অথবা, সামাজিক অসমতার জীবতাত্ত্বিক ও সামাজিক উপাদানসমূহ আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ সামাজিক অসমতা বা বৈষম্য সমাজবিজ্ঞান তথা নৃ-বিজ্ঞানের একটি বহুল প্রচলিত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। যার হংরেজি প্রতিশব্দ হলাে Social Inequality. সাধারণ অর্থে সামাজিক অসমতা বলতে বুঝায় ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্নতার অস্তিত্ব। সমাজভেদে অসমতার তারতম্য হতে পারে। তবে একেবারে অসমতাবিহীন সমাজ কোথাও দেখা যায় না। সকল মানুষ সমভাবে প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক অধিকার ভােগ না করতে পারলে সেখানে অসমতার সৃষ্টি হয়। সমাজে কিছু প্রকৃতি প্রদত্ত অসমতা আবার কিছু মানবসৃষ্ট অসমতা আছে। মানুষ ইচ্ছে করলে মানবসৃষ্ট বিভিন্নতা সমূলে ধ্বংস করতে পারে।
সামাজিক অসমতার উপাদানসমূহঃ সামাজিক অসমতা বলতে বুঝায় ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য। একই সমাজে বসবাস করা সত্ত্বেও দেখা যায় যে, সবাই একই মর্যাদার অধিকারী নয়। অথবা একই ধরনের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সুযােগ-সুবিধা ভােগ করছে না। বিভিন্ন উপাদানের ভিত্তিতে সমাজকে স্তবায়িত করা সম্ভব। সামাজিক অসমতার জন্য দায়ি উপাদান বা কারণসমূহকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা: (১) জৈবিক (Biological Factors), (২) সামাজিক (Social Factors)। নিম্নে সামাজিক অসমতার জন্য দায়ী। জৈবিক এবং সামাজিক উপাদান সম্পর্কে আলােচনা লিপিবদ্ধ করা হলাে-
(১) নারী ও পুরুষভেদে সামাজিক অসমতাঃ প্রাকৃতিক তথা জৈবিক পার্থক্যের বিচারে সব মানুষ নারী ও পুরুষে বিভক্ত। নারী-পুরুষের যে বিভেদ বা অসমতা তা মানবসৃষ্ট নয়। অথচ মানবসমাজে এটিই প্রথম ও মৌলিক প্রভেদ বা অসমতা। শারীরিক শক্তি বা সামর্থ্যের বিভিন্নতার কারণে পুরুষ ভারী কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং মহিলারা তুলনামূলকভাবে হালকা কাজে অংশ নেয়। অথচ মহিলারা সকাল থেকে রাত অবধি ঘর-সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকলেও সমাজ ও সংস্কৃতির কিছু কিছু নিয়ম-নীতি, সংস্কার ও মূল্যবােধের কারণে নানাদিক থেকেই তাদের মর্যাদা পুরুষের নিচে। এভাবে নারী-পুরুষভেদে সামাজিক অসমতার সৃষ্টি হয়।
(২) বয়সভেদেঃ প্রতিটি সমাজের জনসংখ্যা বয়সের তারতম্য বিচারে বিভক্ত। বয়সের ওপর নির্ভর করে, সমাজস্ত মানুষেরা বিভিন্ন কার্যাবলির নির্দেশ করে। যাদের বয়স কম তারা সমাজে হালকা ধরনের কাজ করে থাকে। বেশি। বয়সের পর্যায়ভুক্তগণ কঠিন কাজ করে থাকেন এবং বৃদ্ধ বয়সের পর্যায়ভুক্তগণ বিশ্রাম নিয়ে থাকেন।
(৩) জাতি-বর্ণভেদেঃ সামাজিক অসমতার ব্যাখ্যায় জাতি বর্ণপ্রথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি জাতি-বর্ণ অন্ত-বিবাহ ভিত্তিক গােষ্ঠী যার নিজস্ব পৈতৃক পেশা রয়েছে। বিভিন্ন জাতি বর্ণগুলাে একটি থেকে অন্যটি উচ্চ বা নিচুতে অবস্থান করে এবং তা অনেকটা স্থায়ীভাবে স্তরায়িত। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আর্যরা ভারতে এসে জাতি-বর্ণপ্রথার পত্তন করে। তখন হিন্দু সমাজ চারটি বর্ণে, বিভক্ত ছিল; যথা: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র।
(৪) নরগােষ্ঠী ভেদেঃ যদিও বিজ্ঞানীদের মতে নরগােষ্ঠীর অংশে বুদ্ধিমত্তার, সাংস্কৃতিক যােগ্যতার কোনাে সম্পর্ক নেই। তথাপি কার্যত নরগােষ্ঠীগত বৈষম্য সমাজে টিকে আছে এবং তা সামাজিক অসমতার একটি উল্লেখযােগ্য উপাদান। বস্তুত শ্বেতকায় বনাম কৃষ্ণকায় দ্বন্দ্বই সবচেয়ে মারাত্মক রূপ নিয়েছে।
(৫) বংশমর্যাদাভেদেঃ সামাজিক অসমতার অন্যতম উপাদান হলাে বংশমর্যাদা। বংশমর্যাদার ফলে ব্যক্তি সমাজে তার আসন করে নেয়। সামাজিক বংশমর্যাদা দু’ভাবে ভাগ করা যায়। যথা: (ক) আরােপিত মর্যাদা, যা মানুষের নিজস্ব গুণ, ব্যক্তিত্ব ও কীর্তির ওপর নির্ভর করে না; নির্ভর করে তার সামাজিক অবস্থার ওপর। (খ) অর্পিত মর্যাদা মানুষের গুণের ওপর নির্ভরশীল।
(৬) শ্রেণিভেদে অসমতাঃ জাতি-বর্ণের সদস্য পদটাই অপরিবর্তনীয় এবং এটি হচ্ছে বংশানুক্রমিক গােষ্ঠী। কিন্তু শ্রেণি হচ্ছে মুক্ত, পরিবর্তনীয় তথা গতিশীল এক সামাজিক গােষ্ঠীর নাম। এই শ্রেণিভেদে সমাজে অসমতার সৃষ্টি হয়। American Society নানা উচু-নীচু শ্রেণিতে বিভক্ত। ঐ সমাজে শ্রেণিভেদে সামাজিক অসমতা অনস্বীকার্য।
(৭) ক্ষমতাভেদে সামাজিক অসমতাঃ সামাজিক অসমতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলাে অসম ক্ষমতা। সব সমাজেই, ক্ষুদ্র বা বৃহৎ, প্রতিটিতে সামাজিক নেতা এবং অনুগামী অনস্বীকার্য। ক্ষমতার ভিত্তিতে সমাজে। মর্যাদার রূপ প্রকাশ পায়।
(৮) আয়ভেদে অসমতাঃ আয়ের তারতম্য বিচারে আর্থিক শ্রেণিসমূহের উদ্ভব ঘটে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত- এভাবে প্রায় সব সমাজকে স্তরায়িত করা যায়। সমাজে যে ব্যক্তির সম্পত্তি বেশি তার সম্মান-মর্যাদা-প্রতিপত্তি বা ক্ষমতা সর্বাধিক। আর সমাজে যার সম্পত্তি নেই তার কথা কেউ মান্য করে না।
(৯) পদমর্যাদাভেদে অসমতাঃ সামাজিক স্তরবিন্যাসে পদমর্যাদা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোনাে ব্যক্তির কাজ, ভূমিকা এবং তার চলন প্রভৃতি তার পদমর্যাদা নিরূপণ করে। বর্তমান সমাজে বিভিন্ন পদমর্যাদা ভিত্তিক গােষ্ঠীর অস্তিত্ব দেখা যায়।
(১০) চেহারভেদে অসমতাঃ সামাজিক অসমতার ক্ষেত্রে চেহারার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। চেহারার সামাজিক মূল্য অধিক। সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। পাত্র-পাত্রী নির্বাচন ছাড়াও নেতৃত্ব, অফিসের পদোন্নতি ইত্যাদি সহ বর্তমানে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযােগীতায় চেহারা একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
(১১) শিক্ষা ও মেধাভেদে অসমতাঃ শিক্ষা ও মেধা সামাজিক অসমতার অন্যতম উপাদান। সমাজের উচু পেশা, বেতন, অধিক সুযােগ-সুবিধা মেধাবীরাই ভােগ করে থাকে। অর্থাৎ তারা সমাজ পরিকল্পনার মৌল ভিত্তি জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। পক্ষান্তরে অশিক্ষিত লােককে সমাজে মূল্যায়ণ করা হয় না।
(১২) বাসস্থানভেদে অসমতাঃ বাসস্থানও সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটি মৌলিক নিয়ামক। অভিজাত এলাকার বাসিন্দা এবং শ্রমিক কলােনি বা বস্তির বাসিন্দাদের মধ্যে সামাজিক স্তরভেদ আকাশ-পাতাল । গ্রামে বসবাসকারী ব্যক্তি ও শহরে বসবাসকারী লােকদের মধ্যে মন-মানসিকতা ও চাওয়া-পাওয়ার পার্থক্য অনেক বেশি।
পরিশেষঃ উপযুক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, উক্ত উপাদানগুলাের যেকোনাে এক বা একাধিক উপাদান দ্বারা যেকোনাে সমাজকে স্তবায়িত করা সম্ভবপর। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, কোনাে সমাজই স্তরবিহীন নয়। এবং সামাজিক স্তরবিন্যাসের উপযুক্ত উপাদানগুলাে পৃথিবীর সর্বস্তরের সমাজে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে বিদ্যমান রয়েছে।