অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে সম্পর্ক আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের সকল সামাজিক বিজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞান থাকা আবশ্যক। বর্তমান বিশ্বরাজনীতির গতি-প্রকৃতি, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোেধ, আইনের শাসন, জবাবদিহিতা, রাষ্টতত্ত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান লাভ প্রয়ােজন। এ কারণে আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করতে হয়। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করতে গেলেই দর্শনের তত্ত্ব সামনে চলে আসে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়। নিম্নে তা আলােচনা করা হলাে-
(১) চিন্তাবিদদের ব্যাখ্যাঃ প্লেটো রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে কোন পার্থক্য স্বীকার করেননি। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে দর্শনের অন্তর্ভুক্ত করেন। এরিস্টটল নীতিশাস্ত্রকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে পৃথক করে রাষ্টতত্ত্বের ওপর গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনের ঘনিষ্ঠতার দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন।
(২) মধ্যযুগের দর্শনঃ মধ্যযুগে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মের মধ্যে কোনাে পার্থক্য স্বীকৃত হয়নি। ষােড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে ম্যাকিয়াভেলি তার বিখ্যাত The Prince গ্রন্থে রাজনৈতিক মতবাদ সম্পর্কে যা লিখেছেন তাতে দর্শন ও রাষ্টতত্ত্বের একাধিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
(৩) রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনের প্রকৃতিগত সম্পর্কঃ মানুষ ও মানব মনের উৎকর্ষ সাধনের নীতি মূলত সমাজের প্রতি উপচিকীর্ষামূলক নীতি যা দর্শনশাস্ত্রের উপজীব্য। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষের বাহ্যিক আচরণের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং মানুষের আচরণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে রাজনীতি বিশ্লেষণের একটি পদ্ধতি অবলম্বন করে। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শন সম্পর্কযুক্ত।
(৪) রাষ্ট্রবিজ্ঞান নাগরিক জীবন আর দর্শন ব্যক্তিজীবন নিয়ে আলােচনা করেঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সুষ্ঠু নাগরিক জীবন, উন্নত ও সৎ নাগরিকতা সম্পর্কে আলােচনা করে। আর দর্শন আলােচনা করে মানুষের ব্যক্তিজীবনের সততা ও ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে। তাই Plato তার The Republic গ্রন্থে দার্শনিক রাজার কথা বলেছেন।
(৫) দর্শন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পথপ্রদর্শক ও দর্শন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পথপ্রদর্শকঃ রাষ্টবিজ্ঞানের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে দর্শনের প্রভাব খুবই বেশি। গ্রাহাম ওয়ালেসের মতে, সেই শাসনব্যবস্থা স্থিতিশীল হতে পারে যা দর্শনের ভিত্তিতে শাসিতের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন ঘটায়। গ, ছাতা , পেন
(৬) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভিত্তি রাজনৈতিক দর্শনঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান মূলত রাজনৈতিক দর্শন। রাজনৈতিক দর্শনের প্রভাব ছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনা অর্থহীন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান গড়ে ওঠেছে রাজনৈতিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে। এজন্য দর্শনকে Mother of all subject বলা হয়।
(৭) কার্যাবলি অভিন্নঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শন উভয়ের কাজ প্রায় এক। রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষের চিন্তাধারা, রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। আর দর্শন মূলত মানুষের অন্তর্নিহিত চিন্তাধারা ও কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে উভয়ের উদ্দেশ্য ও কাজ এক।
(৮) পারস্পরিক নির্ভরশীলতাঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা লক্ষ্য করার মতাে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে রাজনৈতিক তত্ত্বসম্পর্কিত গবেষণা ও বিশ্লেষণের জন্য যেমন দর্শনের আশ্রয় নিতে হয়, তেমনি দর্শনকেও রাজনৈতিক দর্শন পর্যালােচনা ও বিশ্লেষণের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আশ্রয় নিতে হয়।
(৯) একে অপরের কাছে ঋণীঃ দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ একে অপরের কাছে ঋণী। কারণ একের গবেষণা অন্যের সাহায্য ছাড়া কোনােভাবেই সম্ভবপর নয়।
উভয়ের মধ্যে পার্থক্যঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্তেও উভয়ের মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। নিম্নে সেগুলাে উল্লেখ করা হলাে-
(১) রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বাস্তববাদী, রাষ্ট্রের বাস্তব ঘটনাবলিই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্থান পায়। কিন্তু দার্শনিকগণ অনেক ক্ষেত্রে কল্পনা বা ধারণার আশ্রয় নেন।
(২) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনা রাষ্ট্র ও নাগরিকের রাজনৈতিক জীবনসংক্রান্ত বিষয়াবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু দর্শন রাষ্ট্র ও মানুষের কর্মকাণ্ডের বাইরে অনেক কিছু আলােচনা করে।
(৩) রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনায় ধর্মীয় বিষয়াবলি তেমন গুরুত্ব পায় না। কিন্তু ধর্মসংক্রান্ত বিষয়াবলি দর্শনের আলােচনায় গুরুত্ব সহকারে স্থান প্রায়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। একটি ছাড়া অপরটির কথা চিন্তা করা যায় না। মূলত দর্শনই রাজনীতিবিজ্ঞানের ভিত্তি। সব রাষ্ট্রদর্শনই রাষ্ট্রতত্ত্ব হিসাবে স্বীকৃত। তবে দুটির মধ্যে পাথর্ক্য নেই এমন কথা বলা যায় না।