প্রশ্নঃ বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলতে কী বোঝায়? অন্ধকার যুগের অস্তিত্ব স্বীকার করা কতটা যুক্তিযুক্ত?
উত্তরঃ ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজী লক্ষ্মণ সেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে বাংলায় মুসলমান শাসন শুরু করেন। এ সময় থেকে শুরু করে প্রায় দেড়শ বছর অর্থাৎ ১২০১ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা হানাহানি মারামারি ক্ষমতা বদলের পর ক্ষমতা বদল প্রভৃতি কারণে দেশের অভ্যন্তরে সাময়িকভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ায় সাহিত্য চর্যা বিঘ্নিত হয়েছিল, অর্থাৎ এ সময়ে তেমন কোন সাহিত্য সৃষ্টি হয় নি। তাই এ সময়কে ঐতিহাসিকেরা অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু আধুনিক গবেষকদের মতে প্রচুর না হলেও এ সময় বাংলা সাহিত্যের কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। ডঃ এনামুল হকের মতে চর্যাপদ, ডাক ও খনার বচন ইত্যাদির রচনাকাল মধ্যযুগের প্রথম পাদে। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে ‘সেক শুভোদয়ার’ অন্তর্গত পীর মাহাত্ম্যজ্ঞাপক ‘বাংলা আর্যা’ অথবা ‘ভাটিয়ালি রাগেন গীরতে’ নির্দেশক বাংলা গান, রামাই পণ্ডিত রচিত শূন্যপুরানের অন্তর্গত ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ শীর্ষক কবিতা, এছাড়া মঙ্গলকাব্যও রয়েছে। তাছাড়া শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর ভাষা বিচারে ধরা পড়ে যে, এ কাব্যটি ১৩৫০-এর কাছাকাছি সময়ে লিখিত। চর্যাপদ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষার পার্থক্য দেখে মনে হয় এদের মাঝখানে আর একটি ভাষাস্তর আছে যা হয়তো আবিষ্কারের মুখ চেয়ে আছে।
তাহলে এ সময়টিকে মূলত অন্ধকার যুগ বলা যাবে না। তবে এটাও ঠিক যে এ সময় সাহিত্যকর্ম তেমন একটা হয় নি। তবে স্বল্পতার ক্ষেত্রে অবশ্যই এদেশের মানুষের জীবন- যাপন ব্যবস্থাটা বিবেচনায় আনতে হবে। এখানকার আবহাওয়া, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসচেতনতা আজকের মত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পুঁথি সংরক্ষণ করা যেত না। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ইঁদুর, উইপোকা ইত্যাদিতে সহজেই নষ্ট করতে পারে। তাছাড়া তালপাতায় লেখা হত। কেননা দীর্ঘ দেড়শ বছর এদেশের মানুষ তাদের সুখ-দুঃখের গান বা গাথা রচনা করেন এমন ভাবাই যায় না।
সুতরাং উক্ত সময়ের মধ্যে বিশেষ কোন গ্রন্থ যে লিখিত হয় নি তাও জোর করে বলা যায় না। কেননা চর্যাপদ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মত সে সময়ে রচিত কোন পুঁথি হয়তো আবিষ্কারের প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে। তাই এ সময়টিকে অন্ধকার যুগ বলা যথার্থ হবে না।