অথবা, এক কক্ষবিশিষ্ট ও বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বলতে কী বুঝ? এর সুবিধা অসুবিধা আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ বর্তমান গণতান্ত্রিক বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে আইনসভাগুলাে মােটামুটি দু’ধরনের হয়ে থাকে। যথা- এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। এ দু’ধরনের আইনসভা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দু’ধরনের ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। এ দু’ধরনের আইনসভারই কাজে ও চরিত্রে পার্থক্য রয়েছে। একেক দেশের আর্থ-সামাজিক, ভৌগােলিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ দু’ধরনের আইনসভা কাজ করে থাকে।
এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভাঃ এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বলতে সেই আইনসভাকে বুঝায় যাতে একটিমাত্র কক্ষ বা পরিষদ থাকে যেখানে জনপ্রতিনিধিগণ সরাসরি জনগণের প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত হয়ে আসেন। এ ধরনের ব্যবস্থায় সাধারণত একটি দেশকে কতকগুলাে একক নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত করে প্রাপ্তবয়স্ক সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভাঃ এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতার কারণে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ধরনের আইন সভায় দুটি কক্ষ বা পরিষদ থাকে। একটি নিম্নকক্ষ এবং অপরটি উচ্চকক্ষ নামে পরিচিত।
এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার গুণাবলিঃ এক কক্ষবিশিষ্ট আইন সভার গুণাবলীসমূহ নিম্নে আলােচনা করা হলাে-
(১) এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা জনসংখ্যার ভিত্তিতে গঠিত হয় বলে এবং এখানে নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা হয় বলে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন সম্পর্কিত কোনাে জটিলতা সৃষ্টি হয় না।
(২) এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় স্বল্প সময়ে আইন পাস করা যায়, ফলে সময়ের অপচয় কম হয়। আনুষঙ্গিক ব্যয় ও কম সদস্যদের বেতন-ভাতা ও আইনসভার অধিবেশনজনিত ব্যয় কম হয়। সাধারণত ছােট ও দরিদ্র দেশগুলাের জন্য এ ব্যবস্থাই উপযােগী।
(৩) এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় জনগণের সার্বভৌমত্ব যেমন প্রতিষ্ঠিত হয় তেমনি এতে জনগণের সাধারণ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। লর্ড ব্রাইস-এর মতে, দ্বিতীয় কক্ষ প্রথম কক্ষের সিদ্ধান্তে অসম্মত হলে তা ক্ষতিকর হবে, আর যদি সম্মত হয় তবে তা অতিরিক্ত।
(৪) এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় দেশের সংকটময় মুহূর্তে বা জরুরি অবস্থায় যেকোনাে আইন সহজেই প্রণয়ন করা যায়। তাই জরুরি অবস্থাকালীন সময়ের দিক থেকে চিন্তা করলে এ ব্যবস্থা খুবই কার্যকর।
এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার দোষাবলীঃ এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার দোষাবলীসমহ নিয়ে আলােচনা করা হলাে-
(১) এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় কেবল জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয় বলে এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যদের মধ্যে অহমিকার সৃষ্টি হয়। তারা তাদের সরকারকে স্থায়ী করার জন্য নানারকম কালাে আইনের আশ্রয় নেয়। আইনের ব্যাপক বিচার-বিশ্লেষণ করার সুযোেগ এক কক্ষবিশিষ্ট আইন সভায় কম থাকে। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের ৪র্থ সংশােধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় শাসন কায়েম করা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
(২) এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় শুধু উদ্ভুত সমস্যাকে সামনে রেখেই দ্রুত আইন প্রণয়ন করা হয়। ফলে দ্রুত এ আইনের কার্যকারিতা হাস পায়। ফলে নতুন আইনের প্রয়ােজন আবার দেখা দেয়। এতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্ম হয়। এখানে আইন প্রনয়নে তাড়াহুড়া লক্ষ্য করা যায়।
(৩) এক কক্ষবিশিষ্ট আইন সভা শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয় বলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকে না।
(৪) এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অনেক সময় স্বৈরাচারের জন্ম দেয়।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার গুণাবলিঃ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার গুণাবলিসমূহ নিম্নে আলােচনা করা হলাে-
(১) শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টিতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। J.S Mill বলেন, A second chamber serves an important purpose as a cheek upon legislative despotism. এ ব্যবস্থায় ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হয় বলে সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার প্রবণতা কম থাকে।
(২) দ্বিক্ষক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় সুচিন্তিত আইন প্রণয়ন করা হয়। প্রথম কক্ষের যেকোনাে হঠকারিতা এবং আবেগ ২য় কক্ষে ধরা পড়ে এবং ২য় কক্ষের ভুল প্রথম কক্ষে ধরা পড়ে। Lord Action বলেন, “The 2nd chamber is essential security of freedom”।
(৩) দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের প্রতিনিধিত্ব রক্ষা করা যায়। এতে বহুসংখ্যক ব্যক্তি আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বেশি সহায়ক।
(৪) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা স্বৈরাচারী শাসনের অবসান করতে পারে। প্রথম কক্ষ জনমতের বিরুদ্ধে কাজ করলে অন্য কক্ষ তা প্রতিরােধ করতে সমর্থ হয়।
(৫) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভাকে জনমত যাচাইয়ের মাপকাঠি বলা যায়। এক্ষেত্রে জনমতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয় যাচাই করা যায়। অনেক দেশে দুটি কক্ষের নির্বাচন আলাদা-আলাদা সময়ে অনুষ্ঠিত হয় বলে জনমত যাচাইয়ে সুবিধা হয়। জনমতের সুষ্ঠু প্রতিফলনের জন্য দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য।
দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ত্রুটিসমূহঃ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ত্রুটিসমূহ নিম্নে আলােচনা করা হলো-
(১) দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়। এখানে আইন প্রণয়নে দুটো কক্ষেরই অনুমােদন প্রয়ােজন হয় বলে দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় নষ্ট হয়। জরুরি অবস্থায় আইন প্রণয়নে সমস্য হয়।
(২) দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এর অধিবেশনজনিত ব্যয় এবং সদস্যদের সংস্থাপন। বেতন-ভাতা নির্বাহ করা একটি দরিদ্র দেশের জন্য সত্যিই দুরূহ।
(৩) দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভাই আইন প্রণয়ন করতে গিয়ে অনেক সময় দ্বিমতের সৃষ্টি হয়। দু’টি কক্ষে দুটি ভিন্ন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে অনেক সময় সুশাসনের ক্ষেত্রে তা বিরাট বাধা হিসাবে কাজ করে।
(৪) দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভাকে অনেকে অপ্রয়ােজনীয় এবং অহেতুক সংযােজন মনে করেন। এ দলের সমালােচকগণ মনে করেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইন সভার প্রয়ােজন নেই কারণ নির্বাচকমণ্ডলী যদি শিক্ষিত ও সচেতন হয় তবে তারা এমন লােকদের আইন সভায় নির্বাচিত করবে যারা এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভাতেই যথাযথ সুচিন্তিত আইন প্রণয়ন করে সুশাসন উপহার দিতে পারেন। অহেতুক আরেকটি ব্যয়বহুল কক্ষের প্রয়ােজন নেই।
(৫) Prof, Laski মনে করেন যে, এক কক্ষবিশিষ্ট আইন সভাতেই যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলাের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। সংবিধানের ধারা অনুসারে অঙ্গরাজ্যগুলাে স্বীয় অধিকার ভােগ করে দ্বি-কক্ষের কোনাে প্রয়ােজন নেই।
পরিশেষঃ উপযুক্ত আলােচনায় দেখা যাচ্ছে যে, এক কক্ষ ও দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট উভয় আইন সভাতেই পক্ষে-বিপক্ষে নানান যুক্তি আছে। তবে এ কথা সত্য যে বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশেই এখন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উপযােগিতা প্রমাণিত হয়েছে। আর দরিদ্র ও ছােট দেশের জন্য এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা উপযােগী বলে এর পক্ষেও অনেকে মত প্রকাশ করেছেন।