প্রশ্নঃ কার্ল মার্কসের রাষ্ট্রতত্ত্ব সংক্ষেপে আলােচনা কর।
অথবা, কার্ল মার্কস-এর রাষ্ট্রতত্ত্ব সংক্ষেপে লিখ।
ভূমিকাঃ কার্ল মার্কস-এর অন্যান্য তত্ত্বগুলাের মত একটি উল্লেখযােগ্য তত্ত্ব হলাে তার রাষ্ট্র সম্পর্কিত মতবাদ। এই রাষ্ট্রতত্ত্বের আলােচনায় কিভাবে একটি রাষ্ট্র বিলুপ্ত হয়ে যাবে তা ব্যাপকভাবে আলােচনা করেছেন মার্কস। নিম্নে তা তুলে ধরা হলােঃ
(১) সমাজ বিবর্তনের বিশেষ স্তরে রাষ্ট্রের উৎপত্তিঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কস ও এঙ্গেলস সমাজ বিকাশের চারটি স্তরের কথা বলেছেন-
(ক) আদিম সাম্যবাদী সমাজ,
(খ) দাস সমাজ,
(গ) সামন্ততান্ত্রিক সমাজ,
(ঘ) পুঁজিবাদী সমাজ।
(২) রাষ্ট্র শােষণের হাতিয়ারঃ Aristotle-এর মতে, সাধারণ জীবন ও উন্নত জীবনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের জন্ম। মার্কস এ অভিমতকে অগ্রাহ্য করে ঘােষণা করেন যে, রাষ্ট্র হচ্ছে শােষণের হাতিয়ার। যার সাহায্যে শাসক শ্রেণি তাদের আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় যেহেতু পুঁজিপতিরা ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী এবং দুর্বল শ্রেণিগুলােকে শােষণ করাই যেহেতু এই শ্রেণির মূল লক্ষ্য, কাজেই রাষ্ট্র পুঁজিপতিদের শােষণ করার হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়।
(৩) রাষ্ট্র কৃত্রিম প্রতিষ্ঠানঃ মার্কস সনাতন তত্ত্বের মূলে কুঠারাঘাত করে ঘােষণা করেছেন যে, রাষ্ট্র অভিন্ন কল্যাণের লক্ষ্যে নিবেদিত কোনাে সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান নয়। রাষ্ট্র যেকোনাে সমাজের প্রভাবশালী অর্থনৈতিক শেণির হাতে গড়া একটি সংগঠন এবং অন্যান্য শ্রেণির ওপর এই শ্রেণির শাসন ও শােষণকে মজবুত করাই এর প্রধান লক্ষ্য।
(৪) নির্বাহী কমিটিঃ মার্কস-এর মতে, রাষ্ট্র প্রভাবশালী শ্রেণির একটি নির্বাহী কমিটি ছাড়া আর কিছুই নয়। ইতিহাসগতভাবে শ্রেণি শত্রুতার বিষময় প্রতিক্রিয়া থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রের জন্ম। তথাপি একথা সত্য যে, রাষ্ট্র বেশিদিন তার এ নির্মল চরিত্র টিকিয়ে রাখতে পারে না। অর্থনৈতিক অবস্থার আবশ্যিক ফলশ্রুতিতে স্বল্পকালের মধ্যেই রাষ্ট্র পরিণত হয় প্রভাবশালী বুর্জোয়া শ্রেণির ক্রীড়নকে। একমাত্র প্রভাবশালী শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকেই সে তার পবিত্র দায়িত্ব মনে করে।
(৫) রাষ্ট্রের বিলুপ্তি অবশ্যম্ভাবীঃ মার্কস-এর মতে, ‘State is not permanent institution’। তার মতে, এমন এক দিন আসবে যেদিন সংঘবদ্ধ শােষিত শ্রেণি বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করবে এবং সর্বহারা একনায়কতন্ত্র কায়েম হবে। যা শােষক শ্রেণিকে ধ্বংস করে প্রতিষ্ঠা করবে সাম্যবাদী সমাজের। তখন পরস্পর স্বার্থবাদী শ্রেণি থাকবে না, সমাজ হবে শােষণহীন। ফলে রাষ্ট্র নামের এ যন্ত্রের আর শােষণ থাকবে না। এতে স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটবে।
পরিশেষঃ মার্কস-এর রাষ্ট্র তত্ত্বের কিছু সমালােচনা থাকা সত্ত্বেও আমরা লক্ষ্য করতে পারি যে, তিনি সর্বদাই শােষিত শ্রেণির মঙ্গল কামনা করেছেন। তিনি শােষিত বঞ্চিতদের দুঃখ-দুর্দশা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। তাই ‘৯০-এর দশক পর্যন্ত পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ লােকের কাছে এ তত্ত্ব মানবিক মতবাদ হিসাবে মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হয়। রাষ্ট্র বিলীন হয়ে যাবে বলে তিনি যে মন্তব্য করেছিলেন তা বাস্তবে ভ্রান্ত প্রমাণিত হলেও মার্কস-এর রাষ্ট্র তত্ত্বের ধারণা মানুষকে যুগিয়েছে কর্মপ্রয়াসের অফুরন্ত প্রেরণা।