উপস্থাপনাঃ ভারত উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ নরপতি সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করে দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর রাজত্বকালে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কারের মাধ্যমে তিনি মুঘল সাম্রাজ্যকে নতুনভাবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করে তােলেন। তাই ঐতিহাসিক জে. এন. সরকার বলেন- The life of Aurangjeb was one long tragedy, the story of a man battling in the vain against an envisible but inexorable fate, and this tragedy in history was developed with all the regularity of a perfect drama.
সম্রাট আওরঙ্গজেবের চরিত্রঃ
১. দ্বীনদার শাসকঃ সম্রাট আওরঙ্গজেব অত্যন্ত দ্বীনদার নিষ্ঠাবান শাসক ছিলেন। পবিত্র কুরআনের হাফেয এ প্রখ্যাত শাসকের ইসলামের মৌলিক বিধান নামায, রােযা, যাকাতসহ দ্বীন ইসলামের সকল স্তম্ভের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল। তিনি প্রশাসনের প্রত্যেক স্তরে আল কুরআনের শাসন কায়েমে সচেষ্ট ছিলেন। সমাজের সকল অনৈসলামিক কার্যকলাপ তিনি কঠোর হস্তে দমন করেন।
২. পরধর্ম সহিষ্ণুঃ তিনি একজন ধার্মিক মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পরধর্মে সহিষ্ণুতা প্রদর্শন এবং ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যােগ্য ব্যক্তিকে রাজকার্যে নিযুক্ত করতেন।
৩. সাদাসিধা জীবন যাপনঃ সম্রাট আওরঙ্গজেব ব্যক্তিগত জীবনে খুবই মুত্তাকী পরহেজগার ছিলেন। তিনি অত্যন্ত সাদাসিধা জীবন যাপন করতেন, কম খেতেন এবং মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমাতেন। সুখে-দুঃখে তিনি সমভাবে ধীর শান্ত থাকতেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে তিনি সর্বসাধারণের সম্পত্তি গণ্য করতেন।
৪. নিরপেক্ষ শাসকঃ আওরঙ্গজেব সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য সমাধা করতেন। তার দরবারে ধনী-দরিদ্র সকলেই সমান বিচার পেত। ব্যক্তিগত জীবনে সহজ সরল হলেও বিচারের ক্ষেত্রে তিনি খুবই কঠোর ছিলেন।
৫. বিদ্যা ও বিদ্বান ব্যক্তির পৃষ্ঠপােষকঃ ঐতিহাসিক গ্যারেট বলেন, আওরঙ্গজেব বিদ্যা ও বিদ্বান ব্যক্তির অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। তিনি নিজে একজন কুরআনে হাফেজ ছিলেন। তারই পৃষ্ঠপােষকতায় ‘ফতােয়ায়ে আলমগিরী’ নামক মূল্যবান গ্রন্থ রচিত হয়।
৬. প্রজাহিতৈষী শাসকঃ তিনি ছিলেন একজন প্রজাহিতৈষী শাসক, জনসাধারণের কল্যাণে তিনি পূর্বেকার ৮০ প্রকার কর রহিত করে দেন। প্রজাদের মঙ্গলে তিনি পিতৃসুলভ আচরণ করতেন।
৭. আদর্শের মৃত প্রতীকঃ সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন আদর্শের মূর্তপ্রতীক। তিনি অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।
৮. মহানুভব শাসকঃ আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন মহানুভব শাসক। জুলুম, শােষণ, দুনীতি ও অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরােধে তার তীক্ষ দৃষ্টি ছিল। শাসনকার্য সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগ তিনি নিজেই পরিদর্শন করতেন।
৯. দায়িত্ববান শাসকঃ সম্রাট একজন একনিষ্ঠ দায়িত্ববান শাসক ছিলেন। ঘুষ, অন্যায় প্রতিরােধ ও সুষ্ঠু বিচারকার্য পরিচালনার জন্য তিনি সমগ্র রাজ্যে ঘুরে ঘুরে শাসনকার্য পরিদর্শন করতেন।
১০. কৃষককুলের বন্ধুঃ ঐতিহাসিক আর. সি. মজুমদার বলেন, সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন কৃষককুলের প্রকৃত বন্ধু। তাদের সুবিধার জন্য তিনি অনেকগুলাে নলকূপ স্থাপন এবং রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণ করেন। কৃষকদের কৃষিপণ্য ক্রয় বিক্রয়ের সুবিধার জন্য তিনি কয়েকটি বাজার স্থাপন করেন।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের কৃতিত্বঃ
১. ফতােয়ায়ে আলমগিরী প্রণয়নঃ তিনি ছিলেন একজন যুগশ্রেষ্ঠ সংস্কারক ও প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ। তার পৃষ্ঠপােষকতায় ‘ফতােয়ায়ে আলমগিরী’ নামক একখানা মূল্যবান গ্রন্থ রচিত হয়, যা ইসলামী আইনশাস্ত্রের এক অমূল্য সম্পদ।
২. পরিশ্রমী শাসকঃ সম্রাট আওরঙ্গজেব শত ব্যস্ততার মাঝেও নিজ হাতে কুরআন নকল করতেন এবং সকল ব্যাপারে স্বহস্তে রাষ্ট্রীয় ফরমানে স্বাক্ষর করতেন। তাই সমসাময়িক ঐতিহাসিকগণ তার কর্মদক্ষতা, প্রশাসনিক দায়িত্বজ্ঞান ও সুশাসনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
৩. সাহসী সেনাপতিঃ আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন সুদক্ষ ও সাহসী সেনাপতি। যুদ্ধের ময়দানে তিনি ধৈর্য ও সাহসের সাথে কৌশলে একটি উন্মত্ত হস্তিকে নিয়ন্ত্রণে এনে অসামান্য সাহসিকতার নজির স্থাপন করেন। অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করে তিনি বিজাপুর, গােলকুণ্ডা, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চল জয় করে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।
৪. হস্তলিপি শিল্পী ও চিত্রশিল্পীঃ আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ হস্তলিপিকার। স্বহস্তে লিখিত কুরআন শরীফের কপিসমূহ তার উন্নত হস্তলিপির প্রমাণ। এছাড়া তিনি ক্যালিওগ্রাফি ও চিত্রকর্মের অসংখ্য স্মৃতি রেখে গেছেন।
৫. ন্যায় ও ইনসাফের প্রতীকঃ তিনি ছিলেন ন্যায় ও ইনসাফের প্রতীক, নির্ভীক, নীতিনিষ্ঠ, সংযমী ও সদা কর্মতৎপর। তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের সর্বদা ভালা উপদেশ দিতেন।
৬. সামরিক ও কূটনৈতিক নৈপুণ্যঃ সমরশাস্ত্র ও কূটনীতিতে আওরঙ্গজেবের অসামান্য নৈপুণ্য ছিল। তিনি স্বয়ং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। কূটনৈতিক প্রজ্ঞা বলে সকল ভ্রাতাকে পরাজিত করে তিনি শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।
৭. সাম্রাজ্য বিস্তারে সাফল্যঃ আকবরের সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি আওরঙ্গজেবের আমলেই পরিপূর্ণতা লাভ করে। তিনি সমগ্র উত্তর ভারতে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
৮. স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপােষকঃ আওরঙ্গজেব স্থাপত্যশিল্পেরও পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। দিল্লীর লালবাগের কেল্লা, মতি মসজিদ ও লাহােরের বাদশাহী মসজিদ তার স্থাপত্যশিল্পের প্রতি গভীর অনুরাগের পরিচয় বহন করে।
৯. জিন্দাপীরঃ আওরঙ্গজেব আকবরের শাসনামলে ধর্মীয় বন্ধনের শিথিলতা দূর করতে প্রয়াসী হন। এজন্য তিনি মুসলমানদের নিকট থেকে জিন্দাপীর উপাধি লাভ করেন।
১০. সুপণ্ডিতঃ ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বলেন, “ফারসি, হিন্দি, আরবি ও তুর্কি ভাষায় আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন সুপণ্ডিত। হাদীস ও ফিকহশাস্ত্রেও তার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল।”
১১. উপাধিলাভঃ সম্রাটের নিষ্কলুষ নৈতিক জীবন যাপনের জন্য জনগণ তাকে ‘রাজার পােশাকে দরবেশ’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
১২. শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনঃ সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে দিল্লী, জৌনপুর, শিয়ালকোট, আহমদনগর, গােলকুণ্ডা প্রভৃতি শহর শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়। তিনি ছিলেন ইতিহাস প্রসিদ্ধ অত্যন্ত ধর্মভীরু একজন সম্রাট।
উপসংহারঃ সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন মুঘল বংশের একজন শ্রেষ্ঠ শাসক। তার চারিত্রিক গুণাবলির ভূয়সী প্রশংসায় ঐতিহাসিক কাফি খান যথার্থই বলেন- of all the sovereigns of the house of Temur-nay of all the sovereigns of Delhi no one, since Sikandar Lodi, has ever been apparently so distinguished for devotion austerity and justice. In courage long-suffering and sound judgment he was unrivaled.