অথবা, মক্কী যুগে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ তীব্র আঁধার ভেদ করে মানব জাতিকে আলাের দিশা দেখানাের মহান দায়িত্ব নিয়ে মহানবী (স)-এর নবুয়ত জীবনের সূচনা হয়। তার এ মিশনের ভিত্তিভূমি ছিল মক্কা। বিভিন্ন অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে তিনি আল্লাহর একত্ববাদের বাণী পৌঁছে দেন মক্কার অলি-গলিতে। নিম্নে মহানবী (স)-এর মক্কায় ধর্ম প্রচারের সংক্ষিপ্ত বিবরণী তুলে ধরা হলাে-
মক্কায় মহানবী (স)-এর ধর্ম প্রচারের কাহিনীঃ মহান আল্লাহ তার প্রিয় নবীকে ইসলামের শাশ্বত বাণী প্রচারের নির্দেশ দিয়ে বলেন “হে রাসূল! আপনার প্রভুর পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা কিছু নাযিল করা হয়েছে তা প্রচার করুন।” এ আয়াতের নির্দেশে মানবতার মুক্তির দূত রাসূলে করীম (স) সত্য ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন।
ক. গােপনে ইসলাম প্রচারঃ প্রথম অহী অবতীর্ণের কিছুদিন পর উল্লিখিত আয়াতের মাধ্যমে মহানবী (স) আল্লাহর দ্বীন এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের নির্দেশপ্রাপ্ত হন। প্রথমে তিনি প্রতিকূল পরিবেশের কারণে তিন বছরকাল গােপনে আত্মীয়-স্বজন ও যুবকদের নিকট ইসলামের আদর্শ উপস্থাপন করেন। সাফা পর্বতে অবস্থিত হযরত আরকাম মাখযুমীর গৃহ ছিল তখনকার ইসলামী দাওয়াতের গোপন কেন্দ্র।
গােপনে প্রচারের ফলাফলঃ গােপনে প্রচারের ফলে ইসলাম সম্বন্ধে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ জন্মে। যারা তার অনুপম চরিত্র মাধুর্য হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন, তারা বিনা দ্বিধায় তার প্রতি সমর্থন জানান। এদের মধ্যে ছিলেন সহধর্মিনী বিবি খাদিজা, চাচাত ভাই আলী, মুক্তিপ্রাপ্ত দাস যায়েদ ইবনে হারেসা এবং আবু বকর (রা)। অতঃপর আবু বকর (রা)-এর প্রচেষ্টায় ওসমান, যােবায়ের, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস ও তালহা (রা)সহ প্রায় ৪০ জন ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়।
প্রতিক্রিয়াঃ প্রথম পর্যায়ের এ দাওয়াত ছিল একান্ত আপনজনদের মধ্যে সীমিত। তাই এর তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল না।
খ. প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারঃ নবুয়তের তৃতীয় বছরের শেষভাগে মহানবী (স) প্রকাশ্যে দাওয়াতী কাজ আরম্ভ করেন। ইতােমধ্যে আল্লাহর নিকট নির্দেশ এলাে- “আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করে দিন।” এবং “আপনাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে জনগণকে জানিয়ে দিন এবং এ ব্যাপারে মুশরিকদের পরােয়া করবেন না।” এরপর মুহাম্মদ (স) প্রকাশ্যে দাওয়াত দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
প্রকাশ্যে প্রচারের বিভিন্ন প্রক্রিয়াঃ মহানবী (স) মক্কায় প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের জন্য যেসব প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছিলেন নিম্নে তা উপস্থাপন করা হলাে-
১. সভা আহ্বানঃ প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের জন্য অহী প্রাপ্তির পর মহানবী (স) সাফা পর্বতের পাদদেশে মক্কাবাসীদের এক সভা আহ্বান করেন। সে সভায় তিনি সকলের সম্মুখে সুস্পষ্ট কণ্ঠে ঘােষণা দেন, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, তিনি ব্যতীত কোনাে উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (স) তার একমাত্র প্রেরিত রাসূল (স)। ঐতিহাসিক জোশেফ হেল বলেন, এতে আবু জাহল মহানবী (স)-কে ভৎসনা করে, আবু লাহাব মহানবীর দিকে পাথর বর্ষণ করে নির্যাতনের সূচনা করে।
২. ভােজে দাওয়াতঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, মহানবী (স) নিজ বাড়িতে কুরাইশ নেতাদের আমন্ত্রণ জানান, আপ্যায়ন শেষে তিনি তাদের ইসলামের দাওয়াত প্রদান করলে আবু লাহাবসহ অনেকেই হট্টগােল করে মজলিস ত্যাগ করে। এতেও তেমন কোনাে উপকার হয়নি।
৩. লােক সমাগমস্থলে দাওয়াতঃ ওকায মেলাসহ বড় বড় জনসমাবেশে মহানবী (স) জনগণকে অভিনব কৌশলে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানাতে শুরু করেন। এ পর্যায়ে সমাজের নিম্ন ও নির্যাতিত লােকেরা ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। তবে আবু জাহলসহ কুরাইশ নেতারা মহানবীকে যাদুকর, গণক, কবি ইত্যাদি বলে তিরস্কার করে।
৪. হজ্জের মৌসুমে দাওয়াতঃ আরবের বাইরের লােকজন যখন হজ্জ করতে মক্কায় আসত, তখন মহানবী (স) তাবুতে তাবুতে গিয়ে তাদের নিকট ইসলামের বাণী পেশ করতেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। যার ফলে বহির্বিশ্বেও ইসলাম প্রসার লাভ করেছে।
ইসলাম প্রচারে কুরাইশদের প্রতিবন্ধকতাঃ নবুয়তের প্রথম বৎসর কোনাে প্রতিবন্ধকতা না থাকলেও পরবর্তীতে উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় প্রকাশ্যে দাওয়াতি কাজ শুরু করলে মক্কাবাসীদের শত্রুতা চরমভাবে প্রকাশ পেল। প্রতিবন্ধকতার ধরন নিম্নরূপ-
১. কুৎসা রটনাঃ রাসূলুল্লাহ (স)-কে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করতে দেখে মুশরিকরা তার বিরুদ্ধে মিথ্যা বানােয়াট কুৎসা রটনা করতে থাকে। তারা মহানবীকে পাগল, যাদুকর, কবি ইত্যাদি জঘন্য ভাষায় গালি দিয়ে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করতে থাকে। আল্লাহ তায়ালা তাদের ভিত্তিহীন কুৎসার প্রত্যুত্তরে আয়াত নাযিল করেন وما صاحبكم بمجنون
২. প্রলােভনঃ মহানবী (স) যাতে ইসলাম প্রচার থেকে বিরত থাকেন সে জন্য কুরাইশরা মহানবী (স)-কে বিভিন্ন প্রলােভন দেখায়। এক পর্যায়ে কাফেররা ওতবা ইবনে রাবয়াকে বিভিন্ন লােভনীয় প্রস্তাবসহ রাসূল (স)-এর নিকট প্রেরণ করে। সে তাকে আরবের নেতৃত্ব, সুন্দরী নারী এবং আরবের শ্রেষ্ঠ ধনী বানিয়ে দেয়ার আশ্বাস প্রদান করে, কিন্তু এতে কোনাে ফলােদয় হয়নি।
৩. হুমকিঃ ইসলাম প্রচারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সকল প্রকার পন্থা ব্যর্থ হলে কুরাইশ নেতারা মুহাম্মদ (স) ও তার অনুসারীদের হুমকি দেয়। ঐতিহাসিক খােদা বক্স বলেন, কুরাইশরা আবু তালেবের মাধ্যমে চাপ প্রয়ােগ করে মহানবীকে ইসলাম প্রচার থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
৪. নও মুসলিমদের ওপর অত্যাচারঃ কাফের বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হলেন নবদীক্ষিত মুসলমানরা হযরত খাব্বাব (রা)-এর ওপর অমানুষিক নির্যাতন এবং বেলাল (রা)-কে ভরদুপুরে উত্তপ্ত মরুভূমির ওপর বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখা হতাে। আম্মার (রা)-কে সহ্য করতে হয় আঘাতের পর আঘাত। ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, নবীর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে কুরাইশরা মুসলমানদের ওপর নানাবিধ অত্যাচার নিপীড়ন শুরু করে দেয়।
৫. অবরুদ্ধঃ কুরাইশ নেতারা অত্যাচারের মাত্রা চরমে পৌছিয়ে একযােগে মুসলমানদের বয়কট করে এবং শিয়াবে আবু তালেবে মহানবী (স)-কে তার পরিবার ও বংশের লােকজন এবং সঙ্গীসাথীদের তিন বছর বন্দি করে রাখে।
প্রতিবন্ধকতার কারণঃ রাসূল (স)-এর ইসলাম প্রচারে মক্কার কুরাইশদের বিরােধিতার পশ্চাতে ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ নিহিত ছিল। কারণ ইসলাম কুরাইশদের ঘৃণিত ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কার্যাবলি অনুমােদন করতে পারেনি বলেই ইসলাম তাদের ক্রোধানলে পতিত হয়। ঐতিহাসিক জোসেফ হেল বলেছেন, মক্কার শাসকগােষ্ঠী ইসলাম ধর্মের শিক্ষার প্রতি তত বিরূপ ছিল না, যতখানি তারা বিরূপ ছিল ইসলামের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লবের প্রতি।
দ্বীন প্রচারে অন্যান্য উপায়ঃ কুরাইশদের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মােকাবেলায় রাসূল (স) ইসলাম প্রচারে নিম্নেল্লিখিত পন্থা অবলম্বন করেন। যেমনঃ
১. আবিসিনিয়ায় হিজরতঃ কাফেরদের চরম ক্রমবর্ধমান বাধা ও নির্যাতনের প্রেক্ষিতে মক্কার বাইরে ইসলাম সম্প্রসারণের লক্ষে নবুয়তের পঞ্চম বৎসরে মুসলমানদের একটি দলকে রাসূল (স) আবিসিনিয়ায় পাঠান। আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাসি তাদেরকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। এর ফলে কুরাইশরা মুসলমানদের ওপর ভীষণ অত্যাচার আরম্ভ করে।
২. তায়েফে গমনঃ কুরাইশরা কাফেরদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পালিত পুত্র যায়েদকে নিয়ে মহানবী (স) তায়েফে গমন করেন। তিনি দশদিন যাবত ইসলামের প্রচার করলেও কোনাে আশাপ্রদ ফল হলাে না; বরং বিপথগামী তায়েফবাসীরা মহানবীকে নির্মমভাবে অত্যাচার ও পাথর মেরে রক্তাক্ত করে তাড়িয়ে দেয়।
৩. নেতৃস্থানীয় লােকদের ইসলাম গ্রহণঃ মহানবী (স)-এর নবুয়তের ষষ্ঠ বর্ষে এক চরম মুহর্তে হযরত ওমর এবং হামযা (রা)-সহ আরাে অনেক নেতৃস্থানীয় লােক ইসলাম গ্রহণ করেন। ফলে ইসলামের বিজয় সাফল্য চতুর্দিকে ছড়াতে থাকে।
৪. মিরাজে গমনঃ চাচার মৃত্যু, তায়েফের নির্যাতন, সহধর্মিনীর ইহধাম ত্যাগ রাসূল (স)-কে ব্যথাতুর করে ফেলল। এ মুহূর্তে ৬২০ খ্রিস্টাব্দে নবুয়তের দশম বর্ষের ২৭ রজব সােমবার মহানবী (স) আল্লাহ তায়ালার বিশেষ আমন্ত্রণে মিরাজে গমন করেন। এ সময় তিনি দৈনিক পাঁচ বার নামায পড়ার আদেশ প্রাপ্ত হন।
৫. আকাবার প্রথম ও দ্বিতীয় শপথঃ ৬২১ ও ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হজ্জ মৌসুমে যথাক্রমে ১২ ও ৭৫ জন মদিনাবাসী আকাবা উপত্যকায় হযরতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাদের দেশে তাকে আক্রমণ জানালেন। ইসলামের ইতিহাসে একে বায়তুল আকাবা বলা হয়। এ শপথ দু’বার অনুষ্ঠিত হওয়ায় ইতিহাসে এটাকে আকাবার প্রথম ও দ্বিতীয় শপথ বলা হয়। ইসলামের সম্প্রসারণে এর তাৎপর্য ব্যাপকভাবে স্বীকৃত।
৬. মদিনায় হিজরতঃ অবশেষে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ ইসলামের দাওয়াত প্রদানের অজুহাতে মহানবী (স)-কে হত্যার সর্বনাশা ষড়যন্ত্র করে। কাফেরদের এ হীন ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে এবং মদিনায় দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার অনুকূল সম্ভাবনা থাকায় মহানবী (স) স্বীয় ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, উদার মানসিকতা দিয়ে নবুয়তের ত্রয়ােদশ বর্ষে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় হিজরতের মাধ্যমে ইসলামকে নব পর্যায়ে উন্নীত করেন।
উপসংহারঃ অসহনীয় নির্যাতন, অত্যাচার ও জুলুম নিপীড়ন ভােগ করে নবীকুল শিরােমণি হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কার বর্বর লােকদের ইসলামের রঙে রঞ্জিত করতে সক্ষম হন। তাই ঐতিহাসিক জোশেফ হেল বলেন- Hijrat is the greatest furning point in the history of Islam.