অথবা, রোম সাম্রাজ্যের ওপর বর্বরদের আক্রমণ এবং এ সভ্যতার ওপর এর প্রভাব বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ রােম সাম্রাজ্যের ওপর বর্বরদের আক্রমণ মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি বিশেষ ঘটনা। রােম সাম্রাজ্য ছিল প্রাচীনকালে সভ্যতাসমূহের শীর্ষস্থানীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতি, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে এ সভ্যতা পৃথিবীর ইতিহাসে আজও বিস্ময়। কিন্তু খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে জার্মান বর্বরদের আক্রমণের ফলে গৌরবময় রােম সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ফলে প্রাচীন থেকে মধ্যযুগের সূচনা হয়।
বর্বরদের পরিচয়ঃ জার্মান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতি, গােষ্ঠিয় সমন্বয়ে বর্বর জাতি গড়ে ওঠে। এরা রােমান সাম্রাজ্যের উত্তর ও পূর্ব সীমান্তে দানিয়ুব নদীয় অপর প্রান্তে বাস করত। এ সকল বর্বরদের পরিচয় দু’টি সূত্র থেকে জানা যায়। একটি রােমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের দিনপঞ্জী কমেন্টরিজ এবং অন্যটি রােমান ঐতিহাসিক ট্যাসিসটাস কর্তৃক লিখিত। তারা বলেন, অস্টাগথ, ভিসিগথ, ফ্রাংক, ভ্যান্ডাল, লুম্বার্ট প্রভৃতি জাতি ছিল বর্বরদের অন্তর্ভুক্ত।
বর্বরদের রোম আক্রমণের কারণঃ বর্বরদের রােম আক্রমণের পাশ্চাতে অনেকগুলাে কারণ বিদ্যমান ছিল। নিম্নে এ কারণগুলাে বিস্তারিত বর্ণনা করা হলােঃ
(১) যাযাবর জীবনঃ প্রাচীনকাল থেকেই রােম ও জার্মানিদের মধ্যে পারস্পরিক পরিচয় ছিল। আর বর্বররা স্বভাবগতভাবেই ছিল যাযাবর ও দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। তাদের মধ্যে কোনাে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। এ ছাড়া আরা ছিল দরিদ্র। তাই উর্বর জমির প্রত্যাশায় বর্বররা বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াত। আর এরূপ পরিস্থিতিতে রােমের প্রতি মুগ্ধ হয়ে তারা রােম আক্রমণ করে।
(২) জনসংখ্যা বৃদ্ধিঃ প্রথম দিকে যাযাবররা ছিল সংখ্যালঘু তাই জার্মানিতে তাদের বসতি স্থাপনের সুযােগ হয়। কিন্তু কালক্রমে বর্বরদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আর খরা, বন্যা, পানিশূন্যতা ইত্যাদি কারণে জার্মানিতে ব্যাপক খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ফলে জার্মান বর্বরগণ বাধ্য হয়ে রােম আক্রমণ করে।
(৩) গােত্রীয় কলহঃ বর্বরগণ ছিল বিভিন্ন জাতি-গােষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। ফলে জাতিগত কারণে তাদের মধ্যে গােত্রীয় কলহ লেগেই থাকত। এ ছাড়া তখনও জার্মানিতে কোন রাজনৈতিক জ্ঞান সৃষ্টি হয়নি। ফলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও কলহ নিত্যদিনের সাথী হয়ে দাঁড়ায়। তাই সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় বর্বরগণ রোম আক্রমণ করে।
(৪) উর্বর ভূমিঃ বর্বরগণ ছিল যাযাবর জাতি। তাই রােমের বিশাল ভূ-খণ্ড, উর্বর ভূমি, উন্নত ভূমি ব্যবস্থাপনা, জার্মান বর্বরদের আকৃষ্ট করে। ফলে বর্বররা রােম সাম্রাজ্য আক্রমণ করে।
(৫) উন্নত জীবন ব্যবস্থাঃ মানব সভ্যতার ইতিহাসে রােম সভ্যতা ছিল খুবই উন্নত। এ ছাড়া ইউরােপীয় সমাজ ব্যবস্থায় রােমের জীবন প্রণালী ছিল আকর্ষণীয় তখন রােমে নাগরিক সুবিধা এতােই উন্নত ছিল তা সমগ্র বিশ্বকে আকৃষ্ট করেছিল। ফলে বর্বররা রােম সাম্রাজ্য আক্রমণে অগ্রসর হয়।
(৬) রোম সাম্রাজ্যের দুর্বলতাঃ পঞ্চম শতাব্দীতে রােম সাম্রাজ্য স্বীয় শৌর্য-বীর্য হারিয়ে ফেলে। বিশেষ করে যােগ্য ও শক্তিশালী নেতৃত্বের অভাবে রােম সাম্রাজ্য ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এরূপ পরিস্থিতিতে জার্মানির বর্বররা রােম সাম্রাজ্য আক্রমণ করে।
বর্বরদের আক্রমণঃ রােমান সাম্রাজ্যের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে জার্মান বর্বরদের আক্রমণ ঘটে। থিউডােসিয়াসের দুই পুত্র হােননারিয়াস ও আর্কোডিয়াস ছিল পর্যায়ক্রমে পূর্ব ও পশ্চিম রােমের শাসনকর্তা। বর্বররা দানিয়ুব নদী অতিক্রম করে প্রথমবারের মত রােম নগরী আক্রমণ এবং লুণ্ঠন করে। ফলে বাধ্য হয়ে রােম সম্রাট তাদের সঙ্গে সমঝােতা করেন। থিউডােসিয়াসের মৃত্যুর পর গথ বংশীয় বর্বরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তারা এলারিকের নেতৃত্বে একের পর এক রােমান সাম্রাজ্যের ওপর আঘাত হানতে থাকে।
বর্বরদের আক্রমণের প্রভাবঃ বর্বরদের রোম আক্রমণের ফলাফল ছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। নিম্নে বর্বরদের রােম সাম্রাজ্য আক্রমণের প্রভাব ও ফলাফল বর্ণনা করা হলাে-
(১) সমগ্র ইউরােপে ধ্বংসযজ্ঞঃ জার্মান বর্বরদের রােম আক্রমণ ছিল একটি তাৎপর্যপর্ণ ঘটনা। কেননা বর্বরদের বােম আক্রমণের ফলে সমগ্র ইউরোেপ ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়। কেননা বর্বররা রােমের ঘর-বাড়ি, দালান-কোটা, শহর, বন্দর ইত্যাদি ধ্বংস করে দেয়।
(২) ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতিঃ বর্বরদের রোম আক্রমণের ফলে রােমের ব্যবসা-বাণিজোর ব্যপক ক্ষতি হয়। তারা রােমের রাস্তা-ঘাট, সেতু ইত্যাদি ধ্বংস করে ফেলে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া কৃষি কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপিত হয়।
(৩) সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধ্বংসঃ বর্বরদের রােম আক্রমণের ফলে জার্মানি রােমান উভয় জাতির সত্যতা-সংস্কৃতির প্রভাবে একটি মিশ্র নতুন সভ্যতার সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রে জার্মানরা রােমানদের উন্নত সংস্কৃতি গ্রহণ করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে রােমান সংস্কৃতির ধ্বংস সাধিত হয়।
(৪) জার্মান বাহিনীকে স্বাগতঃ রােমের অনেক মানুষ জার্মান বর্বরদের রােম আক্রমণকে সমর্থন করেছে। ক্রীতদাস ও কলােনীরা জার্মানিদের পক্ষ নিয়ে রােমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এছাড়া তারা জার্মান বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আর জার্মান বাহিনীকে নগর তােরণ উন্মুক্ত করে স্বাগত জানিয়েছে।
(৫) রােমান সংস্কৃতির প্রভাবঃ রােম আক্রমণের পর বর্বররা সেখানে বসবাস করতে থাকে। আর দীর্ঘদিন রােমানদের পাশাপাশি বাস করার ফলে রােমানদের সভ্যতার প্রভাব তাদের ওপর পড়ে। বিশেষ করে উন্নততর চাষাবাদ পদ্ধতি ও কৃষিকার্যে উৎকৃষ্ট হাতিয়ারের ব্যবহার তারা রােমানদের কাছ থেকে আয়ত্ত করে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, রােমান সাম্রাজ্যের ওপর বর্বরদের আক্রমণ ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। কেননা এ আক্রমণের ফলে সমগ্র ইউরােপে বিরাট পরিবর্তন ঘটে। রােমানদের ব্যবসা-বাণিজ্য শেষ হয়ে যায়। সভ্যতা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধ্বংসলীলা সাধিত হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাফল্যও আসে। রােমান সাধারণ জনগণ জার্মানি বর্বরদের সাহায্য করেছিল। কেননা তারা এ সময় অনেক সুযােগ-সুবিধা পেয়েছিল। তবে বর্বরদের রােম সাম্রাজ্য আক্রমণের ফলে প্রাচীন যুগ থেকে রােম সাম্রাজ্য মধ্যযুগে প্রবেশ করে।