অথবা, মহানবী (স)-এর মাদানী জীবনের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা কর।
উপস্থাপনাঃ নবুয়তের তেইশ বছরের শেষের দশ বছর মহানবী (স) মদিনায় অতিবাহিত করেন এবং তথায় একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। নবগঠিত মদিনার এ রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক ছিলেন মহানবী (স)। মূলত মাদানী জীবনে মহানবী (স) ইকামাতে দ্বীনের সংগ্রামে সর্বশক্তি নিয়ােগ করেন। এ সময়কার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন- This wgs the first gftempt in the history of Arabia at a social organisation with religion rather than blood as its basis.
মহানবী (স)-এর মাদানী জীবনঃ
প্রাথমিক কার্যাবলিঃ
১. ইয়াসরিবের নতুন নামকরণঃ শুধু স্বীয় ধর্ম বিশ্বাসের জন্যই মহানবী (স) এবং তার মক্কাবাসী সাহাবায়ে কেরাম তাদের মাতৃভূমি মক্কা পরিত্যাগ করে ইয়াসরিবে আগমন করেন। তার এ আগমন স্মরণীয় করে রাখার জন্য ইয়াসরিববাসী তাদের নগরীর পুরাতন নাম পরিবর্তন করে মদিনাতুন্নবী বা সংক্ষেপে মদিনা নামকরণ করেন।
২. মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠাঃ মদিনায় হিজরতের পরপরই মুহাম্মদ (স) সেখানে মুসলমানদেরকে উপাসনা এবং মিলনকেন্দ্র হিসেবে সাহল-সহাইল নামে অনাথ ভ্রাতৃদ্বয়ের নিকট হতে এক খণ্ড জমি ক্রয় করে তদস্থলে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামের ইতিহাসে এটাই প্রথম মসজিদ, যা মসজিদে নববী নামে পরিচিত।
৩, মুহাজির ও আনসার ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠাঃ মহানবী (স) মদিনায় এসে মুসলমানগণ পরস্পরই ভাই একথা ঘােষণা করে প্রথমে জাতি গঠনের অংশ হিসেবে আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাততু স্থাপন করেন। আনসারগণ মুহাজিরদের সার্বিক সাহায্য ও পুনর্বাসনে আন্তরিক সহযােগিতা দান করেন।
৪. সামাজিক বিধানাবলি জারিঃ মহানবী (স) হিজরতের পর আল্লাহর নির্দেশে আল কুরআনের মাধ্যমে অনেক সামাজিক বিধান প্রবর্তন করেন। যেমন- বিয়ে, তালাক, মিরাসী আইন, সুদ ও জুয়া নিষিদ্ধকরণ, লেনদেন এবং হালাল-হারামের বিধান মাদানী জীবনেই কার্যকর করা হয়।
৫ অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাঃ রাসুল (স) মদিনার বিভিন্ন গােত্রের মধ্যে দ্বন্দ সংঘাতের অবসান ঘটান। দীর্ঘ দিনব্যাপী কলহে লিপ্ত আউস ও খাজরাজ গােত্রের লড়াই বন্ধ করে রাসূল (স) তাদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাততবােধ সষ্টি করেন। ঐতিহাসির্ক পিকে হিট্টি বলেন- This was the first attempt in the history of Arabia as a social organisation with religion rather than blood as its basis.
৬. নামায ও আযানের প্রবর্তনঃ মদিনায় আগমন করে রাসূল (স) অনেক বিচার বিবেচনার পর হযরত ওমরের পরামর্শে নামাযে আহ্বানের উদ্দেশ্যে আযানের প্রবর্তন করেন। এছাড়া ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধানাবলি যেমন রােযা, ঈদের নামায ও সদকাতুল ফিতরের বিধান ইত্যাদি মাদানী জীবনেই প্রবর্তিত হয়।
মদিনার সনদ, যুদ্ধ ও শান্তিনীতিঃ
১. ইসলামী রাষ্ট্র গঠনঃ হিজরত করে মহানবী (স) মদিনায় ইসলাম প্রচার ও দীর্ঘ দিনের কাঙ্ক্ষিত ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রণয়ন ও তা বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করেন।
২. মদিনা সনদ প্রণয়নঃ মহানবী (স) মদিনার ঐক্য ও সংহতির কথা চিন্তা করে জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল সম্প্রদায়ের লােকদের সহযােগিতা ও সমর্থন নিয়ে ৪৭টি ধারার এক লিখিত সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করেন। এ সন্ধিপত্রকে ইতিহাসে মদিন। সনদ বা Charter of moding বলা হয়।
৩. বদরের যুদ্ধঃ মাওলানা মুহাম্মদ আলী বলেন, মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংবাদে মক্কার কাফেররা নবগঠিত মদিনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করে। ফলে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ মােতাবেক দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমযান শুক্রবার বদর প্রান্তরে মুসলমানদের সাথে কাফেরদের এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে। ইতিহাসে এটাই বদরের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে মুসলমানগণ আল্লাহর সাহায্যে বিজয় লাভ করেন।
৪. উহুদের যুদ্ধঃ ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, বদরের যুদ্ধের প্রতিশােধ নেয়ার জন্য মক্কার কুরাইশরা তিন হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। ফলে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে উহুদ নামক স্থানে উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধ বাধে। এ যুদ্ধে মুসলমানগণ সাময়িক কিছুটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেও কাফেররা তেমন লাভবান হতে পারেনি।
৫. খন্দকের যুদ্ধঃ ইসলামের ক্রমপ্রসারে ঈর্ষান্বিত হয়ে এবং মদিনায় নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র ধ্বংস করার লক্ষ্যে মক্কার কাফের, মদিনার ইহুদি, আরব বেদুইন এবং মুনাফেকদের ১০ হাজার সৈন্যের সম্মিলিত বাহিনী ৬২৭ খ্রিস্টাব্দ মােতাবেক পঞ্চম হিজরীতে মদিনা আক্রমণ করে, কিন্তু মুসলমানদের রণকৌশলের সামনে তারা সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হয়। মহানবী (স) মদিনার তিন দিকে পরিখা খনন করে শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করেন।
৬. হােদায়বিয়ার সন্ধিঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, ৬২৮ খ্রিস্টাব্দ মােতাবেক ষষ্ঠ হিজরীতে মহানবী (স) ১৪০০ সাহাবী নিয়ে পবিত্র কাবা ঘর যেয়ারতের উদ্দেশে মক্কাভিমুখে রওয়ানা হন, কিন্তু কুরাইশদের যুদ্ধ প্রস্তুতির সংবাদে মহানবী (স) হােদায়বিয়া নামক স্থানে অবস্থান নেন, এ স্থানেই হােদায়বিয়ার ঐতিহাসিক সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
৭. খায়বার অভিযানঃ খায়বারের অভিশপ্ত ইহুদিদের সমুচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য মহানবী (স) সপ্তম হিজরীর মহররম মাসে খায়বারে অভিযান চালিয়ে তা দখল করে নেন।
৮. মুতার যুদ্ধঃ অষ্টম হিজরীতে রােমান শাসনকর্তার প্রেরিত বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে রাসূল (স) তিন হাজার সৈন্যের একটি সুসজ্জিত বাহিনী প্রেরণ করেন। এ যুদ্ধে পর পর তিন জন সেনাপতি যথামে হযরত যায়েদ, জাফর ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা শাহাদাত বরণ করার পর বীর সেনানী খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (র) মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে শত্রুদের সম্পূর্ণরূপে পর্দস্ত করেন।
৯. মক্কা বিজয়ঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, মক্কার কাফেররা হােদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করলে মহানবী (স) ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে দশ হাজার মুজাহিদ নিয়ে মক্কা বিজয়ে অগ্রসর হন। পথিমধ্যে সামান্য বাধা সৃষ্টি হলেও পরবর্তীতে খােদাদ্রোহীরা ময়দান ছেড়ে পলায়ন করে। ফলে মহানবী (স) বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন।
১০. হােনাইনের যুদ্ধঃ মক্কা বিজয়ের ফলে আরব উপদ্বীপের মানুষ যখন দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিতে শুরু করে, ঠিক তখনি হােনাইনের হাওয়াযিন ও সাকীফ গােত্র মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করে। মহানবী (স) ১২ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে তাদের পরাজিত করেন।
১১. তায়েফ বিজয়ঃ হোনাইনের যুদ্ধে পরাজিতদের একাংশ তায়েফে একত্রিত হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশৃংখলা ও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলে মহানবী (স) হযরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুসলিম সৈন্য দল তায়েফে পাঠালে মুসলিম বাহিনী তায়েফ আক্রমণ করে বিজয় অর্জন করেন।
১২. তাবুক অভিযানঃ রােমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস মদিনা রাষ্ট্রের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করলে মহানবী (স) ৪০ হাজার মুজাহিদ নিয়ে তাবুক নামক স্থানে উপনীত হন। মুসলমানদের এ বিশাল আয়ােজন দেখে রােমানরা শংকিত হয়ে পিছু হটে যায়। মহানবী (স) কিছুকাল তাবুকে অবস্থান করে মদিনায় ফিরে আসেন।
১৩. বিদায় হজ্জঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ মােতাবেক দশম হিজরী সনে মহানবী (স) বহুসংখ্যক মুসলমানকে সাথে নিয়ে বিদায় হজ্জ সম্পাদনের জন্য মক্কায় যাত্রা করেন। মক্কায় আরাফাত ময়দানে সমবেত জনতার উদ্দেশে তিনি এক হৃদয়গ্রাহী ভাষণ প্রদান করেন, যা ইতিহাসে বিদায় হজ্জের ভাষণ নামে পরিচিত।
১৪. ইন্তেকালঃ বিশ্ববাসীকে পরিপূর্ণ একটি ইসলামী রাষ্ট্র উপহার দিয়ে একাদশ হিজরীর ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার অপরাহে মহানবী (স)-এর পবিত্র আত্মা এ বিশ্ব ভুবন ছেড়ে অনন্তের পথে যাত্রা করে।
উপসংহারঃ রাসূল (স)-এর মদিনা জীবনেই ইসলামের অধিকাংশ বিধি বিধান নাযিল হয়। মূলত মদিনা জীবনেই তিনি আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় বরণীয় হয়ে আছেন। তাই Encyclopedia of Britannica গ্রন্থে বলা হয়েছে, Of all the religious personalities of the world Mohammad was the most successful.