প্রশ্নঃ মধ্যযুগে ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্থান ও বিকাশের ইতিহাস আলোচনা কর।
অথবা, মধ্যযুগে ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিকাশ এবং এদের প্রভাব মূল্যায়ন কর।
ভূমিকাঃ মধ্যযুগে ইউরোপে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ও বিকাশের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে নবম শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ চার্চের অধীনে। চার্চ উপলব্ধি করেন যে, খ্রিস্টান ধর্মের প্রসার ও একটা ভালো খ্রিস্টান জগৎ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন শিক্ষিত শ্রেণির। তাই লক্ষ্যণীয় যে, শুরুর দিকে গড়ে ওঠা স্কুলগুলোর সাথে চার্চের একটি বিশেষ সম্পর্ক ছিল। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
(১) চার্চ ও ক্যামড্রেল কলেজের শিক্ষাঃ চার্চ ও ক্যামড্রেল কলেজগুলোতে মূলত ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হতো, যাতে যুবকেরা চার্চের প্রতি অনুগত থাকে। মধ্যযুগের ইতিহাসের যে প্রধান বৈশিষ্ট্য ইউরোপের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছে তা হচ্ছে খ্রিস্টান ধর্ম। মধ্যযুগীয় ইউরোপে শিক্ষা ব্যবস্থার উপরেও ধর্মের অনুরাগ প্রবলভাব পরিলক্ষিত হয়। মধ্যযুগের এই শিক্ষা ব্যবস্থার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।
(২) বিশ্ববিদ্যালয়ঃ বিশ্ববিদ্যালয় বা University শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ Universitas শব্দ থেকে। যার অর্থ হলো Guide বা সঙ্গী। ইউনিভার্সিটিতে বিভিন্ন বিষয়ে একটু ব্যাপকভাবে পড়ানো হতো। এটি এমন একটা প্রতিষ্ঠান যেখানে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বেশ কিছু লোক একটা বিশেষ স্থানে মিলিত হতো। সুতরাং দ্বাদশ শতকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল শুধুমাত্র ছাত্র ও শিক্ষকের। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো Campus ছিল না, যা আজকের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে। শুধুমাত্র কতিপয় লোকের একত্রিত হবার জন্য এবং যাতে পড়ালেখা করা যায় সে ব্যবস্থাই সূচনালগ্নে বন্দোবস্তো ছিল।
(৩) বিশ্ববিদ্যালয় বিকাশের কারণঃ ভালো কিংবা কল্যাণকর কোনো কিছুই ছোট্ট একটা গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। বরং দিন যতই এগিয়ে চলে ততোই বুদ্ধিদীপ্ত লোকজন তার বিকাশ সাধন কিংবা সুযোগ বৃদ্ধির জন্য চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকে। এমনই কতগুলো বিশেষ কারণে মূলত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো-
(ক) জ্ঞানের প্রতি মানুষের আগ্রহঃ ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির ফলে নগরায়ণ বৃদ্ধি পায়। জনবসতি গড়ে ওঠে। শিক্ষা ও শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পায়। পেশাভিত্তিক শ্রেণি গড়ে ওঠে এবং পেশাভিত্তিক জ্ঞানের প্রতি মানুষ ঝুঁকে পড়ে। ক্রমেই জ্ঞানের প্রতি মানুষের আগ্রহ আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়। ফলে Law, Medicine, Theology ইত্যাদি পেশাভিত্তিক জ্ঞানের প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পায় বহুলাংশে।
(8) উচ্চ শিক্ষার আলো বিচ্ছুরণঃ Astrology, Theology এবং Medicine এর মতো উন্নত বিষয় চার্চেও পড়ানোর ব্যবস্থা করা যেত কিন্তু চার্চের প্রধান সে অনুমতি দেননি। কারণ তিনি ভেবেছিলেন তাতে স্রষ্টার প্রতি অনেক জনসাধারণের আস্থা কমে যাবে। তা ছাড়া তৎকালীন পণ্ডিতরা ধর্মীয় গোঁড়ামি ত্যাগ করে জনসাধারণকে উন্নত জ্ঞানর্জনের সুযোগ গ্রহণের কথা বলতে থাকেন। দার্শনিক সেন্ট টামাস একুইনাস তখন বলেন, মানষের ক্ষমতা অনেক বেশি। ধর্মজ্ঞান দিয়ে মানষের ক্ষমতাকে ছোট করা হচ্ছে। অর্থাৎ এই পর্যায়ে সমাজের পণ্ডিতরা জনগণকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে উৎসাহিত করতে থাকে। মধ্যযুগের এই প্রেক্ষাপটে ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে।
(৫) ইতালিতে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ঃ ১১৫০ সালে ইতালিতে প্রথম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিছু সংখ্যক উৎসাহী শিক্ষার্থীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ঐ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা নিয়ন্ত্রণ করতো। তারা নিজেরা চাঁদা দিয়ে শিক্ষকদের বেতন দিত এবং নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোনো শিক্ষক নিয়োগ ও বরখাস্ত করতে পারতো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭টি Elementary Subject ছিল। যথা- 1. Rhetoric, 2. Astronomy, 3. Geometry, 4. Arithmetic, 5. Music, 6. Grammar, 7. Dialectic। এ ছাড়া উচ্চতর Subject ছিল তিনটি। যথা- 1. Theology, 2. Law এবং 3. Medicine. ।
(৬) জার্মানিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাঃ চতুর্দশ শতক পর্যন্ত জার্মানিতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তখনও জার্মানিতে Monastic স্কুলের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। কারণ জার্মানির রাজা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ছিল। ফলে চার্চ থেকে প্রাপ্ত অর্থ তার প্রয়োজন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে চার্চ ভেঙে যাবে এবং জার্মানিতে বিত্তবান লোকের সংখ্যাও কম ছিল। ১৩৪৭ সালে জার্মানিতে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৩৫ সালে জার্মানিতে অপর আর একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
(৭) বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বৈশিষ্ট্যঃ তৎকালীন সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হত, সেগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল:
- (১) বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ছাত্র-ছাত্রীকে ল্যাটিন ভাষা শিখতে হতো। একজন ছাত্রকে এম.এ পাস করতে হলে তাকে কমপক্ষে ২০ বছর বয়সী হতে হতো এবং এম. এ ক্লাসে ৩/৪ বছর অধ্যয়ন করতে হতো।
- (২) এম. এ ক্লাসে ৪টি বিষয় পড়ানো হতো। যথা- 1. Arithmetic 2. Geometry 3. Astronomy. 4. Master of Theology
- (৩) Master of Theology তে পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের বয়স কমপক্ষে ৩৫ বছর হতে হতো এবং তাকে অতিরিক্ত ১০ বছর অধ্যয়ন করতে হতো।
- (৪) শিক্ষক ও ছাত্র উভয়কেই কালো গাউন পরতে হতো।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ডাক্তার, বিজ্ঞানী, শিক্ষক তৈরি করে একটি উন্নত সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছে। প্রতিভাকে সঠিকভাবে বিকশিত করেছে এ সব বিশ্ববিদ্যালয়। বিদেশী সামন্তবাদকে ভেঙে একটি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার কৃতিত্ব এদের ছিল। মধ্যযুগের এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাত ধরেই পরবর্তীতে সমৃদ্ধশালী আধুনিক ইউরোপের প্রতিষ্ঠা। যা পুরো বিশ্বের মধ্যে সূর্যালোকের ন্যায় প্রজ্বলিত হয়ে রয়েছে।