অথবা, সামাজিক সমস্যা বলতে কী বুঝ? সামাজিক সমস্যা বা অনাচার কীভাবে সৃষ্টি হয় তা আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ মানবসমাজ এক গতিশীল সত্তা। গতিশীলতার কারণে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে এ সমাজ। পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারে না মানুষ। দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবােধ, রীতি-নীতির কারণে পার্থক্য দেখা দেয়। ফলে সৃষ্টি হয় সমস্যা। বিশ্বের সকল দেশেই সামাজিক সমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।
সমস্যা শব্দটির শাব্দিক বিশ্লেষণঃ ইংরেজি Problem শব্দের বাংলা পরিভাষা সমস্যা। গ্রীক শব্দ Problema হতে ইংরেজী Problem শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ হলাে এমন একটি নিক্ষেপিত ঘটনা, যা মানুষের চিন্তা ভাবনার বা মনােযােগ আকর্ষণে চাপ সৃষ্টি করে।
সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞাঃ সাধারণত সামাজিক সমস্যা বলতে সামাজিক অসঙ্গতি, বিশৃঙ্খলা এবং সামঞ্জস্যহীনতাকে বুঝায়, যার দ্বারা সমাজে অস্বস্তিকর ও অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন মনীষীগণ বিভিন্নভাবে সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তা আলােচনা করা হলােঃ
সমাজবিজ্ঞানী সি.এস.কেস বলেন, “সামাজিক সমস্যা হলাে এমন একটি অবস্থা যা উল্লেখযােগ্য সংখ্যক সচেতন ও যোগ্য পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি আকষণ করে এবং যে অবস্থা সম্পর্কে যৌথ কার্যক্রম গ্রহণের আবেদন ও অনুভূতি সৃষ্টি হয়।”
সমাজবিজ্ঞানী এল.কে.ফ্রাঙ্ক বলেন, “সামাজিক সমস্যা বলতে এমন একটি সামাজিক অসুবিধা কিংবা অসংখ্য লােকের অসদাচরণকে বুঝায় যাকে শোধরানাে কিংবা দূর করা দরকার।”
সমাজবিজ্ঞানী পি.বি. হর্টনের মতে, “সামাজিক সমস্যা বলতে এমন অবস্থা বুঝায় যা সমাজের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে এবং যা সমষ্টিগতভাবে মােকাবেলা করার প্রয়ােজন হয়।”
ডেভিড ড্রেসলার বলেন, “সামাজিক সমস্যা হচ্ছে মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া থেকে সৃষ্ট এমন একটি অবস্থা যাকে সমাজের উল্লেখযােগ্যসংখ্যক লােক অস্বাভাবিক বা অবাঞ্ছিত বলে বিবেচনা করে এবং প্রতিকার বা প্রতিরােধমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে দূরীকরণে তারা বিশ্বাসী হয়।
সামাজিক সমস্যার সংজ্ঞায় সমাজবিজ্ঞানী John. E. Nordskog (1965) বলেন, A Social problem means any social situation which attracts the attention of a considerable number of competent observers within a society.
পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক সমস্যা হলাে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সমাজ কর্তক সমস্যা হিসেবে স্বীকত এমন একটি অবাঞ্ছিত সামাজিক অবস্থা যা সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার মধ্য থেকে সৃষ্টি হয় এবং সমাজের অধিকাংশ সদস্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে।
সামাজিক সমস্যার কারণঃ সামাজিক সমস্যার জন্য যে সকল কারণ দায়ী তা নিম্নে আলােচনা করা হলােঃ
(১) দীর্ঘ পরাধীনতারঃ দীর্ঘকাল যাবৎ ঔপনিবেশিক শাসন ও শােষণের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে এদেশের সামাজিক জীবনে বন্ধ্যাত্বের সৃষ্টি হয় এবং নানা ধরনের সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দরিদ্রতা, নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার প্রভৃতি সমস্যা সে দীর্ঘ পরাধীনতার ফলশ্রুতি।
(২) মৌলিক চাহিদার অপূর্ণতাঃ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি মানুষের মৌলিক চাহিদা। মৌলিক চাহিদা পরিপূরণের মাধ্যমেই জনগণ তার স্বাভাবিক কর্মশক্তি অর্জন করে। কিন্তু মানুষ নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে অনিয়মতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করে, যা বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী।
(৩) প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশঃ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ বিভিন্ন সম্পদ বিনষ্ট করে সামাজিক জীবনে চরম প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি করে। ফলে সমাজে দারিদ্র্য, ভিক্ষাবৃত্তি, অপরাধ প্রবণতা, পতিতাবৃত্তি প্রভৃতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
(৪) সামাজিক পরিবর্তনঃ মানুষের পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে সমাজ। এই সমাজ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। সামাজিক পরিবর্তন মূলত পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত উভয় ভাবেই হয়ে থাকে। অপরিকল্পিত পরিবর্তনের ফলে সমাজে অবাঞ্ছিত অবস্থা ও অসঙ্গতির সৃষ্টি হয়, যা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী।
(৫) শিল্পায়ণ ও শহরায়ণঃ শিল্পায়ণ ও শহরায়ণের ফলে সারাবিশ্বে যে সকল সামাজিক সমস্যার সষ্টি হয়েছে তার ছোয়া কম-বেশি আমাদের সমাজেও লেগেছে। শিল্পায়ণের ফলে বেকারত্ব, পারিবারিক দ্বন্দ, শ্রমিক দ্বন্দ ইত্যাদি সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
(৬) অতিরিক্ত জনসংখ্যাঃ বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে অত্যধিক জনসংখ্যা। কেননা প্রতিবছর আমাদের দেশে দ্রুতগতিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু সে হারে ভরণপােষণের উপকরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে সমাজে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এজন্য এটাকে অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টিরও অন্যতম কারণ ধরা হয়।
(৭) বেকার সমস্যাঃ সামাজিক সমস্যার অন্যতম কারণ হলাে বেকারত্ব। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বেকার সমস্যা রয়েছে। উন্নত হােক বা অনুন্নত হােক সকল সমাজেই বেকারত্বের হার বেড়ে চলেছে। একে নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে বহু দিক দিয়ে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
(৮) সম্পদের অসম বন্টনঃ সম্পদের অসম বন্টন সামাজিক সমস্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। বাংলাদেশের সমগ্র সম্পদের ৯০ ভাগই মাত্র ১০ ভাগ লােকের অধিকারে এবং বাকী মাত্র ১০ ভাগ সম্পদের মালিক ৯০ শতাংশ লােক। সম্পদের এ অসম বন্টনের ফলেও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
(৯) অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশঃ বিশ্বব্যাপী আজ টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্লু-ফ্লিম, সিনেমা, অশ্লীল ম্যাগাজিনের অপসংস্কৃতিতে সয়লাব। এর প্রভাবে সমাজে হাইজ্যাক, ধর্ষণ, অপহরণ, খুন জখম ইত্যাদি ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
(১০) জৈবিক ও মানসিক কারণঃ অপরাধ বিজ্ঞানী লমব্রসাে মানুষের অপরাধ প্রবণতাকে জৈবিক কারণ প্রসূত বলেছেন। তার মতে, দৈহিক অসঙ্গতির জন্যই মানুষ সমাজে অপরাধ করে থাকে। অপরপক্ষে মনােবিজ্ঞানী গডার্ড অপরাধ প্রবণতার জন্য মানুষের মানসিক অক্ষমতা বা দোষ ত্রুটিকেই দায়ী করেছেন।
(১১) সামাজিক বৈষম্যঃ সামাজিক সম্পদের অসম বন্টনের ফলে সমাজে বৈষম্য ও বিদ্বেষ দেখা দেয়। এতে মানুষ প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং অপরাধপ্রবণতায় আক্রান্ত হয়, যা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টিতে সহায়তা করে। খুন-খারাবি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও ছিনতাই প্রভৃতি সমস্যা সামাজিক বৈষম্যের কারণে সমাজে দেখা যায়।
(১২) সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতাঃ যেকোনাে সমাজের সংস্কৃতি তার নিজস্ব সম্পদ। নগর ও শহরে শিল্পায়ণের দ্রুত অগ্রগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যতা, সাংস্কৃতিক সংকট ও পতিতাবৃত্তি বেড়ে চলেছে। শিল্পায়ণের ফলে নগরের উপর জন সমাগমের যে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয় তা থেকে নানাবিধ সমস্যার উদ্ভব ঘটে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক সমস্যা মূলত এককভাবে সৃষ্টি হয় না। সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির পিছনে ক্রিয়াশীল আছে অনেক বিষয়। তবে যে কারণেই সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হােক না কেন তা সমাজস্থ সকল জনগণের উপর ক্ষতিকর ও অস্বস্তিকর প্রভাব বিস্তার করে।