অথবা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার কুফল আলোচনা কর।
অথবা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার দোষসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার নেতিবাচক দিকসমূহ কী কী?
অথবা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার অসুবিধা আলোচনা কর৷
ভূমিকাঃ দুটি কক্ষ থাকলে তাকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বলা হয়। স্যার হেনরি মেইন, জে. এস. মিল প্রমুখ মনীষীরা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভাকে সমর্থন করেছেন। হেনরি মেইনের মতে, “একেবারে না থাকার চেয়ে যে কোন ধরনের একটি দ্বিতীয় কক্ষ থাকাও ভালো।” ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে ১৭৮৭ সালে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা সমর্থন করেন কিন্তু তার মতামত গৃহীত হয় নি। অবশ্য তার প্রভাবে স্বীয় প্রদেশ পেনসালভানিয়াতে যে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়েছিল তা ১৮০০ সাল পর্যন্ত মাত্র চালু ছিল। ফ্রান্সে ১৭৯৫ সালে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা চালু হয়ে একনাগাড়ে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত চলে। এরপর স্বল্প সময়ের জন্য আবার এককক্ষে রূপ নেয় কিন্তু তা চলে মাত্র সামান্য সময়। ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্সসহ বহু দেশে দ্বিকক্ষ আইনসভা আছে। অবশ্য এটাও দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়৷
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার বিপক্ষে যুক্তিঃ
১. আইন প্রণয়নে জটিলতাঃ এই পদ্ধতি আইন প্রণয়নে জটিলতা সৃষ্টি করে এবং এতে দীর্ঘ সময় নষ্ট হয়। উচ্চ আইন প্রণয়নে অযথা মানাপ্রকার অনাবশ্যক বিলম্ব ঘটায়। অনেক সময় ডারুরি আইন প্রণয়নে পরস্পর দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। এ ধরনের মনোভাব যেন স্বাভাবিক আচরণে পরিণত হয়। অধ্যাপক শেলী বলেন, “দ্বিকক্ষে বিবাদ এবং দ্বিমত অবশ্যম্ভাবী হয় এবং কক্ষদ্বয়ের পরস্পরের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে জনমত অচল হয়ে পড়ে।” (When there are two chambers, discord and division will be inevitable and the will of the people will be paralyzed by their interaction).
২. দ্বিমতের সৃষ্টিঃ এ আইন পরিষদে সর্বসময়ে দ্বিমতের অবকাশ থাকে, তাতে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে আইন প্রণয়ন বিঘ্নিত হয়। দুটি কক্ষের মধ্যে বিভিন্ন নিয়মনীতির মিল না থাকলে আরো খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। দুটি কক্ষে দুটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলে সরকার পরিচালনাই সম্ভবপর হয়ে উঠে না। এহেন অবস্থায় এককক্ষ সমর্থন করলে অন্য কক্ষ বিনা কারণে মতদ্বৈততা হেতু বিরোধিতা করে।
৩. রক্ষণশীলতাঃ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা সাধারণত রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন হয় এবং প্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় কক্ষ স্বাভাবিকই সমাজের উচ্চ শ্রেণির লোকের নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং দল হিসেবে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে তৎপর হয়। লর্ড সভার এমনি আচরণ পরিলক্ষিত হয়েছে।
৪. ব্যয় অধিকঃ এতে অধিক পরিমাণে ব্যয় হয়। সদস্যদের সম্মানী, ভ্রমণ ও অবস্থান ভাতাসহ দেয় সরকারি অর্থ দ্বিগুণ পরিমাণে খরচ হয়। তাছাড়া সাংগঠনিক ব্যয় আছে। দরিদ্র দেশের জন্য দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা অযথা অপব্যয় ছাড়া আর কিছুই না।
৫. আইন প্রণয়নে সহায়ক নয়ঃ সুষ্ঠু ও শাস্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা আইন প্রণয়নের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। দ্বিকক্ষে এ ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে না। দুটি কক্ষ প্রায় সবসময় ভিন্ন মত পোষণ করে। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন দ্বিকক্ষ আইনসভাকে “একটি ঘোড়ার গাড়ি যার দুপাশে দুটি ঘোড়া জুড়ে দেয়া হয়েছে” (A cart with a pair of horses hitch to each other) বলে অভিহিত করেছেন। আইনসভায় সঠিক দায়িত্ব নির্ণয় করা যায় না। দ্বিকক্ষ থাকলে একে অপরকে দোষারোপে দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে।
৬. অপ্রয়োজনীয়তাঃ বাস্তবে এর কোন প্রয়োজন নেই। যদি প্রথম কক্ষ দ্বিতীয় কক্ষের সমর্থন পায়, তাহলে অপ্রয়োজনীয় এবং না পেলে বাধার সম্মুখীন হয়। বেন্থাম এজন্য অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর (Needless, useless and worst than useless) হিসেবে অভিমত প্রদান করেছেন। অনেকে একে গাড়ির পঞ্চম ঢাকার সাথে তুলনা করেছেন। গাড়ি সচল রাখার পিছনে এ চাকার কোন গুরুত্ব নেই। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য দ্বিতীয় কক্ষের প্রয়োজন নেই। এজন্য সবচেয়ে যা বেশি প্রয়োজন তা হলো আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবে প্রয়োগ।
৭. জ্ঞানীগুণীদের সেবাঃ দেশের জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের সেবা লাভের জন্য দুটি কক্ষ স্থাপনের কোন প্রয়োজন হয় না। এজন্য এককক্ষই যথেষ্ট। কারণ এককক্ষেই তাদের মনোনয়ন বা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের আয়োজন করা যেতে পারে।
৮. যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আবশ্যকঃ যুক্তরাষ্ট্রের সফলতার জন্য দ্বিকক্ষ আইনসভা আবশ্যক নয়। অধ্যাপক লাস্কি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনের মধ্যেই অঙ্গরাজ্যগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। সংবিধানের ধারা অনুসারে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারসমূহ স্বীয় দায়িত্ব পালন ও অধিকার ভোগ করে। এতে দ্বিতীয় কক্ষের করার কিছুই নেই ৷ কখনো যদি কোন সরকার কোন সরকারের অধিকারে বিঘ্ন ঘটায় তখন কক্ষ এর বিহিত ব্যবস্থা করতে পারে না। এহেন পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তের জন্য শরণাপন্ন হতে হয়।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, দ্বিকক্ষ আইনসভার বহু সমালোচনা আছে সত্য কিন্তু আমরা বড় বড় রাষ্ট্রে এ আইনসভা দেখতে পাই। দ্বিতীয় কক্ষের সমালোচনা আছে তবে তা নিরসন করা অসম্ভব নয়। এজন্য সংগঠন পদ্ধতি সুষ্ঠু হওয়া বাঞ্ছনীয়। মনোনয়ন দান অগণতান্ত্রিক, তাই মনোনয়ন দিয়ে কোন কক্ষ গঠন করা অনুচিত। দ্বিতীয় কক্ষের সদস্যবর্গ যেন সকল সময় তাদের নিজের বা দলীয় স্বার্থ সংরক্ষণে অধিক যত্নবান না হন সেদিকে নজর রাখা প্রয়োজন। লর্ডসভায় সদস্যদের উপস্থিতির হার খুব কম, কিন্তু কোন সময় তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোন আইন প্রণীত হতে গেলে তখন উপস্থিতির সংখ্যা ভয়ানক বৃদ্ধি পায়। লর্ডসভার ক্ষমতা হ্রাসের পিছনে মনোভাব কম দায়ী নয়। সদস্যগণ কোন সময়ে ব্যক্তিস্বার্থের প্রতি নজর রাখবেন না। উত্তরাধিকার হিসেবেও সদস্য প্রাপ্তি অগণতান্ত্রিক।