অথবা, দেহ-মনের সম্পর্কবিষয়ক মতবাদ হিসেবে পূর্ব স্থাপিত শৃঙ্খলাবাদ সমালোচনাসহ ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ দর্শনের বিভিন্ন সমস্যাবলির মধ্যে দেহ ও মনসম্পর্কিত সমস্যাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। আধুনিক কালের দার্শনিকদের মধ্যে কেউ কেউ দেহ ও মনকে আলাদা দ্রব্য হিসেবে স্বীকার করেছেন, আবার কেউ কেউ দেহ ও মনকে একই দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তবে যা-ই হোক না কেন, দেহ ও মন পরস্পর নির্ভরশীল। কেননা দেহ সুস্থ থাকলে মন সুস্থ ও সতেজ থাঁকে। আবার দেহ অসুস্থ হয়ে পড়লে মনও দুশ্চিন্তা ও দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়। দেহ ও মনের সম্পর্ক বিষয়ে দর্শনের ইতিহাসে বিভিন্ন মতবাদ লক্ষ্য করা যায়, যার একটি হলো পূর্বস্থাপিত বা পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ। নিম্নে এই পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলাবাদ ব্যাখ্যায়িত হলো-
দেহ ও মনের সম্পর্ক সম্বন্ধে বিভিন্ন মতবাদঃ বিভিন্ন দার্শনিক দেহ ও মনের সম্পর্ক সম্বন্ধে যে বিভিন্ন মতবাদ দিয়েছেন সেগুলোর মধ্যে নিম্নলিখিত মতবাদ অন্যতম প্রধান। যথা- (১) ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ, (২) প্ৰয়োজনবাদ, (৩) সমান্তরালবাদ, (৪) পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলাবাদ, (৫) উপ-বস্তুবাদ, (৬) বিজ্ঞানবাদ, (৭) পরব্রহ্মবাদ, (৮) স্বেচ্ছামূলক ভাববাদ, (৯) সৃজনবাদ, (১০) উন্মেষবাদ। নিম্নে পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ নিয়ে আলোচনা করা হলো-
পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদঃ পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ সম্পর্কিত ধারণা আধুনিক বুদ্ধিবাদী দার্শনিক লাইবনিজের দর্শনে তথা চিন্তায় লক্ষ্য করা যায়। তিনি দেহ ও মনের সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়েই মূলত এই পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলাবাদের কথা বলেন। এ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা নিম্নরূপ-
(১) ঈশ্বর কর্তৃক দেহ ও মনের মধ্যে সৃষ্টির সময়েই সঙ্গতি স্থাপনঃ লাইবনিজের মতে, ঈশ্বর সৃষ্টির সময়ই দেহ ও মনের মধ্যে এক শৃঙ্খলা স্থাপন করে দিয়েছেন। এ শৃঙ্খলা অনুসারে দেহ ও মন পরস্পরের মধ্যে নিত্যসঙ্গতি রক্ষা করে চলেছে। প্রতিমুহূর্তে এ সঙ্গতির জন্য ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় না। সৃষ্টির সময় একবার হস্তক্ষেপ করেই ঈশ্বর দেহ ও মনের নিত্যসঙ্গতির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। লাইবনিজ দেহ ও মনকে দু’টি ঘড়ির সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, দু’টি ঘড়ি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, অর্থাৎ ঘড়ি দু’টি তৈরি করার সময় তার মধ্যে এমনভাবে শৃঙ্খলা স্থাপন করা হয়েছে যার ফলে দু’টি ঘড়ি আলাদাভাবে অবস্থান করেও একই রকম সময় নির্দেশ করে চলেছে। অনুরূপভাবে দেহ ও মনের মধ্যে ঈশ্বরকৃত পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলার কল্যাণে দৈহিক পরিবর্তনের সাথে সাথেই মানসিক পরিবর্তন বা মানসিক পরিবর্তনের সাথে সাথে দৈহিক পরিবর্তন ঘটা সম্ভব হয়।
(২) চিৎপরমাণু নিরপেক্ষ হলেও পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলার কল্যাণে সম্পর্কযুক্তঃ লাইবনিজের মতে, জগৎ চিৎপরমাণুতে পরিপূর্ণ। তবে এ চিৎপরমাণুগুলোতে চৈতন্য প্রকাশের মাত্রাভেদ আছে। কতকগুলো চিৎপরমাণু অচেতন, কতকগুলো চেতন আবার কতকগুলো আত্মসচেতন। প্রত্যেক চিৎপরমাণুই স্বনির্ভর আত্মকেন্দ্রিক এবং গবাক্ষহীন। এরা পরস্পর প্রভাবমুক্ত। ঈশ্বর হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ পরমাণু। তিনিই অন্যান্য পরমাণুকে সৃষ্টি করেছেন এবং আগে থেকে এদের ভেতর নিত্যসঙ্গতি প্রদান করেছেন। ফলে এরা নিরপেক্ষ হলেও পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলার কল্যাণে সম্পর্কযুক্ত।
(৩) সর্বশ্রেষ্ঠ মোনাড কর্তৃক শৃঙ্খলা স্থাপনঃ লাইবনিজের মতে, সর্বশ্রেষ্ঠ মোনাডই অন্য মোনাডগুলোকে সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করার সময় তাদের মধ্যে একটি শৃঙ্খলা স্থাপন করে দিয়েছেন। এর ফলে জগতে কোথাও কোনো অরাজকতা বা কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, সবকিছুই নিয়ম-শৃঙ্খলামতো চলছে। অর্থাৎ জগতে বিভিন্ন জিনিস আছে, যাদের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলেও ঈশ্বর কর্তৃক সবকিছু সৃষ্টি হওয়ার কারণেই এবং সবকিছু সৃষ্টির সময় নিয়ম-শৃঙ্খলা স্থাপন করার কারণেই জগতের সবকিছু শৃঙ্খলা অনুযায়ী, নিয়ম-নীতি অনুযায়ী চলছে। লাইবনিজের এ মতই পূর্বপ্রতিষ্ঠিত সঙ্গতিবাদ বা Pre Established harmony নামে পরিচিত।
সমালোচনাঃ দেহ ও মনের স্বরূপ সম্পর্কিত পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদের যথেষ্ট ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়, যা নিম্নরূপ-
(১) বাস্তবতাবিরোধী মতবাদঃ লাইবনিজ বলেন, ঈশ্বর কর্তৃক সবকিছুর মধ্যেই সৃষ্টির সময় সঙ্গতি স্থাপনের কারণে কোথাও কোনো অরাজকতা বা বিশৃঙ্খলা নেই। কিন্তু আমরা বাস্তবে দেখি যে জগতের অনেক বিষয়ের মধ্যেই দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগে আছে। যেমন প্রাকৃতিক কারণেই বন্যা, ঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদি ঘটে থাকে। কাজেই তার এ মতবাদ বাস্তবতাবিরোধী মতবাদ।
(২) ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকারঃ লাইবনিজ তার মোনাডবাদ ব্যাখ্যায় অসংখ্য মোনাডের কথা বললেও পূর্বপ্রতিষ্ঠিত সঙ্গতিবাদের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন যে, সর্বশ্রেষ্ঠ মোনাড আছে এবং সেই সর্বশ্রেষ্ঠ মোনাডই ঈশ্বর, যিনি সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন। এই ব্যাখ্যা দ্বারা মনে হয় যে, ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে তিনি ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন।
(৩) স্ববিরোধী ধারণাঃ লাইবনিজের মতে, কোনো মোনাডই অন্য মোনাড দ্বারা প্রভাবিত হয় না। আবার তিনিই বলেছেন যে, সর্বশ্রেষ্ঠ মোনাড ঈশ্বর অন্য মোনাডগুলোকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের মধ্যে একটি শৃঙ্খলা স্থাপন করে দিয়েছেন। অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ মোনাড অন্য মোনাডগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। কাজেই দেখা যায় যে লাইবনিজের মতবাদ স্ববিরোধিতা দোষে দুষ্ট।
(৪) অবৈজ্ঞানিকঃ দেহ ও মনের সঙ্গতি রক্ষা করার জন্য এ মতবাদে উপলক্ষবাদীদের মত ঈশ্বরের সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছে, যা আমাদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। কারণ ঈশ্বরের সাহায্যে দেহ-মনের সম্বন্ধের ব্যাখ্যা বিজ্ঞানসম্মত নয়।
(৫) দেহমনের প্রভাবঃ লাইবনিজ ঈশ্বরকে সর্বশ্রেষ্ঠ চিৎপরমাণু মনে করে তাকে অন্যান্য চিৎপরমাণুর শৃঙ্খলাবদ্ধ করার শক্তি দেন। কিন্তু তিনিই আবার বলেন পরমাণুগুলো গবাক্ষহীন এবং এরা একে অপরের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। যদি তাই হয় তাহলে ঈশ্বরও গবাক্ষহীন, কেননা তিনিও এক চিৎপরমাণু। দেহ এবং মনও তাই। সুতরাং ঈশ্বর দেহ ও মনের ওপর বা অন্যান্য চিৎপরমাণুর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দেহ ও মনের সম্পর্কের স্বরূপ সম্পর্কিত আলোচনায় পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ নামক মতবাদে কিছু ত্রুটি লক্ষ করা গেলেও এটাকে একেবারে মূল্যহীন বলা যায় না। কেননা, জগতের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে অসঙ্গতি থাকলেও অনেক বিষয়ই নিয়ম-শৃঙ্খলা অনুযায়ী চলছে। আর এ চলার পেছনে আগে থেকে কোনো কিছু প্রতিষ্ঠিত বিষয় না থেকে পারে না। এ ছাড়া ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকেও যদি বিষয়টি বিবেচনা করা হয় তাহলেও তার এ মতবাদ খুবই সন্তোষজনক বলে মনে হয়। শুধু তা-ই নয়, বিংশ শতাব্দীর চিন্তার পেছনে লাইবনিজের এই মতবাদ যথেষ্ট সহায়তা করেছে। সুতরাং বলা যায়, দর্শনের ইতিহাসে তার এই পূর্বপ্রতিষ্ঠিত সঙ্গতিবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।