অথবা, সাম্য কত প্রকার ও কী কী? আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্য সম্পর্কিত আলােচনা সর্বকালের একটি বহুল আলােচিত বিষয়। গ্রিক দার্শনিকগণ থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ পর্যন্ত সকলেই সাম্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সাম্য ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে যুগে যুগে মানুষ রক্তক্ষয়ী বিপ্লবে সামিল হয়েছে। সাম্য ও স্বাধীনতার জন্য মানুষের আত্মত্যাগের নজির পৃথিবীতে অসংখ্য।
সাম্যের প্রকারভেদ/শ্রেণীবিভাগঃ সাম্যের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ছয় প্রকার সাম্যের কথা বলেছেন। যথা- (১) আইনগত সাম্য, (২) নাগরিক সাম্য, (৩) রাজনৈতিক সাম্য, (৪) অর্থনৈতিক সাম্য, (৫) সামাজিক সাম্য, (৬) প্রকৃতিগত সাম্য, (৭) শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সাম্য। নিম্নে তা আলােচনা করা হলাে-
(১) আইনগত সাম্য (Legal equality): রাষ্ট্রীয় আইনের দৃষ্টিতে মানুষ যে সমানাধিকার ভােগ করে তাই আইনগত সাম্য বলে পরিগণিত হয়। আইনগত সাম্যের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। রাষ্ট্রীয় আইন যদি সকলকে সমান চোখে দেখে, তাহলে আইনগত সাম্য বিদ্যমান আছে বলে মনে করা হয়। আইনগত সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়ােজন সামাজিক বৈষম্যের অপসারণ।
(২) নাগরিক সাম্য (Civil equality): সমাজের সকল সদস্য যখন সমানভাবে সামাজিক অধিকারসমূহ ভােগ করার সুযােগ লাভ করে তখন ব্যক্তিগত বা নাগরিক সাম্য বিদ্যমান আছে বলে মনে করা হয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এ সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এক্ষেত্রে ভেদাভেদ কাম্য নয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোন নাগরিকের প্রতি কোনাে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না।
(৩) রাজনৈতিক সাম্য (Political equality): রাজনৈতিক সাম্যের অর্থ হচ্ছে সকল নাগরিকের সমান রাজনৈতিক অধিকার ভােগের সুযােগ-সুবিধার উপস্থিতি ও সকল নাগরিক যাতে রাষ্ট্রীয় কার্যে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে তা নিশ্চিত করা। যেমন- প্রত্যেক নাগরিকের ভােটদানের অধিকার, নির্বাচিত হবার অধিকার, সরকারি চাকরি লাভের অধিকার প্রভৃতি ক্ষেত্রে সমান সুযােগ থাকা বাঞ্ছনীয়।
(৪) অর্থনৈতিক সাম্য (Economic equality): আধুনিককালে অর্থনৈতিক সাম্যের গুরুত্ব অধিক। অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত সাম্য অর্থহীন হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক সাম্য হচ্ছে সমাজ থেকে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা। অন্যথায় বিত্তবানরা সকল সুযােগ-সুবিধা ভােগ করবে আর বিত্তহীনরা বঞ্চিত হবে। বস্তুত অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত রাজনৈতিক সাম্য অবাস্তব থেকে যায়।
(৫) সামাজিক সাম্য (Social equality): সামাজিক সাম্য বলতে বুঝায় সমাজের অভ্যন্তরে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান সামাজিক সুযােগ-সুবিধার উপস্থিতি। এক্ষেত্রে কোনাে প্রকার বিশেষ সুযােগ-সুবিধা বিদ্যমান থাকবে না। বস্তুত সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত হচ্ছে বিশেষ সুযােগ-সুবিধার অনুপস্থিতি বা বিলুপ্তি।
(৬) প্রকৃতিগত সাম্য (Natural equality): সৃষ্টিকর্তা সকল মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করেননি। বিভিন্ন দিক থেকে মানুষে মানুষে নানা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। সমাজে এ প্রকৃতিগত বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে মানুষ অর্থাৎ সমাজে বসবাসকারী মানুষ কোনােরূপ কৃত্রিম বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি না করে। কাজেই সাম্যের উপলব্ধি ব্যাহত হয় যাতে সমাজে কৃত্রিম বৈষম্যের বিলুপ্তি না ঘটে।
(৭) শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সাম্যঃ শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সাম্যের ধারণাকে সম্প্রসারিত করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যাপক বার্কার এর অভিমত অনুসারে, রাষ্ট বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষাকে সকলের জন্য বাধ্যতামূলক করেছে। ন্যূনতম শিক্ষাগত অধিকারকে সকলের ক্ষেত্রে স্বীকার করেছে। উচ্চশিক্ষার অধিকারও সম্পসারিত হয়েছে। সমাজে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও সকলের অংশগ্রহণ করার অধিকার রয়েছে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সাম্য মানবজীবনের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমান বিশ্বে সাম্যের ধারণা খুবই জনপ্রিয়। ব্যক্তিতে পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য সাম্যের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। কেননা সাম্য ব্যতীত গণতন্ত্রের কথা চিন্তা করা যায় না। অর্থাৎ গণতন্ত্রের ভিত্তি হলাে সাম্য। সাম্যের প্রতিটি ভাগই সবশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। সংগত কারণেই এদের কোনােটিকেই অস্বীকার করা যায় না।