অথবা, ‘প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থটি সর্বাত্মকবাদের একটি নীল নকশা’- ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতি সাধনে যে সব চিন্তানায়কের অবদান চিরভাস্বর তাদের মধ্যে গ্রীক চিন্তাবিদ প্লেটো ছিলেন অন্যতম। এখানে অধ্যাপনার সময় তিনি ৩৬টি দর্শনমূলক গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে ‘দি রিপাবলিক’ একটি সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। আর এ গ্রন্থে তিনি সর্বাত্মকবাদের নীলনকশা এঁকেছেন। একারণেই আমাদের আলােচ্য বিষয় হলাে এ সর্বাত্মকবাদ।
সর্বাত্মকবাদঃ সর্বাত্মকবাদ হলাে এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থা যেখানে মানুষের জীবনের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত, ধর্মীয়, কৃষ্টিগত, শিল্প-বাণিজ্য, আত্মিক ও বৈষয়িক সবকিছুই রাষ্ট্রায় কতৃত্বের নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। অর্থাৎ সর্বাত্মকবাদ বলতে বুঝায় এমন এক শাসনব্যবস্থা-
(১) যেখানে আইনের ভূমিকা নেই অর্থাৎ আইনের শাসন নেই।
(২) শাসকগণ তার কর্ম-অপকর্মের জন্য কারাে নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়।
(৩) সর্বাত্মকবাদে সমস্ত শাসনক্ষমতা এক বা একাধিক ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে, যেখানে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালিত হয়।
(৪) শাসন পরিচালনায় যেখানে জনগণের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকে না।
মােটকথা সর্বাত্মকবাদ হচ্ছে ফ্যাসিবাদের এক বিশেষ রূপ- ‘কিছুই রাষ্ট্রের উর্ধ্বে নয়, বাইরেও নয়, বরং সর্বকিছুই রাষ্ট্রের জন্য।’
সর্বাত্মকবাদের প্রবক্তারূপে প্লেটোঃ ‘The Republic’ গ্রন্থের আলােচনার প্রেক্ষিতে প্লেটোকে সর্বাত্মকবাদের প্রথম প্রবক্তা বলার কারণসমূহ নিম্নরূপ-
(১) শাসক শ্রেণীঃ প্লেটো তার মূল্যবান গ্রন্থে একটি উত্তম রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন। এই রাষ্ট্রের কর্ণধার হল শাসক শ্রেণী। এই শাসক শ্রেণীরা হলেন রাষ্ট্রের পরিচালক। তারা তাদের খেয়াল খুশী অনুসারে কাজ করতে পারবে না, যা সর্বাত্মকবাদকে সমর্থন করে।
(২) উৎপাদক শ্রেণীঃ প্লেটো তার রিপাবলিক গ্রন্থে উৎপাদক শ্রেণী সম্পর্কে আলােচনা করেছেন। তারা তাদের দৈহিক পরিশ্রমের দ্বারা রাষ্ট্রের প্রয়ােজনীয় দ্রব্য উৎপাদন করবে। কিন্তু তারা তাদের ইচ্ছামত দ্রব্য সামগ্রী ভােগ করতে পারবে না। রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত দ্রব্যাদি তারা ভােগ করবে। এক্ষেত্রেও তার বক্তব্যে সর্বাত্মকবাদের সমর্থন পাওয়া যায়।
(৩) যােদ্ধা শেণীঃ তারা দেশকে সর্বপ্রকার ভীতি থেকে মুক্ত রাখবে। যােদ্ধা শ্রেণীর এই গুরু দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও তাদের সব কিছু রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন।
(৪) ন্যায়বিচারঃ তার ন্যায়বিচার আলােচনায় দেখা যায় যে, যারা রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা কোন রাজনৈতিক সুযােগ সুবিধা পাবে না। তারা কেবল অপর শ্রেণীর লােকের জন্য কাজ করবে। এখানে প্রকৃত ন্যায়বিচার আসতে পারে না। এখানেও তিনি সর্বাত্মকবাদের প্রবক্তা হিসেবে অভিহিত।
(৫) শিক্ষা ব্যবস্থাঃ প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থে উল্লেখিত শিক্ষা ব্যবস্থায়ও সর্বাত্মকবাদের আলামত পাওয়া যায়। অনেকে বলেন, তিনি তার এই রাষ্ট্রে আদর্শ শাসক গড়ে তুলতে চেয়েছেন কিন্তু আদর্শ লােকের কোন লক্ষণ পাওয়া যায় না। সবশ্রেণীর লােক এই শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না।
(৬) দাস প্রথাঃ তিনি ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের দাসে পরিণত করেছেন। তার মতে রাষ্ট্র হল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আর ব্যক্তি হল তার অধীনস্ত দাস। ব্যক্তিগত অধিকার বলতে তাদের কিছু নেই।
(৭) আদর্শ রাষ্ট্রঃ প্লেটো মনে করতেন রাষ্ট্র পরিচালনা করা কোনাে অধিকারের ব্যাপার নয়, বরং তা গুণের ব্যাপার। প্লেটো তাই আদর্শ রাষ্ট্রের পরিচালনার ভার দিতে চেয়েছেন জ্ঞানী-গুণীর হাতে। তাই তিনি দার্শনিক রাজার হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে উত্তম শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছেন।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, প্লেটো তার The Republic গ্রন্থে যে আলােচনা করেছেন, মূলত এর মাধ্যমে তিনি সর্বাত্মকবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এ কারণে তার এই গ্রন্থটিকে সর্বাত্মকবাদের নীলনকশা বলা হয়।