত্রের সমস্যা। এ পরিদৃশ্যমান জগৎ কি আসল জগৎ? এ জগতের পেছনে কি কোনাে পরমসত্তা আছে? যদি থাকে তবে তা এক না বহু? তার স্বরূপ কী? বিশ্বতত্ত্বের এসব প্রশ্ন নিয়ে গড়ে উঠেছে তত্ববিদ্যা বা সত্তাসম্পৰ্কীয় দর্শন। আর এই সত্তাসম্পৰ্কীয় তিনটি মতবাদ পাই- (ক) একত্ববাদ, (খ) দ্বৈতবাদ ও (গ) বহুত্ববাদ।
সত্তাদর্শন কীঃ সত্তাদৰ্শন দর্শনের এমন একটি শাখা যেখানের মূল উপাদান বা সত্তর ও সংখ্যাসম্পর্কীয় বিষয়ের আলােচনা করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ জগতের মূল উপাদান বা সত্তার স্বরূপ ও সংখ্যা নিয়ে যে দর্শন আলােচনা করে থাকে তাকে তত্ত্ববিদ্যা বা সত্তাসম্পর্কীয় দর্শন বলা হয়ে থাকে।
একত্ববাদ বা অদ্বৈতবাদ কীঃ যে মতবাদ বিশ্বের আদিম সত্তাকে এক বলে মনে করে তাকেই একত্ববাদ বলে। একত্ববাদ অনুযায়ী বিশ্বজগতের আদিমত্তা একটি; দুই বা বহু নয়। বিশ্বের সবকিছুই একটিমাত্র মেলিক সত্তা থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ জগৎ বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র সত্তার বিশাল স্তুপ নয়, কিংবা দুটি ভিন্নধর্মী উপাদানের সমন্বয়ও নয়, বরং তা একই পরমসত্তার বিচিত্র প্রকাশ। অর্থাৎ এক হচ্ছে সত্তা, আর বহুরূপী এই বিচিত্র বিশ্ব হচ্ছে এক পরমসত্তার অবসিক রূপ। এমনি করে, একত্ববাদ একসঙ্গে বহুত্ববাদ ও দ্বৈতবাদের অসারতা প্রমাণ করে এবং এক পরমসত্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। একত্ববাদের দু’টি রূপ- (ক) অমূর্ত একত্ববাদ ও (ঘ) মূর্ত একত্ববাদ।
(১) অমূর্ত একত্ববাদঃ পাশ্চাত্য দার্শনিক পিনােজা একত্ববাদের অন্যতম প্রবক্তা । তার মতে, একত্ববাদ পরম সত্তাই সত্য এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ জগৎ মিথ্যা। জগৎ ও পরমসত্তার মধ্যে কোনাে পার্থক্য নেই। জগৎ হলাে পরমসত্তা আর পরম সত্তাই জগৎ। পরমসত্তার বাইরে কোনাে অস্তিত্বশীল জগৎ নেই। পিনােজার এই একত্ববাদ নামে পরিচিত।
স্পিনােজার মতে একমাত্র ঈশ্বরই পরমসত্তা এবং এ জগতের বৈচিত্র্য হচ্ছে এই ঈশ্বর বা পরমসত্তার অবভাস মাত্র। আর এই বৈচিত্র্য মিথ্যা। একমাত্র ঈশ্বরই সত্য। কেননা, ঈশ্বর একটা দ্রব্য। তার মতে, দ্রব্য স্বনির্ভর, যার অস্তিত্বের জন্য অন্য কোন বস্তুর ওপর নির্ভর করতে হবে না। একমাত্র ঈশ্বরই সব, সবই ঈশ্বর, তিনি সত্য ও স্বনির্ভর। তার বাইরে কিছু নেই, তিনি ব্যতীত কিছুই সত্য নয়। এ মতবাদ সর্বেশ্বেরবাদ নামেও পরিচিত। ভারতীয় দার্শনিক শংকরও অমূর্ত অদ্বৈতবাদের কথা প্রচার করেছেন। তার মতে, ব্রহ্ম বা পরমাত্মাই একমাত্র সত্যা এবং জগৎ মিথ্যা।
(২) মূর্ত একত্ববাদঃ জার্মান দার্শনিক হেগেল (১৭৭০-১৮৩১) অদ্বৈতবাদ বা একত্ববাদের অন্যতম ধারক বা বাহক। তার মতে, এ জগৎ অলীক বা মিথ্যা নয় বরং এ জগৎ পরমসত্তার পূর্ণ প্রকাশ। এই পরমসত্তা একক এবং এ পরমসত্তা বৈচিত্র্যপূর্ণ জগতের মধ্য দিয়েই নিজেকে প্রকাশ ও উপলব্ধি করে। পরমসত্তা ছাড়া জগৎ যেমন অর্থহীন, তেমনি জগৎ ছাড়া পরমসত্তা বা পরমাত্মাও অর্থহীন। একমাত্র বৈচিত্রের মাধ্যমেই ঐক্যের স্বরূপকে উপলব্ধি করা যায়। তাই ঐক্য ও বৈচিত্র্য পরমসত্তার দু’টি রূপ বা দিক ছাড়া আর কিছুই নয়।
একত্ববাদের সমালােচনাঃ সত্তার স্বরূপ সম্পর্কিত একত্ববাদ সন্তোষজনক মনে হলেও এ মত ক্রটিমুক্ত নয়। নিচে ত্রুটিগুলাে আলােচনা করা হলাে-
প্রথমত, এ মতবাদ এককে বহু হতে বিচ্ছিন্ন করে, অথচ বহুর মধ্যে দিয়েই একের প্রকাশ ঘটে থাকে। বৈচিত্র্য ছাড়া ঐক্য অনুধাবনযােগ্য নয়। বৈচিত্র্য ও ঐক্য, এক ও বহু পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত। এ ছাড়া এ মতবাদের অনিবার্য পরিণতি সর্বখােদাবাদ বাস্তবকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয়।
দ্বিতীয়ত, হেগেল তার একত্ববাদে কখনও কখনও প্রকৃতিতে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বেশি জোর দেন, কখনও তিনি সসীম জীবাত্মার স্বাধীনতাকে সীমিত করে তােলেন। এবং তাদের ঈশ্বরের হাতের পুতুল করে তােলেন। তিনি মানুষ এবং ঈশ্বরের বুদ্ধির দিকের ওপর বেশি জোর দেন। অথচ তিনি তাদের ঐচ্ছিক প্রবৃত্তি ও প্রবণতার দিকের প্রতি ততটা জোর দেননি।
তৃতীয়ত, স্পিনােজা আমাদের অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যপূর্ণ জগতকে মিথ্যা বা অলীক বলে এ জগতের অস্তিতকেই নষ্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু এ জগৎ মিথ্যা বা অলীক হতে পারে না। কারণ, এ জগতেরও অস্তিত্ব আছে। তা ছাড়া এ জগৎ যদি মিথ্যা বা অলীক হয় তাহলে মানুষের পরমমূল ও জীবনদর্শনের কোনাে মূল্যই থাকে না। তাই স্পিনােজা তার পরম সত্তার জয়গান করতে গিয়ে পরােক্ষভাবে তার পরম সত্তাকে শূন্যগর্ভে পরিণত করেছেন এবং ধর্ম ও জীবন-আদর্শের সমাধি রচনা করেছেন।
নব্য বাস্তববাদী বহুত্ববাদঃ নব্য বাস্তববাদ মূলত ভাববাদের প্রতিক্রিয়া থেকে ওঠে আসা মতবাদ। কাজেই ভাববাদী একত্ববাদকে অস্বীকার করতে গিয়ে তারা বহুত্ববাদী মতবাদ প্রদান করবেন এটাই স্বাভাবিক। নব্য বাস্তববাদ জগতের কোনাে আঙ্গিক ঐক্য স্বীকার করে না। তাদের মতে, জগতের মূল উপাদান জড়ও নয়, মন নয়, এক নিরপেক্ষ পদার্থ। এই নিরপেক্ষ পদার্থ এক প্রেক্ষিতে ভৌতিক এবং অন্য প্রেক্ষিতে মানসিক বলে প্রতীয়মান হয়। এসব নিরপেক্ষ পদার্থ জগতের বহুবিধ বস্তুসত্তার সৃষ্টির কারণ। বিশ্বজগৎ কোনাে পরম সত্তার প্রকাশ নয়, জগতের বিচ্ছিন্ন বিচিত্র বস্তু নিশ্চয়ই একমাত্র সত্য।
সমালােচনাঃ নব্য বাস্তববাদী বহুত্ববাদ ভাববাদের প্রতিক্রিয়া থেকে আবির্ভূত হলেও নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা মতবাদটিকে গ্রহণযােগ্য করার ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ। যেমন-
(১) সঠিক খবর দিতে ব্যর্থঃ নব্য বাস্তববাদীর বস্তুসমূহের বাহ্যিক সম্পর্ককে স্বীকার করেন এবং অভ্যন্তরীণ সম্পর্কটাকে অস্বীকার করেন। ফলে বস্তুনিচয়ের বিচিত্র সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে পারে না।
(২) সঠিক মন্তব্য ব্যক্ত হয়নিঃ জগতকে বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র বস্তুর আভাস বিবেচনা করার জগতের ঐক্য শৃঙ্খলার সামঞ্জস্য বিষয়ে তারা কোনাে সন্তোষজনক মন্তব্য করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
(৩) মুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ নেইঃ নিরপেক্ষ পদার্থটির স্বরূপ ও তার সপক্ষে কোনাে যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ নব্য বাদে নেই।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, শুরু হয়েছিল সেই খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে আদিসত্তা বা পরমসত্তাকে কেন্দ্র করে। আর এই সূত্র ধরে পরে গড়ে উঠেছে সত্তাসম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদ। একত্ববাদ সত্তাসম্পর্কীয় মতবাদের মধ্যে অন্যতম। এই মতবাদ একমাত্র একটি সত্তাকে জগতের মৌলিক উপাদান বলে মনে করে এবং তার থেকে জগতের যাবতীয় কিছুর উৎপত্তি। আর তিনি হচ্ছেন ঈশ্বর। তারা একমাত্র ঈশ্বরকে জগতের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা বলে মনে করেন। একেশ্বরবাদও এই ঈশ্বরে বিশ্বাসী। তাই একত্ববাদ থেকেই একেশ্বরবাদের উদ্ভব হয়েছে।