অথবা, হেগেলের বস্তুগত ভাববাদ কী?
ভূমিকাঃ ভাববাদের যে চর্চা শুরু হয়েছিল প্লেটোর লেখনীতে, সেই শিশুবৃক্ষটি মহীরূহ হয় দাঁড়িয়েছে বার্কলে, স্পিনােজা, লাইবনিজ এবং কান্টের রচনায়। তারা ভাববাদকে এমন একটা তূরীয় অবস্থানে নিয়ে গেছেন, যেখান থেকে দৃশ্যমান ইন্দ্রিয় জগতের দূরত্ব অনেক। হেগেলই প্রথম ভাববাদী দার্শনিক যিনি এই দূরত্বকে কমিয়ে আনতে চেয়েছেন। তার এই সমন্বিত মতবাদ দর্শনের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাববাদী মতবাদ হিসেবে গণ্য হয়েছে।
হেগেলের বস্তুগত ভাববাদঃ বস্তুবাদ ও ভাববাদের সুদীর্ঘ বিরােধ হেগেলের মতবাদে একটা নিষ্পত্তির দিকে অগ্রসর হয়। তিনি তার বস্তুগত ভাববাদে বস্তুবাদ ও ভাববাদের একটা সমন্বয় সাধন করেন। প্রথম ভাববাদী দার্শনিক হিসেবে তিনি উচ্চারণ করেন, বস্তুজগৎ পরমসত্তারই প্রকাশ। তার মতবাদকে এজন্য বস্তুগত ভাববাদ বলা হয়। আর জগতের বাস্তব সত্তাকে তিনি অস্বীকার করেননি। এই স্বীকৃতির বিভিন্ন পর্বে তিনি পূর্ববর্তী ভাববাদী মতগুলাে খণ্ডন করেন।
বার্কলির মত খণ্ডনঃ বার্কলে তার আত্মগত ভাববাদে বস্তুজগতের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অস্বীকার করে বলেন, সবকিছুই মনের ধারণা। হেগেল তার সমালােচনা করে বলেন, মন ও বাহ্যবস্তু উভয়ই পরমাত্মার প্রকাশ। তারা একই পরমাত্মায় প্রকাশ বলে মন বাহ্যবস্তু সম্পর্কে জানতে পারে। সুতরাং বিষয় হিসেবে বহির্জগতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
কান্টের মত খণ্ডনঃ কান্ট দৃশ্যমান জগৎ থেকে আলাদা একটা অতীন্দ্রিয় জগতের কথা বলেন, তার মতে, অতীন্দ্রিয় জগতকে জানা সম্ভব নয়। কারণ দৃশ্যমান জগতের জ্ঞানের আকার সমূহ অতীন্দ্রিয় সত্তার ক্ষেত্রে প্রাপ্য নয়। হেগেল কান্টের এই দ্বৈতবাদকে অস্বীকার করে বলেন, দৃশ্যমান জগতই আসল জগৎ, জীবাত্মা ও জড়বস্তু সবকিছুই পরম সত্তার প্রকাশ। এদের মাধ্যমে ধীরে ধীরে প্রকাশিত হওয়াই পরম সত্তার লক্ষ্য। কাজেই এই জগৎ মরীচিকা নয় এবং মন বাহ্যবস্তুকে জানতে পারে।
যা বৌদ্ধিক তাই বাস্তব, যা বাস্তব তাই বৌদ্ধিকঃ হেগেলের মতে, বুদ্ধির নিয়মটিও দ্বান্দ্বিক। বুদ্ধি ও সত্তা এক ও অভিন্ন। তাই ব্যক্তির নিকট জগৎ ও তার বিকাশ বুদ্ধিগ্রাহ্য। প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, সংহতি প্রভৃতি বুদ্ধির অস্তিত্ব প্রমাণ করে। কান্ট জ্ঞানের ক্ষেত্রে যে বারােটি ক্যাটাগরির কথা বলেন, হেগেলের মতে এগুলাে শুধু আত্মগতই নয়, বস্তুগতও। এভাবেই হেগেল ঘােষণা করেন, “Whatever is rational is real whatever is real is national” বা যা বৌদ্ধিক তাই বাস্তব, যা বাস্তব তাই বৌদ্ধিক। অর্থাৎ পরমসত্তাকে ইন্দ্রিয় বা মরমী কোনাে প্রকার অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই জানা সম্ভব নয়। একমাত্র বুদ্ধিই তার স্বরূপ উন্মােচন করতে সক্ষম। জগতে বুদ্ধিরই রাজত্ব।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, নানাবিধ ক্রটি সত্ত্বেও হেগেলের বস্তুগত ভাববাদ সুসংহত, সুসামঞ্জস্য এবং ব্যাপক। আমরা দেখি যে, আধুনিক দর্শনের জনক ডেকার্ট দর্শনের ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী আলােচনার গােড়াপত্তন করেন, হেগেলের মাধ্যমে সেই ধারাটির অবসান ঘটে।