উত্তরঃ অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে লােকবিশ্বাস-লােকজ মিথ আর পুরাণ কাহিনির এক অভূতপূর্ব ভাণ্ডার। লেখক খুব সচেতনভাবে সকল মিথ-বিশ্বাসকে কাহিনির প্রবহমানতার সঙ্গে তিতাসের জলের মতােই মিশিয়ে দিয়েছেন। এরই সূত্র ধরে আমরা এ উপন্যাসে মাস্তুত উৎসবের বর্ণনা পাই।
মালােপাড়ার দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত, বঞ্চিত, বিড়ম্বিত ও নিগৃহীত ধীবর সম্প্রদায়ের একটি পূজাব্রতকে কেন্দ্র করে এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় ঘটনাংশ উন্মােচন করেছেন লেখক। এ পূজাব্রতের নাম মাঘমণ্ডলের ব্রত। এ ব্ৰতের স্থায়িত্বকাল সারা মাঘ মাস। এ মাসে কুমারী কন্যারা প্রার্থিত বরের আকাঙ্ক্ষায় এ পূজা করে। এতদৃপ্রসঙ্গে লেখকের বর্ণনাংশ লক্ষণীয় :
“এ পাড়ার কুমারীরা কোনকালে অরক্ষণীয়া হয় না। তাদের বুকের উপর ঢেউ জাগিবার আগে, মন যখন থাকে খেলার খেয়ালে রঙিন, তখনই একদিন ঢােল সানাই বাজাইয়া তাদের বিবাহ হইয়া যায়। তবু এই বিবাহের জন্য তারা দলে দলে মাঘমণ্ডলের পূজা করে। মাঘ মাসের ত্রিশদিন তিতাসের ঘাটে প্রাতঃস্নান করিয়াছে, প্রতিদিন স্নানের শেষে বাড়িতে আসিয়া ভাটফুল আর দূর্বাদলে বাঁধা ঝুটার জল দিয়া সিড়ি পৃজিয়াছে, মন্ত্রপাঠ করিয়াছে; লও লও সুরুজ ঠাকুর লও স্কুটার। জল, মাপিয়া পুখিয়া দিব সপ্ত আজল। আজ তাদের শেষ ব্রত।
তরুণ কলাগাছের এক হাত পরিমাণ লম্বা করিয়া কাটা ফালি, বাঁশের সরু শলাতে বিধিয়া ভিত করা হয়। সেই ভিতের উপর গড়িয়া তােলা হয় রঙিন কাগজের চৌয়ারি ঘর। আজিকার ব্রত শেষে ব্ৰতিনীরা সেই চৌয়ারি মাথায় করিয়া তিতাসের জলে ভাসাইবে, সঙ্গে সঙ্গে ঢােল কাসি বাজিবে, নারীরা গীত গাহিবে।”
মাঘমণ্ডলের ব্রত উৎসবে দীননাথ মালাের সপ্ত বর্ষীয়া কন্যা বাসন্তীর প্রতি অনুরাগবশত কিশাের আর সুবল কর্তৃক এ চৌয়ারি নির্মাণকে উপলক্ষ্য করে এ উপন্যাসে তিতাস তীরবর্তী ধীবর পল্লির একটি চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। দুঃখ দারিদ্র্য, হতাশা বঞ্চনার মধ্যেও মালােরা এসব উৎসব অনুষ্ঠানকে সযত্ন পরিচর্যায় টিকিয়ে রেখেছে।