প্রশ্নঃ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের যুগবিভাগ সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণের মতামত পর্যালোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য যুগবিভাগ প্রদান কর।
উত্তরঃ কাল মূলত নিরন্তর। বিশাল কালকে একসাথে পর্যালোচনা কষ্টসাধ্য। তাই বুঝবার এবং বোঝাবার সুবিধার্থে আমরা সময়কে খণ্ড খণ্ড করে নিই। ফলে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যিক ইতিহাস পঠনপাঠনে যুগবিভাগ অপরিহার্য। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনায় সাহিত্যের ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারা অনুসরণ করে একে বিভিন্ন যুগে ভাগ করা হয়েছে।
কিন্তু যুগের এই বিভাজনে যুগের লক্ষণ, কালসীমা, নামকরণ ইত্যাদি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। মূলত এই মতবিরোধের মূল কারণ তথ্য প্রমাণের অপ্রতুলতা। কেননা ইতিহাসবিমুখ বাঙালির অনেক তথ্যই অন্ধকারে ঢাকা। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, সুদূর অতীত হতে বর্তমান পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য নানা শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়েছে। বিচিত্র বাঁক মোড় পালাবদল ঘটেছে। পরিবর্তন হয়েছে আঙ্গিক ও ভাবের।
তবে বাংলা সাহিত্যের সুদূর প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময়কে সকল গবেষকই তিনটি প্রধান যুগে বিভক্ত করেছেন- প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ। তবে যুগের আরম্ভ নিয়ে এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজন নিয়ে নানা মুনি নানা মত দিয়েছেন।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ। চর্যাপদের রচনাকাল থেকেই প্রাচীন যুগের শুরু। কিন্তু চর্যার রচনাকাল নিয়ে নানা মতবাদের কারণে প্রাচীন যুগের শুরু নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কিন্তু সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে, প্রাচীন যুগের শেষ সীমানা ১২০০ খ্রিস্টাব্দ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ চর্যাপদের রচনাকাল ৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ বলে প্রমাণ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার বলেছেন ৯৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ। ফলে বাংলা সাহিত্যের শুরু নিয়ে মতান্তর রয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ নিয়ে বিশিষ্ট গবেষকদের মতামত নিম্নে প্রদান করা হলঃ পণ্ডিত রামগতি ন্যায়রত্ন ১৮৭৩ সালে তার “বাঙালা ভাষা ও বাঙালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব” গ্রন্থে যুগবিভাগ করেছেন নিম্নরূপ-
ক. আদ্যকাল অর্থাৎ প্রাক্চৈতন্য পর্ব (বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, কৃত্তিবাস)।
খ. মধ্যকাল অর্থাৎ চৈতন্য যুগ থেকে ভারতচন্দ্রের পূর্ব পর্যন্ত।
গ. ইদানীন্তন কাল অর্থাৎ ভারতচন্দ্র থেকে বর্তমান পর্যন্ত।
প্রখ্যাত গবেষক ড. দীনেশচন্দ্র সেন তার ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ (১৯৯৬) গ্রন্থে কালানুক্রমিক পদ্ধতি গ্রহণ করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে পাঁচটি যুগে ভাগ করেছে-
ক. হিন্দু বৌদ্ধ যুগ (৮০০-১২০০ খ্রিঃ)।
খ. গৌড়ীয় যুগ বা চৈতন্য-পূর্ব যুগ (১২০১-১৫০০ খ্রিঃ)।
গ. শ্রীচৈতন্য সাহিত্য বা নবদ্বীপের প্রথম যুগ (১৫০১-১৬০০ খ্রিঃ)।
ঘ. সংস্কার যুগ (১৬০১-১৭০০ খ্রিঃ)।
ঙ. কৃষ্ণচন্দ্রীয় যুগ বা নবযুগের দ্বিতীয় যুগ (১৭০১-১৭৬০ খ্রিঃ)।
তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগকে বিভাজন করেছেন মাত্র। মূলত তিনি ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে যে যুগবিভাগ করেছেন তা অবৈজ্ঞানিক।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যকে পাঁচটি যুগে বিভক্ত করেছেন-
ক. প্রাচীন বা মুসলমান-পূর্ব যুগ (৯৫০-১২০০ খ্রিঃ)।
খ. তুর্কি বিজয়ের যুগ (১২০১-১৩০০ খ্রিঃ)।
গ. আদি-মধ্য বা প্রাক্চৈতন্য যুগ (১৩০১-১৫০০ খ্রিঃ)।
ঘ. অন্ত্য-মধ্য যুগ-
(i) চৈতন্য যুগ বা বৈষ্ণব সাহিত্য যুগ (১৫০১-১৭০০ খ্রিঃ)।
(ii) নবাবী আমল (১৭০১-১৮০০ খ্রিঃ)।
ঙ. আধুনিক বা ইংরেজি যুগ (১৮০১ – বর্তমান পর্যন্ত)।
গোপাল হালদার মধ্যযুগকে তিন পর্বে ভাগ করেছেন-
ক. প্রাক্চৈতন্য পর্ব (১২০০-১৫০০ খ্রিঃ)।
খ. চৈতন্য পর্ব (১৫০১-১৭০০ খ্রিঃ)।
গ. নবাবী আমল (১৭০১-১৮০০ খ্রিঃ)।
ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্যযুগকে চারটি পর্বে ভাগ করেছেন-
ক. প্রথম পর্বঃ প্রাকচৈতন্য যুগ (চতুর্দশ শতাব্দী)
খ. দ্বিতীয় পর্বঃ চৈতন্য যুগ (ষোড়শ শতাব্দী)।
গ. তৃতীয় পর্বঃ চৈতন্য-উত্তর যুগ (সপ্তদশ শতাব্দী)
ঘ. চতুর্থ পর্বঃ অষ্টাদশ শতাব্দী।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে-
ক. প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০ খ্রিঃ)।
খ. মধ্যযুগ
(i) পাঠান আমল (১২০১-১৫৭৬ খ্রিঃ)।
(ii) মোগল আমল (১৫৭৭-১৮০০ খ্রিঃ)।
ড. এনামুল হক মধ্যযুগকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন-
ক. তুর্কি যুগ (১২০০-১৩৫০ খ্রিঃ)।
খ. সুলতানী যুগ (১৩৫১-১৫৭৫ খ্রিঃ)।
গ.মোগলাই যুগ (১৫৭৬–১৭৫৭ খ্রিঃ)।
ড. আহমদ শরীফের যুগবিভাগ—
ক. প্রাচীন যুগ (মৌর্য-গুপ্ত-পাল-সেন শাসনকাল)।
খ. আদি-মধ্যযুগ (তের-চৌদ্দ শতক) তুর্কি-আফগান মুঘল শাসনকাল।
গ. মধ্যযুগ (পনের-আঠার শতক)।
ঘ. আধুনিক যুগ- ব্রিটিশ শাসনকাল।
ঙ. বর্তমান কাল-স্বাধীনতা-উত্তরকাল।
ড. ওয়াকিল আহমদের যুগবিভাগ—
ক. উন্মেষের যুগ (আট-বার শতক) আদি মধ্যযুগ।
খ. শূন্যতার যুগ (তের-চৌদ্দ শতক) মধ্য মধ্যযুগ।
গ. বিকাশের যুগ (পনের শতক) মধ্য মধ্যযুগ।
ঘ. সমৃদ্ধির যুগ (ষোল-সতের শতক) মধ্য মধ্যযুগ।
ঙ. অবক্ষয়ের যুগ (আঠার শতক) অন্ত্য-মধ্যযুগ।
উপর্যুক্ত বিভিন্ন পণ্ডিতের যুগবিভাগকে পর্যালোচনা করলে দাঁড়ায় যে, রামগতি ন্যায়রত্নের যুগবিভাগ সীমাবদ্ধ। দীনেশচন্দ্র সেন কোন একটি স্থির মানদণ্ডের সাহায্যে যুগবিভাগ করেন নি, কখনো বা ধর্ম, কখনো বা শাসককে অবলম্বন করেছেন, এখানেই তার যুগবিভাগের ত্রুটি। সুনীতি বাবুর যুগবিভাগে মুসলমান-পূর্ব যুগ কথাটির সাথে তুর্কি বিজয়ের যুগ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তার ‘নবাবী আমল’ এবং ‘ইংরেজি যুগ’ এভাবে বলাও যুক্তিযুক্ত নয়। তাকে যে কোন এক পন্থা অবলম্বন করতে হত। এক শাসকের নাম বললে অন্য শাসকদেরও নাম বলতে হত। অথবা বৈষ্ণব সাহিত্য যুগ বললে চর্যাপদের যুগ বলাই শ্রেয় ছিল। গোপাল হালদার, অসিতকুমার প্রমুখ যখন চৈতন্য যুগ বলেন তখন ঐ সময়ের অন্য সাহিত্যের যেমন মঙ্গলকাব্যের অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করা যায় না, এটা বড় রকমের ত্রুটি ।
বিভিন্ন পণ্ডিতের যুগবিভাগ থেকে দেখা যায় যে, প্রাচীন ও আধুনিক যুগ সম্পর্কে তেমন মতভেদ না থাকলেও মধ্যযুগ সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। এসব মতপার্থক্য দূর করে কেউ কেউ মধ্যযুগকে আদি-মধ্যযুগ (১২০১-১৫০০ খ্রিঃ) এবং অন্ত্য-মধ্যযুগ (১৫০১- ১৮০০ খ্রিঃ) এ দুই ভাগে ভাগ করেছেন।
উপর্যুক্ত সকল জটিলতা পরিহার করে ড. সুকুমার সেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে কালানুক্রমিক ও বস্তুগতভাবে তুলে ধরে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন-
ক. আদি পর্যায়ঃ প্রাক্-তুর্কি আগমন (১২০০ খ্রিঃ পর্যন্ত)।
খ. মধ্য পর্যায়ঃ তুর্কি আগমনের পরবর্তী কাল (১২০১-১৮০০ খ্রিঃ)।
গ. আধুনিক পর্যায়ঃ ইংরেজ প্রভাবিত কাল (১৮০১- বর্তমান)।
মূলত সাহিত্যের যুগবিভাগে জাতিগত, ধর্মীয় বা শাসক সম্পর্কীয় নামকরণ যুক্তিসঙ্গত নয়। কেননা সাহিত্য কোন ব্যক্তি, ধর্ম বা শাসক প্রভাবিত নয়। সাহিত্য হচ্ছে সমাজ প্রভাবিত। তাই হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ, বৌদ্ধ যুগ বা পাঠান আমল, মোঘল আমল, বৌদ্ধ আমল, সেন আমল, ইংরেজ আমল ইত্যাদি নামকরণ যুক্তিযুক্ত নয়। বাংলা সাহিত্যকে কালগত ও বিষয়গত বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ– এই তিন ভাগে ভাগ করা যুক্তিযুক্ত। যেহেতু প্রথমেই বলা হয়েছে বিশাল কালকে একই সাথে তুলে ধরা কষ্টসাধ্য, তাই মধ্যযুগকে আদি-মধ্যযুগ এবং অন্ত্য-মধ্যযুগ এ দু ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। তাই আমার মতে, বাংলা সাহিত্যের পঠনপাঠনের সুবিধার্থে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে চারটি যুগে ভাগ করা যুক্তিযুক্ত-
১. প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০ খ্রিঃ)।
২. আদি-মধ্যযুগ (১২০১-১৫০০ খ্রিঃ)।
৩. অন্ত্য-মধ্যযুগ (১৫০১-১৮০০ খ্রিঃ)।
৪. আধুনিক যুগ (১৮০১- বর্তমান পর্যন্ত)।