প্রশ্নঃ “মূলত অস্তিত্বের যন্ত্রণা ও জটিলতা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে।”- এই উক্তির সত্যাসত্য যাচাই কর।
অথবা, অস্তিত্ববাদ কী? সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনাসমূহে অস্তিত্ববাদের প্রভাব কতটুকু তা আলােচনা কর।
উত্তরঃ বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ঔপন্যাসিকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান, সচেতন এবং শক্তিমান শিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ [১৯২২-১৯৭১]। জীবননিষ্ঠ, আধুনিক শিল্পপ্রকরণ, তীব্র শৈল্পিক সচেতনা, সংযম, দক্ষতা ও পরিমিতিবােধ তার ঔপন্যাসিক প্রতিভার মূল বৈশিষ্ট্য। জীবন, ব্যক্তি এবং সমাজ-পরিবেশের গ্রন্থিসমূহের উন্মােচনে তিনি ছিলেন সতত পরীক্ষা প্রবণ। তার রচনাতে প্রতিফলিত হয়েছে অস্তিত্ববাদের দর্শন। আলােচ্য নিবন্ধে আমরা অস্তিত্ববাদ কী এবং সেয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যে কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা উপস্থাপন করার প্রয়াস পাব।
অস্তিত্ববাদ কীঃ মানুষ যখন নিষ্ক্রিয়তার দর্শন থেকে নয়- কর্মের দর্শন থেকে নিজের অস্তিত্ব বা নিজের কর্মপন্থার সন্ধান করে বা নিজের সিদ্ধান্ত মােতাবেক নিজেকে নির্মাণ করে তখন তাকে অস্তিত্ববাদ বলে এবং ব্যক্তি হয়ে ওঠে অস্তিত্ববাদী। মানুষ অস্তিত্বশীল হয় তার নির্বাচনের স্বাধীনতা ও কর্মের স্বাধীনতার মাধ্যমে। নিজেকে সে যতটুকু উপলব্ধি করতে পারে, ঠিক ততটুকুই সে অস্তিত্বশীল হয়।
অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্যঃ নিম্নে অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলোঃ
ক. আত্মতাঃ শরীরে ও মনে প্রত্যেকটি মানুষ স্বতন্ত্র, একক ও আলাদা। প্রত্যেকের সমস্যা সমাধান করতে হবে নিজস্ব পথে। প্রত্যেক মানুষ ব্যক্তিগত অঙ্গীকারে আবদ্ধ।
খ. কর্মঃ অস্তিত্ববাদ নিষ্ক্রিয়তার দর্শন নয়, কর্মের দর্শন। মানুষ তখনই অস্তিত্ববান হয়ে ওঠে-যখন সে নিজেকে তার সিদ্ধান্ত অনুসারে নির্মাণ করে।
গ. দায়িত্বঃ কর্মপন্থা নির্বাচন করতে গিয়ে দায়িত্ববােধে জড়িত পড়তে হয়। এ দায়িত্ববােধ প্রত্যেকের স্বতন্ত্র ও ব্যক্তিগত। প্রচলিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক প্রথার বাইরেও মানুষ যেতে পারে ঐ ব্যক্তিগত দায়িত্বের কারণে।
ঘ. আত্মমুক্তিঃ নিজের অস্তিত্বকে অর্জন করতে গিয়ে মানুষ নিজের গণ্ডি অতিক্রম করে এবং তার মধ্য দিয়েই অন্য সকলের সঙ্গে যুক্ত হয়। আমাদের ব্যক্তিসত্তার দায়িত্ব থেকে সমগ্র মানবজাতির দায়িত্ব এসে পড়ে।
লাল সালু উপন্যাসে অস্তিত্ববাদঃ ‘লাল সালু উপন্যাসে জমিলা এবং আক্কাস চরিত্রের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ববাদের ক্ষীণছায়াপাত লক্ষ করা যায়। কিন্তু তারপরেও জমিলা এবং আক্কাস ব্যর্থ হয়েছে তাদের অস্তিত্ব রক্ষায়। তারপরেও বলা যায় ‘‘লাল সালু’ উপন্যাসে আমরা অস্তিত্ববাদের প্রথম যে ছায়াপাত দেখি তা পরবর্তী উপন্যাসসমূহে বিস্তৃতভাবে ধরা পড়েছে।
চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসে অস্তিত্ববাদঃ ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসে অস্তিত্ববাদ সুস্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। অস্তিত্ববাদের মূল কথা হচ্ছে, যা সত্য বলে ব্যক্তির চৈতন্য উপলব্ধি করে তার দায় অবশ্যই ব্যক্তিকে বহন করতে হবে। আরেফ আলী নিশ্চিত আরামের চাকরি, স্বচ্ছন্দ অশয় এবং জীবনের নিশ্চয়তা সব কিছু পরিত্যাগ করে সত্য প্রকাশের জন্য পুলিশের শরণাপন্ন হয়। সে আগেই ভেবে রেখেছি হয়তাে তার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করলেও গ্রহণ করবে। না, কিংবা সে চক্রান্তের শিকার হতে পারে; এমনকি তার ফাঁসি পর্যন্ত হতে পারে। তবু সে দায়িত্ব নিয়েই আসল সত্য প্রকাশ করেছে। এভাবেই অস্তিত্ববাদের মূল দিকটি এ উপন্যাসের ঘটনা-বিন্যাসের মাধ্যমে পরিস্ফুট হয়েছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ‘চাঁদের অমাবস্যা’ রচনাকালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ প্যারিসে বসবাস করছিলেন। ফলে, সেখানকার সমকালীন শিল্প সাহিত্যের আন্দোলন এবং আবহভূমির দর্শন সম্পর্কে বিশেষভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোেগ তার ঘটেছিল। এ সময়ে ফরাশি শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গন আধনিক ইমপ্রেশনিজম, সুররিয়ালিজম, একজিসটেন সিয়ালিজমের সংঘাত-সংঘর্ষে ছিল-তরঙ্গিত; কাম্যু (১৯১৩-৬০), কাফকা (১৮৮৩-১৯২৪), সাত্র (১৯০৫-১৯৮০), বেকটের (১৯০৬-) সৃষ্টি বৈচিত্র্যে উজ্জ্বল। কাজেই এসব সৃষ্টি-বৈচিত্র্য ও শিল্প-আন্দোলনের ছাপ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র রচনায় স্বাভাবিকভাবেই পড়েছিল।
প্রসঙ্গত, এ উপন্যাসে আলবের কাম্যুর দর্শন-ভাবনার প্রভাবের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তার দার্শনিক রচনা The Myth of Sisyphus (১৯৪২, ইংরেজি অনুবাদ ১৯৫৫)- এ বলা হয়েছে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে প্রত্যেকটি ব্যক্তির জন্য সচেতনতা অপরিহার্য এবং তার স্বাধীনতার সাহায্যে সেই অবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হবে। সিসিফাসের যে কার্যকলাপ আপাতদষ্টিতে উদ্ভট ও অসংগত বলে মনে হয় শেষ বিচারে তা কিন্তু বীরত্বব্যঞ্জক। কারণ, সে কোনাে মিথ্যা মায়ানমাহে প্রতারিত না হয়ে তার শাস্তিকে স্বেচ্ছায় ও স্বাধীনভাবে মেনে নিয়েছে। আরেফ আলীর ভূমিকাও প্রায় অনুরূপ।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এই উপন্যাসে সার্ত্রীয় অস্তিত্ববাদের প্রভাব পড়েছে। সার্ত্রীয় অস্তিত অনুযায়ী মানুষের নিয়তি ঈশ্বর বা সমাজ কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত নয়। তারও স্বাধীন ইচ্ছার অধিকার রয়েছে এবং সে ইচ্ছা সঙ্গে রয়েছে এক গভীর দায়িত্ববােধ। সার্ত্রের অস্তিত্ববাদের আলােকে দেখলে দেখা যায়, আরেফ আলী মুখশধারী সমাজের বাসিন্দা এবং পরান্নভােগী ও পরাশ্রয়ী হয়েও স্বাধীন ইচ্ছার পথেই পা বাড়িয়েছে। বাঁশঝাড়ের নির্মম ঘটনার সাক্ষী হয়ে সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে এক গভীর দায়িত্ব। বাইরের শক্তির কাছে সে নতি স্বীকার করেনি। নিজের আশ্রয় নিশ্চিত নষ্ট হবে জেনেও নিজের সিদ্ধান্তে সে অটল থেকেছে। সার্ত্রের মতাে সেও বিশ্বাস করে- “মুক্তি দায়িত্বে, কর্ম বৃত্তিতে”- এভাবে আরেফ আলী সক্রিয় কর্ম-বৃত্তিতেই অস্তিত্বময় হয়ে ওঠে। যেমন আরেফ আলীর জীবনভাষ্যঃ
“আসলে তারা মৃত, তাদের জীবনও ধার করা জীবন। জীবনের ব্যাপারে তারা এত প্রতারক বলেই তাদের মনে এত অধীরতা এত শঠতা।”
‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে অস্তিত্ববাদঃ ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে অস্তিত্ববাদের চেতনা আরও মূর্ত হয়ে ওঠে। এ উপন্যাসে অস্তিত্ববাদের প্রায় সব বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। অস্তিত্ববাদের এই বৈশিষ্ট্যগুলাে কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসের নানা জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে। মুহাম্মদ মুস্তফা সাধারণভাবে নির্বিবাদী ও নিষ্ক্রিয় চরিত্রের অধিকারী, তবে তার সকল নিষ্ক্রিয়তার মধ্যেও একটি সচেতন মন রয়েছে। খােদেজার মৃত্যু সংক্রান্ত ব্যাপারে বাড়ির লােকদের মতামত সে বিশ্বাস না করলেও তা বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়। কিন্তু ক্রমশ সে একটি গভীর দায়িত্ববােধের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে ফেলে। তার
বাবা এক সময় কোনাে কিছু না ভেবেই খােদেজার সঙ্গে তার বিয়ে দেবেন বলেছিলেন, সেই খেয়ালি প্রতিশ্রুতিও যে মুস্তফা মন থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি তার প্রমাণ মেলে তার চেতন-অবচেতন মনের দ্বন্দ্বেঃ
“মুহাম্মদ মুস্তফা অনেক কথাই বিনা বাক্যে মেনে নিয়েছে। যে-সব ছেলের পক্ষে অতিশয় দুর্বিষহ…. তবু দুর্বত্ত বাপের প্রতি ছেলের কোনাে দায়িত্ব নেই? … পিতা-পুত্রের মধ্যে দায়িত্বের ব্যাপারে তাদের রক্ত-সম্বন্ধের মতই রহস্যময়, যা সাধারণ বুদ্ধির বহির্গত। কেবল সে দায়িত্বের সম্বন্ধে বিস্মৃত হওয়া কোনাে ছেলের পক্ষে সম্ভব নয়। সে দায়িত্বের কথা ভুলে ছেলে যদি তার জীবন গড়ার চেষ্টা করে এবং গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, তার জীবন কি চোরাবালির উপরেই গড়া হবে না।”
পিতার প্রতিশ্রুতি অস্বীকার করে বিয়ে করতে গিয়ে বার বার ব্যর্থ হয়ে মুহাম্মদ মুস্তফা ভীত হয়ে পড়ে। সে ভাবে, পুত্র হিসেবে পিতার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা তার কর্তব্য। খােদেজার মৃত্যুকে সে আকস্মিক দুর্ঘটনা হিসেবে বার বার উড়িয়ে দিতে চাইলেও ক্রমশ সুতীব্র এক দায়িত্বচেতনায় সে আলােড়িত হতে থাকে। সে ভাবতে থাকে, খোদেজার প্রতি তার কর্তব্য এড়ানােই খােদেজার আত্মহত্যার কারণ; খােদেজার অতৃপ্ত আত্মার কারণেই পার্শ্ববর্তী গঞ্জ-শহর কুমুরডাঙ্গায় অশুভ ছায়া নেমে এসেছে। এ ভাবনা ছাড়াও মুস্তফা এক সময় কুমুরডাঙ্গার সকিনাকে খােদেজা বলে ভুল করে। এসব কারণে ক্রমেই অক্রিয় মুহাম্মদ মুস্তফা সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। অস্তিত্ববাদী নায়কের মতােই আত্মতা, দায়িত্ববােধ, কর্মসচেতনতা ও আত্মমুক্তির প্রচেষ্টায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলে আপাত নির্বিকার ও নির্লিপ্ত মুহাম্মদ মুস্তফা। কুমুরডাঙ্গাবাসীর কল্যাণের জন্য খােদেজার প্রতি তার অজ্ঞানকৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করাকেই সে একমাত্র উপায় বলে মনে করে। সে ভাবে, মৃত খােদেজার আত্মাকে পরিতৃপ্ত করা হলে কুমুরডাঙ্গায় শান্তি নেমে আসবে। উপরন্তু, সে পিতার প্রতি দায়িত্ব অস্বীকারের অপরাধ থেকেও মুক্তি পাবে। এসব চিন্তার বশবর্তী হয়ে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এখানে সার্ত্রীয় অস্তিত্ববাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়।
অন্যদিকে, আত্মকেন্দ্রিক ও সুযােগসন্ধানী উকিল কফিল উদ্দিনের কুমুরডাঙ্গা ত্যাগ করাকালে যে সূক্ষ্ম একটি দায়িত্ববােধের কথা তার মনে উদিত হয়, সেটিকেও অস্তিত্ববাদী চেতনার আভাস হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কুমুরডাঙ্গা ত্যাগ করাকালে “একবার দ্রতসঞ্চারী একখণ্ড মেঘের ছায়ার মতাে একটি কথা দেখা দেয়। সেটি এই যে, অধিবাসীদের প্রতি তার কি কোনাে দায়িত্ব নেই।” মূল কথক ও তবারক ভূইঞার জীবনবাদী বক্তব্যে এবং খতির মিয়ার আশাব্যঞ্জক জীবনবােধ ও কুমুরডাঙ্গায় স্থায়ীভাবে বসবাস করার সিদ্ধান্তেও এই দায়িত্বশীলতার ব্যাপারটি এসেছে।
‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসের আঙ্গিক নির্মাণে অস্তিত্ববাদের এই প্রভাব এ উপন্যাসের শিল্পরূপকে সমৃদ্ধ করেছে। বিশ্বগ্রহী ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সচেতনভাবেই এ উপন্যাসে সাত্রীয় অস্তিত্ববাদের আবহ সৃষ্টি করেছেন।
সুতরাং উপরোক্ত আলােচনা থেকে বলা যায় যে, বাংলা সাহিত্যে অস্তিতবাদের দর্শন সর্বপ্রথম আমরা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কথা সাহিত্যেই পাই। একটি চরিত্রের অস্তিত্ব সংকট এবং সেখান থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টা ব্যাক্তি মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। বাংলা কথাসাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর এই নবতরমতবাদ বা মতাদর্শ আমাদেরকে ভিন্নতর বােধে উপনীত করে, চিন্তার জগৎকে প্রােজ্জ্বল করে।