অথবা, বাংলাদেশের উপজাতিদের সমাজের পরিবর্তনশীলতা কীরূপ আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ পৃথিবীর প্রত্যেক সমাজই প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সমাজ এর বাইরে নয়। এ পরিবর্তনের হাওয়া বাংলাদেশের উপজাতি সমাজেও পড়েছে ব্যাপকভাবে। তবে উপজাতি সমাজের পরিবর্তন বাংলাদেশের অন্যান্য সমাজের পরিবর্তনের গতির তুলনায় অনেক মন্থর।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উপজাতীয় সমাজের পরিবর্তনশীলতাঃ বাংলাদেশের উপজাতি সমাজ বিভিন্ন কারণে পরিবর্তিত হচ্ছে। নিম্নে সেসব কারণ সংক্ষেপে আলােচনা করা হলাে-
(ক) প্রশাসনিক কাঠামাে বা রাজনীতিতে পরিবর্তনঃ বাংলাদেশের প্রায় সকল উপজাতি তাদের ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্বের পরিবর্তে কেন্দ্রিয় শাসনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ফলে তাদের প্রশাসনিক কাঠামাে এবং রাজনীতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বর্তমানে প্রায় সকল উপজাতি কেন্দ্রিয় সরকারের শাসনাধীন। গারাে উপজাতি সমাজে সরকারের স্থানীয় প্রশাসন অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ গড়ে ওঠেছে। ফলে ঐতিহ্যবাহী গারাে সমাজে গারাে গ্রাম প্রধানের গুরুত্ব কমে গিয়েছে।
(খ) শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবর্তনঃ শিক্ষার প্রসার বর্তমানে উপজাতিদের দ্বার পর্যন্ত পৌঁছেছে। সকল উপজাতিই আগের তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষিত। এদের মধ্যে চাকমাদের অবস্থান সবার শীর্ষে। গ্রাম ও শহরের স্কুলগুলােতে চাকমা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মনিপুরীরা লেখাপড়া শিখে উন্নত জীবনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চাকমাদের মধ্যে ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবি, সরকারি-বেসকারি অফিসে চাকরীজীবিদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
(গ) জমির মালিকানায় পরিবর্তনঃ আগে চাকমা সমাজে সম্পত্তিতে ব্যক্তিমালিকানা ছিল না। আর চাষাবাদ ছিল ইচ্ছাধীন। ধীরে ধীরে চাকমারা আধুনিক হালচাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে। পাকিস্তান আমলে সমতল ভূমিতে; পরে উদ্যান চাষের জন্য চাকমাদের ভূমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়।
(ঘ) উৎপাদন কৌশলে পরিবর্তনঃ আগে উপজাতিদের মধ্যে কেবল জুম চাষ বিদ্যমান ছিল, কিন্তু বর্তমানে তারা আধুনিক কৃষি উৎপাদনে মনােনিবেশ করে। এছাড়া কেউ কেউ ফলের চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে ।
(ঙ) লেনদেনে পরিবর্তনঃ মুঘল যুগে চাকমা অর্থনীতিতে মুদ্রার প্রচলন ছিল না বলে অনেকের ধারণা। ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকেও চাকমারা খাজনা দিতাে তুলার সাহায্যে, তবে ব্রিটিশ শাসনের এক পর্যায়ে চাকমা সমাজে মুদ্রার প্রচলন হয় এবং অর্থনীতি বিকাশ লাভ করে। ফলে লেনদেনের বিস্তৃতি ঘটে।
(চ) বিবাহ ব্যবস্থায় পরিবর্তনঃ সকল উপজাতিদের মধ্যে বিবাহ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসেনি। কেবল গারােদের বিবাহরীতিতে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহাসিকভাবে গারােদের মধ্যে মাতৃবাস রীতিতে স্ত্রীর বাবা-মার বাড়িতে থাকতাে তবে বর্তমানে অনেকেই পিতবাসে অভ্যস্ত হচ্ছে। বাঙ্গালিদের প্রভাবে গারােদের মধ্যে সীমিত পরিসরে যৌতুক প্রথা লক্ষ্য করা যায়।
(ছ) ধর্মীয় পরিবর্তনঃ বর্তমানে উপজাতিদের মধ্যে ধর্মীয় দিক থেকেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। গারােদের অধিকাংশই কোনাে কোনাে মতে ৯০% তাদের ঐতিহ্যবাহী ধর্ম ছেড়ে খ্রিষ্ট্রধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। আর চাকমারা তাদের সর্বপ্রাণবাদ ধারণা ছেড়ে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী বলে পরিচয় দিচ্ছে।
(জ) ভাষা ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তনঃ বর্তমান চাকমা ভাষায় প্রায় ৮০% বাংলা শব্দ ঢুকে গেছে। তাই বলা যায়, উপজাতি সমাজ পরিবর্তনে ভাষা ও সংস্কৃতিতেও প্রভাব ফেলছে। প্রায় সকল উপজাতিদের নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতির ওপর বাঙ্গালিদের প্রভাব পড়ছে। এটা হচ্ছে সাহচর্য ও শিক্ষাবিস্তারের ফসল।
(ঝ) অর্থনীতিতে পরিবর্তনঃ বর্তমান সময়ে উপজাতিদের মধ্যে অর্থনৈতিক পরিবর্তনশীলতা লক্ষণীয়। আগে উপজাতিরা পাহাড়কেন্দ্রিক জুমচাষের ওপর নির্ভর ছিল। বর্তমানে তাদের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যােগ হয়েছে । ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টতা ছাড়াও উদ্যান চাষ, ফলের বাগান এসবের প্রতি অনেকে ঝুঁকেছে। কোনাে কোনাে উপজাতিতাে প্রায় বাঙ্গালিদের মতাে জীবনযাপন করছে।
(ঞ) খাদ্যাভাসে পরিবর্তনঃ আধুনিক যুগের ছোঁয়া উপজাতিদের খাদ্যাভাসেও প্রভাব ফেলেছে। উপজাতিরা বর্তমানে তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিত্যাগ করে আধুনিক খাবার গ্রহণের দিকে মনােযােগ দিচ্ছে।
(ট) বাসগৃহের পরিবর্তনঃ উপজাতিদের বাসগৃহে বাঙ্গালিদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বিশেষ করে চাকমাদের ঘর-বাড়ির ধরন, তৈজসপত্রে, আসবাবপত্রে বাঙ্গালিদের প্রভাব সুস্পষ্ট। চাকমারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পাহাড় বসবাস ছেড়ে আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে শহরবাসী হচ্ছে।
(ঠ) বিশ্বাস ধারণায় পরিবর্তনঃ পূর্বে উপজাতিদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কার প্রথা বিদ্যমান ছিল। কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় উপজাতিরা সেসব থেকে একেবারে সরে এসেছে। আধুনিক অন্যান্য সভ্য সমাজের মতােই জীবনযাপন করছে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, উপযুক্ত আলােচনা সাপেক্ষে এ কথা বলা যায় যে, বর্তমান উপজাতীয় সমাজ অন্যান্য সমাজের ন্যায় আধুনিক। তবে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে এখনও তাদের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী প্রথা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাদের মধ্যকার পরিবর্তনশীলতা এত দ্রুত যে অচিরেই সেগুলাের বিলুপ্তি ঘটবে।