অথবা, দর্শনের পরিসর বা পরিধি আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সার্বিক জ্ঞান লাভ করাই দর্শন। দর্শন সমগ্র সত্তার প্রকাশ, স্বরূপ ও আদর্শ উপলব্ধির চেষ্টাকারী। দর্শন হলাে বুদ্ধি, বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে গােটা সত্তার একটি ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা। এ সত্তার নিজের স্বরূপ, প্রকাশ এবং কোনাে মূল্য আছে কি না- দর্শন এসব বিষয়ের পর্যালােচনা করে থাকে। সুতরাং দর্শন এমন এক অনুশীলনের দিকনির্দেশনা দান করে যার মধ্যে জ্ঞানার্জনের প্রায় সবগুলাে শাখাই অনিবার্যভাবে অন্তর্গত। তাই দর্শন হচ্ছে জীবন ও জগৎকে ঘিরে উদ্ভূত মৌলিক সমস্যাবলির যৌক্তিক অনুসন্ধান।
দর্শনের পরিসর/পরিধি/আলােচ্য বিষয়ঃ যেসব বিষয় নিয়ে দর্শনের আলােচনার ক্ষেত্র বিস্তৃত সেগুলােকে মােটামুটি পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ
(১) বিশ্বতত্ত্ব (Cosmology): বিশ্বতত্ত্বের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Cosmology’ শব্দটি গ্রিক Kosmos থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ‘Kosmos’ শব্দটির অর্থ সুশৃঙখল বিশ্বজগৎ। দর্শনের এই শাখায় বিশ্বজগতের পরিদৃশ্যমান দিকের অনুসন্ধান করা হয়। দর্শনের এই শাখা রূপবিজ্ঞান বা জগদর্শন নামেও আখ্যায়িত হয়ে থাকে। বিশ্বজগৎ দেশ-কাল, জড় প্রাণ, বিশ্বজগতের উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ, অর্থাৎ সৃষ্টি, বিবর্তন ইত্যাদি নিয়ে এ শাখায় আলােচনা করা হয়।
(২) তত্তবিদ্যা (Ontology) অনেকে তত্ত্ববিদ্যাকে দর্শনের প্রাণস্পন্দন বলে আখ্যায়িত করেন। বিশ্বজগতের প্রকৃত সত্তাসম্পর্কীয় আলোচনাকেই সাধারণত তত্ত্ববিদ্যা বলা হয়ে থাকে। Ontology শব্দটি গ্রিক শব্দ Ontos এবং Logos থেকে উদ্ভূত। হয়েছে । ‘Ontos’ শব্দটির অর্থ সত্তা এবং ‘Logos’ শব্দটির অর্থ বিজ্ঞান। তাই Ontology অর্থ হচ্ছে সত্তাসম্পর্কীয় বিজ্ঞান।
(৩) মনােদর্শন (Philosophy of mind) মনােদর্শনে প্রধানত মন বা আত্মার স্বরূপ, দেহ ও মনের সম্পর্ক, ইচ্ছার স্বাধীনতা ও আত্মার অমরত্ম নিয়ে আলােচনা করা হয়। মনােদর্শন সাম্প্রতিককালে দর্শনের একটি বিশিষ্ট শাখা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
(৪) জ্ঞানবিদ্যা Epistomology) দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলাে জ্ঞানবিদ্যা বা জ্ঞানতত্ত্ব। দর্শনের যে বিশিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ শাখাটি জ্ঞানের স্বরূপ, উৎপত্তি, বিষয়বস্তু, সীমা, যথার্থতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আলােচনা করে তাকে বলা হয় জ্ঞানবিদ্যা। জ্ঞানের উৎস কি? জ্ঞান লাভের উপায় কী? কতটুকু জ্ঞানলাভ সম্ভব? জ্ঞানের উৎপত্তি কীভাবে হয়? যথার্থ জ্ঞানের শর্ত কী কী? জ্ঞানের সীমা কতদূর? এ ছাড়া জ্ঞানের সত্যতা ও মিথ্যাত্বের বিষয়টিও জ্ঞানবিদ্যা আলােচনা করে থাকে।
(৫) মূল্যবিদ্যা বা মূল্যসম্পর্কিত দর্শন (Axiology) মানবসভ্যতার ইতিহাসে দর্শনের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি আলােচনা করলে দেখা যায় যে, দর্শনের অন্যতম কাজ হচ্ছে মানবসভ্যতার প্রকত মঙ্গলের পথ নির্দেশ করা। তাই দর্শনের আরেকটি প্রধান শাখা হচ্ছে মূল্যবিদ্যা বা মূলসম্পর্কিত দর্শন। ধর্মীয় মূল্য, নৈতিক মূল্য সৌন্দর্যগত মল, ইত্যাদি মূল্য নিয়ে মূল্যবিদ্যায় আলােচনা করা হয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আপাতঃদৃষ্টিতে অধিবিদ্যা ও দর্শনের মধ্যে বিভিন পার্থক্য থাকলেও এদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। অধিবিদ্যা দর্শনের একটি শাখা। তা ছাড়া অধিবিদ্যার ব্যাখ্যা একমাত্র দর্শনের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব, অন্য কোনাে বিজ্ঞানের মাধ্যমে নয়। সুতরাং অধিবিদ্যা ছাড়া দর্শন অলােচনা ডানাবিহীন পাখির মতাে অবস্থা।