অথবা, বিভিন্ন প্রকার দলের বা গোষ্ঠীর বর্ণনা দাও।
ভূমিকাঃ মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে একা বাঁচতে পারে না। মানুষকে তার প্রাত্যহিক মানবিক চাহিদা পূরণের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতির একান্ত প্রয়োজন। এ জন্যই সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই মানুষ পরস্পরের সান্নিধ্যে দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। দলবদ্ধভাবে বসবাস করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানবসমাজের ক্রমবিবর্তনের ধারায় প্রথম পর্যায় থেকেই মানুষ দলবদ্ধভাবে জীবনযাপন করে আসছে। দল বলতে কতিপয় মানুষের সমষ্টিকে বুঝায়।
সামাজিক দলের শ্রেণিবিভাগঃ বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক দলকে শ্রেণি বিভাগ করেছেন। এই শ্রেণি বিভাজন একটি দলকে অন্য একটি দল থেকে পৃথক করে বুঝতে সাহায্য করে। নিম্নে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে দলের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা করা হলো-
(১) সামনারঃ সমাজবিজ্ঞানী সামনার তার ‘Folk ways’ গ্রন্থে দলকে দু ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- (ক) অন্তদল (খ) বহর্দল।
(ক) অন্তদলঃ অন্তদল হচ্ছে সেই দল যাতে কোনো ব্যক্তি নিজে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত থাকে। এখানে সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক নিবিড় ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বিদ্যমান। অন্তদলের সদস্যদের মধ্যে ‘আমরা’ অনুভূতি ক্রিয়াশীল এবং সবার মধ্যে কর্মের উৎসাহ থাকে।
(খ) বহির্দলঃ যে দলের সাথে ব্যক্তি প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত নয় বা তার সদস্য নয়, ঐটাই তার কাছে বহির্দল। বহির্দলের সাথে ব্যক্তি একাত্মবোধ করতে পারে না। বরং বহির্মূলের সাথে কোনো কোনো সময় বৈরীভাব প্রাধান্য পায়। সামনার কর্তৃক দলের এ বিভাজনটি একটি বিশেষ ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল। কেননা একজন ব্যক্তির কাছে যা অন্তদল, অন্য ব্যক্তির কাছে সেটাই আবার বহির্দল হিসেবে পরিচিত।
অধ্যাপক ম্যাকাইভার ও পেজঃ অধ্যাপক ম্যাকাইভার ও পেজ আন্তদল ও বহির্মূল সম্পর্কে বলেছেন, “The groups with which the individual identifies himself are in group, his family or tribe or sex or college or occupation or religion, by virtue of his awareness of likeness or consciousness of kind.”
(২) কুলিঃ সমাজবিজ্ঞানী কুলি (Cooley) তার ‘Social organization’ গ্রন্থে দলকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যথাঃ
(ক) মুখ্যদল বা প্রাথমিক দলঃ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রস্থলে মুখ্যদল অবস্থিত। মানুষ ব্যক্তিগতভাবে মুখ্যদল তথা প্রাথমিক দলের মধ্যেই জীবনযাপন করে। এখান থেকেই ব্যক্তির সমাজীকরণ হয়। এখানে ব্যক্তি অপরের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত। উদাহরণ হিসেবে কুলি ‘পরিবারের’ নাম উল্লেখ করেন, যেখানে দলের সদস্যরা প্রত্যক্ষভাবে নিবিড় সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত।
(খ) গৌণদল বা মাধ্যমিক দলঃ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বৃহৎ পরিসরে গৌণদল তথা মাধ্যমিক দল অবস্থিত। এখানে ব্যক্তি প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত নয়। পারিবারিকভাবে এখানে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। গৌণদল কতকগুলো নির্দিষ্ট আদর্শ ও নীতি দ্বারা গঠিত হয়। তাই এ দলে ব্যক্তির অধিকার ও কর্তব্যও থাকে সীমিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সম্প্রদায় বা সংঘ হলো গৌণদল। এখানে সদস্যদের সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে কম নিবিড় এবং অনেকটা আনুষ্ঠানিক মাত্র। উল্লিখিত দু’টি দল ছাড়াও আরো বেশ কিছু দলের কথা উল্লেখ করা যায়। সেগুলো হলো- (i) স্বাধীন দল ও নির্ভরশীল দল। (ii) সংঘটিত দল ও অসংগঠিত দল। (iii) উন্মুক্ত দল ও বদ্ধ দল। (iv) বৃহত্তর দল ও ক্ষুদ্রতর দল।
(৩) এলউডঃ এলউড (C. A. Ellwod) তার ‘Psychology of Human Society’ গ্রন্থে দলকে এভাবে ভাগ করেন-
(ক) অনৈচ্ছিক এবং ঐচ্ছিক দলঃ পরিবার, নগররাষ্ট্রকে তিনি স্বাভাবিক ও অনৈচ্ছিক দল বলে অভিহিত করেন। এখানে ব্যক্তি অবচেতনভাবে দলভুক্ত হয়ে পড়ে। অপরপক্ষে রাজনৈতিক দল, ধর্ম, সংঘ বা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনের নিমিত্তে গঠিত ঐচ্ছিক দল হিসেবে অভিহিত করেন।
(খ) প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক দলঃ যে দলগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তৈরি হয় এবং স্থায়িত্ব লাভ করে তাই হলো প্রাতিষ্ঠানিক দল। যেমন- স্কুল, কলেজ, চার্চ ইত্যাদি। অপরদিকে যে দলগুলো অস্থায়ী ভিত্তিতে গড়ে ওঠে তাই হলো অপ্রাতিষ্ঠানিক দল। যেমনঃ কোনো ক্রীড়া দল যা সহজেই ভেঙ্গে যেতে পারে বা পরিবর্তিত হতে পারে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, মানুষ সামাজিকভাবে দলবদ্ধ হয়ে বাস করে। দল ছাড়া মানুষের সামাজিক বসবাস অকল্পনীয়। তাই দলের বিভাজনগুলো একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কযুক্ত। একজন মানুষ একাধিক দলের সদস্য হতে পারে। তাই দলের বিভাজনগুলো অনেক সময় অস্পষ্ট মনে হয়।