প্রশ্নঃ টমাস একুইনাসের রাজনৈতিক দর্শন আলােচনা কর।

অথবা, সেন্ট টমাস একুইনাসের রাষ্ট্রদর্শন সংক্ষেপে আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ মধ্যযুগীয় বর্বরতা ও পােপ রাজার ক্ষমতাগতদ্বন্দ্ব যখন মধ্যযুগকে এক স্থবির অন্ধকারের গভীর অমানিশায় প্রােথিত করে ঠিক সেই মুহুর্তে আলাের মশাল হাতে আবির্ভূত হন টমাস একুইনাস। তিনি ১২২৭ খ্রীষ্টাব্দে মতান্তরে ১২২৫ খ্রীষ্টাব্দে নেপলস শহরের উপকণ্ঠে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাতা-পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সন্ন্যাসপন্থী যাজকদের ডােমিনিকান সম্প্রদায়ে যােগদান করেন। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাষ্ট্র দর্শনে জ্ঞানচর্চায় মগ্ন ছিলেন।

একুইনাসের রাষ্ট্রদর্শনঃ মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রদর্শনে একুইনাসের অবদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তার প্রখ্যাত মনা ‘Summa Theologica’ গ্রন্থে রাষ্ট্র দর্শন সম্পর্কে আলােচনা করেন। নিম্নোক্ত বিষয়ের আলােকে তার রাষ্ট্রদর্শনকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করা সম্ভবপর।

(১) খ্রিষ্টীয় ও গ্রীক দর্শনের সমন্বয়ঃ টমাস একুইনাসের রাজনৈতিক দর্শনে প্রথম অবদান হলাে খ্রিষ্টীয় ও গ্রীক দর্শনের সমন্বয় সাধন। তার রাষ্ট্রদর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলাে যে, তিনি খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে এক দর্শনের সমন্বয়সাধন করেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে আরব ও ইহুদীদের মাধ্যমে গ্রীক দর্শন যখন খৃষ্টান সমাজে প্রবেশ করে তখন খ্রিষ্টীয় যাজকগণ তাকে ধর্মবিরােধী ও অপবিত্র বলে বর্জন করেন। কিন্তু তৎকালীন সফল দার্শনিক টমাস একুইনাস এর মধ্যে সমন্বয়সাধন করেন।

(২) ধর্মতত্ত্বঃ ধর্মতত্ত্ব আলােচনায় একুইনাসের রাজনৈতিক অবদান আরও মূর্ত হয়ে ওঠে। এরিস্টটলের মৌলিক দর্শনের প্রতিধ্বনি করেই সেন্ট টমাস একুইনাস বলেন যে, মানুষের যে জ্ঞান তা এক ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ। তবে এ জ্ঞান বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত। এর মধ্যে দার্শনিক জ্ঞান সর্বোচ্চ। কারণ এটা এমনই এক বিষয় যেখানে কোনাে বিশেষ বিষয়ের আলােচনা করা হয় না। বরং বিশ্ব সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে সেখানে আলােচনা করা হয়। এ বক্তব্যটি ছিল এরিস্টটলের। কিন্তু একুইনাস আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, দর্শনের উর্ধ্বেও একটি জ্ঞানের শাখা আছে যা হল ধর্মতত্ত্ব।

(৩) আইনতত্ত্বঃ টমাস একুইনাসের আইনতত্ত্ব তার রাজনৈতিক দর্শনের বিশেষ দিক। একুইনাসের সামগ্রিক দর্শন তার আইন তত্ত্বের মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠে। এই তত্ত্বের প্রবাহ ধারায় এরিস্টটল, স্টোয়িকবাদ, সিসেরাে, রােমান আইনজ্ঞ ও অগাস্টিনের মতবাদের মিশ্রণ ঘটে যা একটি পরিপূর্ণ তত্ত্বে রূপ নেয়। তিনি আইনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, আইন হচ্ছে সমাজ বা সম্প্রদায়ের দায়িত্বে নিয়ােজিত ব্যক্তির মাধ্যমে বিঘােষিত এমন একটি বিধান যা যুক্তি হতে উৎসারিত এবং মানুষের অভিন্ন কল্যাণ নিশ্চিত করাই যার প্রধান লক্ষ্য। তিনি আইন তত্ত্বকে যথাক্রমে শাশ্বত আইন, প্রাকৃতিক আইন, ঐশ্বরিক আইন ও মানবিক আইন ইত্যাদিতে বিভক্ত করেন।

(৪) সরকারঃ টমাস একুইনাস সরকারের শ্রেণীবিন্যাসের ব্যাপারে এরিস্টটলের নীতি অবলম্বন করেন। তিনি যথার্থ সরকারকে আইনসঙ্গত বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরও বলেন যে, সরকারের ক্ষমতা ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, যার ক্ষমতা অন্যের কাছ থেকে বলপূর্বক কেড়ে নেয়া, সে সরকারের প্রতি নাগরিকদের আনুগত্য প্রদর্শনের কোনাে বাধ্যবাধতা থাকবে না। অবশ্য যদি বড় রকমের কোনাে দুর্নাম বা বিপদ এড়াবার মতাে কোনাে আবশ্যিক অবস্থার সৃষ্টি না হয়। যে সরকার ন্যায়বিচার ও বৈধতার সঙ্গে শাসন করে সেটিই হচ্ছে একুইনাসের ‘আইনসঙ্গত সরকার।

(৫) দাসতত্ত্বঃ মধ্যযুগীয় এরিস্টটল একুইনাস দাসতত্ত্বে এক ব্যতিক্রম দর্শন উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। এরিস্টটল ও অগাস্টিন দাসপ্রথার সমর্থনে যেসব যুক্তি দেখিয়েছেন একুইনাস সেগুলাের কোনােটিকেই সমর্থন করেননি। এরিস্টটল বলেছেন, দাস প্রথা মানুষের অসমান জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ফলশ্রুতি এবং অগাস্টিন বলেছেন, দাসপ্রথা মানুষের পাপ মােচনের একটি দৈব ব্যবস্থা। কিন্তু একুইনাস তা পৃথকভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, দাসপ্রথা সৈনিকদের মধ্যে বীরত্ব উদ্রেকের একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা কারণ, যুদ্ধে পরাজিত হলে সৈনিককে দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়তে হবে।

(৬) কার্যকারণ তত্ত্বঃ কার্যকারণ তত্ত্ব একুইনাসের রাষ্ট্রদর্শনে একটি বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি এরিস্টটলের মতবাদকে সম্বল করেছেন। তিনি বলেন যে, প্রকৃতির রাজ্যে প্রত্যেক বিষয়ই তার নিজের উদ্দেশ্য বা সম্পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য অভ্যন্তরীণ প্রেরণা নিয়ে কার্যরত থাকে। প্রকৃতির অংশ হিসেবে মানুষেরও চরম লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য আছে। এরিস্টটল যেখানে যুক্তিবাদী ধারণাকে চরম বলে বর্ণনা করেন সেখানে একুইনাস বলেন, মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠতম অংশ হচ্ছে আত্মা এবং মানুষের জীবনের শেষ লক্ষ্য হচ্ছে আত্মার মুক্তি।

(৭) রাষ্ট্রতত্ত্বঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে তিনি এরিস্টটলের যুক্তিকে সম্বল করেছেন। এরিস্টটলের মতাে তিনি বলেন যে, রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক সংস্থা। এর উৎপত্তিমূলে রয়েছে মানুষের সহজাত সামাজিক প্রবৃত্তি। রাষ্ট্রের সষ্টি হয়েছে মানুষের সামাজিক কল্যাণের জন্য। তাই পৃথিবীতে রাষ্ট্রের প্রয়ােজন অত্যন্ত বেশী। কারণ পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য রাষ্ট্রই কেবল মেটাতে পারে। একুইনাস এক বিশ্বজনীন সমাজ গঠনের জন্য রাষ্ট্রের উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন চার্চকে। কিন্তু চার্চ রাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং তা রাষ্ট্রের সার্থক সম্পূরক।

(৮) বিশ্ব প্রকৃতিঃ বিশ্ব প্রকৃতি সম্পর্কে টমাস একুইনাস গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বিশ্ব প্রকৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতি এক সুশৃঙখল শ্রেণীবিন্যাস যেখানে সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা থেকে শুরু করে সর্বাপেক্ষা নিম্নস্তরের জীব পর্যন্ত এক অমােঘ প্রকৃতির নিয়মের অধীন। প্রকৃতির জীব সম্পর্কে তিনি বলেন, কোন সৃষ্ট জীব সে যতই নীচ হােক না কেন মূল্যহীন বা উদ্দেশ্যবিহীন নয়। এরা সকলে নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে অবস্থান করে ও কর্তব্য পালনে বিশ্ব প্রকৃতির কল্যাণে নিয়ােজিত।

(৯) চার্চঃ রাষ্ট্রের সম্পর্কঃ একুইনাস বলেন, সৎ জীবনই শেষ কথা নয়, তারপরেও একটি পর্যায় রয়েছে এবং তা হলাে আত্মার মুক্তি। এ মুক্তি অবশ্যই খ্রিস্টীয় নীতির আলােকে সম্পাদিত হতে হবে। রাষ্ট্র যে পার্থিব সুখ শান্তির জন্য কর্মতৎপর থাকবে, তাতে কোনাে আপত্তি নেই। কিন্তু পার্থিব সুখের চেয়েও বড় যে জিনিস আত্মার মুক্তি, তার জন্য রাষ্ট্রকে চার্চের অধীনে থাকতে হবে। তবে রাষ্ট্র চার্চের অধীনে থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নয় বরং একে অপরের সম্পূরক হিসেবে কাজ করবে বলে একুইনাস মত দেন।

(১০) রাষ্ট্রের ভূমিকাঃ একুইনাস বিশ্বাস করতেন সৎ জীবন ও জীবিকার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও সামাজিক কল্যাণ অপরিহার্য এবং এর মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের। মুক্ত আত্মার জন্য ও সৎ জীবনবােধের জন্য চার্চ যাতে কাজ করে যেতে পারে, সেজন্য রাষ্ট্রকে উপযুক্ত পরিবেশ গঠনের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকা ও চার্চের সহযােগিতার ফলে নাগরিক জীবন সুশৃঙ্খল হতে বাধ্য।

পরিশেষঃ এতক্ষণের আলােচনায় পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগের সফল দার্শনিক টমাস একইনাস রাষ্ট্রদর্শনে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি গ্রীক চিন্তাধারার ভিত্তিমূলে খ্রিষ্টীয় মতবাদের প্রস্তর স্থাপন করে মহান সৌধ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি ত্রয়ােদশ শতাব্দী তথা সমগ্র মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা সফল দার্শনিক। তাই অধ্যাপক Dunning বলেন, ‘He is the greatest of the later scholastics and perhaps of all scholastics.