অথবা, হােদায়বিয়ার সন্ধির শর্তসমূহ ও তাৎপর্য আলােচনা কর।
অথবা, হােদায়বিয়ার সন্ধির শর্তাবলি আলােচনা কর। ইসলামের ইতিহাসে এর গুরুত্ব নিরূপণ কর।
অথবা, পটভূমি উল্লেখপূর্বক হোদায়বিয়ার সন্ধি সম্পর্কে বিস্তারিত লেখ।
উপস্থাপনাঃ ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে হােদায়বিয়ার সন্ধি এক নতুন অধ্যায়ের শুভ সূচনা করে। এ সন্ধির শর্তাবলি বাহ্যিক দৃষ্টিতে মুসলমানদের স্বার্থের পরিপন্থী হলেও এটা কুরাইশদের পতন ডেকে আনে এবং মুসলমানদের বিজয়ের পথ সুগম করে। আল্লাহ তায়ালা এ সন্ধিকে ফাতহুম মুবীন বা সুস্পষ্ট বিজয় বলে উল্লেখ করেছেন। তাই ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি বলেন- The result of this treaty is that where as Muhammad (Sm) went forth to Hudaybiah with only 1400 men, he was followed two years later, in the attack on Makkah by ten thousand.
নামকরণঃ হােদায়বিয়া নামক স্থানে এ সন্ধি সম্পাদিত হয়েছে বিধায় ইসলামের ইতিহাসে এটি হােদায়বিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত। এ সন্ধিকে ঐতিহাসিক আমীর আলী land mark বলে অভিহিত করেছেন।
হােদায়বিয়া সন্ধির পটভূমিঃ প্রখ্যাত হাদীসবেত্তা ইমাম যুহরী বলেন, মহানবী (স) স্বদেশ দর্শন ও হজ্জ পালনের জন্য ষষ্ঠ হিজরী মােতাবেক ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ১৪০০ সাহাবীসহ মক্কাভিমুখে গমন করে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হােদায়বিয়া নামক স্থানে উপনীত হয়ে শিবির স্থাপন করেন। মক্কার কাফেররা তাকে কোনােভাবেই মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না মর্মে দৃঢ় অবস্থান নেয়। অবশেষে পরিস্থিতির মােকাবেলায় সেখানেই মহানবী (স) ও কুরাইশদের মধ্যে একটি সন্ধি চুক্তি সম্পাদিত হয়।
হােদায়বিয়ার দৃশ্যপটঃ
১. জন্মভূমির আকর্ষণঃ কুরাইশদের অত্যচারের কারণে দীর্ঘ ছয় বছর যাবৎ মদিনায় প্রবাস জীবনযাপন, আত্মীয়-স্বজন এবং জন্মভূমির বিরহ বেদনা মহানবী (স) ও মুহাজির সাহাবীদের ব্যথিত করে তােলে। তাই তারা জন্মভূমির আজন্ম আকর্ষণে মক্কাগমনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।
২. বায়তুল্লাহ যেয়ারতঃ দীর্ঘ ছয় বছর মদিনায় অবস্থান করার পর রাসূল (স)-এর মন বায়তুল্লাহ যেয়ারতের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মহান সত্তার ঐশী বাণী পেয়ে রাসূল (স) কাবাঘর যেয়ারতের উদ্দেশে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা করেন।
৩. কুরাইশদের বাধা ও শিবির স্থাপনঃ রাসূল (স)-এর আগমনের সংবাদ শুনে মক্কার কুরাইশরা বীর খালেদ ও ইকরামার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীকে বাধা প্রদান করে। ফলে রাসূল (স) মক্কার নয় মাইল দূরবর্তী হােদায়বিয়া প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন।
৪. দূত প্রেরণঃ কুরাইশ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হলে রাসূল (স) দূত বুদাইলকে পাঠিয়ে তাদের জানালেন, শুধু ওমরা পালনের উদ্দেশেই আমাদের মক্কা আগমন। জবাবে কুরাইশরা ওরওয়া ইবনে মাসুদকে পাঠালে সে আলােচনা ভেঙ্গে যায়। প্রাথমিক আলােচনা ভেঙ্গে গেলে রাসূল (স) সন্ধি প্রস্তাব আলােচনার জন্য হযরত ওসমান (রা)-কে কুরাইশদের কাছে পাঠান।
৫. মিথ্যা জনরব ও বাইয়াতুর রিদওয়ানঃ হযরত ওসমান (রা) মক্কায় গেলে কুরাইশরা তাকে অন্যায়ভাবে আটকে রাখে। এদিকে ভিত্তিহীন জনরব ওঠে, কুরাইশরা হযরত ওসমানকে হত্যা করেছে। তখন মুসলিম বাহিনী রাসূল (স)-এর হাতে হাত রেখে শপথ করে, “নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে হলেও ওসমান হত্যার প্রতিশােধ নেবে।” এ শপথকেই বাইয়াতুর রিদওয়ান বলা হয়।
৬. সন্ধি স্বাক্ষরিতঃ মুসলমানদের শপথের সংবাদে কুরাইশ বাহিনীর টনক নড়ে। তারা হযরত ওসমান (রা)-কে ছেড়ে দেয় এবং সুহাইল ইবনে আমরের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল মুসলমানদের সাথে আলােচনায় বসে। দীর্ঘ আলােচনার পর উভয় পক্ষের চেষ্টায় একটি সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
হােদায়বিয়ার সন্ধির শর্তাবলিঃ
১. এ বছর (৬২৮ খ্রিস্টাব্দ) মুসলমানরা ওমরা না করে মদিনায় ফিরে যাবেন।
২. পরবর্তী বছর মাত্র তিন দিনের জন্য মক্কায় অবস্থানপূর্বক ওমরা পালন করতে পারবেন।
৩. মক্কায় প্রবেশকালে মুসলমানরা শুধু কোষবদ্ধ তরবারি ছাড়া অন্য কোনাে অস্ত্র সাথে রাখতে পারবেন না।
৪. মুসলমানরা মক্কায় অবস্থানকালে মক্কাবাসী নগরীর বাইরে চলে যাবে।
৫. কোনাে মক্কাবাসী মদিনায় আশ্রয় চাইলে তাকে আশ্রয় দেয়া যাবে না, কিন্তু কোনাে মুসলমান মদিনা থেকে মক্কায় চলে এলে মক্কাবাসীরা তাকে ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে না।
৬. মক্কার কোনাে নাবালেগ তার অভিভাবকের পূর্ব অনুমতি ব্যতীত মুসলমানদের দলে যােগদান করলে তাকে ফেরত দিতে হবে।
৭. আরব গােত্রগুলাে স্বাধীনভাবে যে কোনাে পক্ষের সাথে চুক্তি করতে পারবে।
৮. হােদায়বিয়ার সন্ধি দশ বছর যাবৎ স্থায়ী থাকবে।
৯. দশ বছর যাবৎ মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ থাকবে।
১০. সন্ধির মেয়াদকালে জনসাধারণের পূর্ণ নিরাপত্তা থাকবে এবং মক্কার বণিকগণ। নির্বিঘ্নে মদিনার পথ ধরে সিরিয়া, মিসর প্রভৃতি দেশে বাণিজ্য করতে পারবে।
১১. সন্ধির শর্তানুসারে একে অপরের কোনাে প্রকার ক্ষতি সাধন কিংবা কোনাে প্রকার লুণ্ঠন করবে না।
১২. সন্ধির শর্তাবলি উভয় পক্ষ পূর্ণরূপে পালন করবে।
১৩. আরবের যে কোনাে গােত্রের লােক মহানবী (স) অথবা কুরাইশদের সাথে সন্ধি সূত্রে আবদ্ধ হতে পারবে।
সন্ধির তাৎপর্য/ফলাফলঃ
১. সুস্পষ্ট বিজয়ঃ দৃশ্যত এ চুক্তির শর্তগুলাে মুসলমানদের স্বার্থবিরােধী হলেও এটা ছিল ইসলামের প্রকাশ্য বিজয়। মহান আল্লাহ এ সন্ধিকে সুস্পষ্ট বিজয় বলে উল্লেখ করেছেন।
২. মহাবিজয়ঃ মূলত এ সন্ধিতে ভবিষ্যতে মুসলমানদের মক্কা বিজয়সহ বিশ্ব বিজয়ের মন্ত্রবাণী নিহিত ছিল।
৩. ইসলাম প্রচারের সুযােগঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, এ সন্ধির ফলে মহানবী (স) ও মুসলমানগণ ইসলাম প্রচারে মনােনিবেশ করার সুযােগ পেলেন।
৪. মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রের সংহতিঃ হােদায়বিয়ার সন্ধির ফলে মদিনার শিশু রাষ্ট্রটি বহিঃশত্রুর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায়। ফলে এ রাষ্ট্রে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসে। মুসলমানগণ যুদ্ধ বিদ্যার পরিবর্তে ধর্মীয় শিক্ষার সুযােগ লাভ করেন। এতে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রীয় সংহতি ফিরে আসে।
৫. যুদ্ধবিরতিঃ হােদায়বিয়ার সন্ধির ফলে কুরাইশদের যুদ্ধংদেহী মনােভাবের অবসান ঘটে। ঐতিহাসিক হিট্টির মতে, এ সন্ধি নিজ গােত্র কুরাইশদের সাথে হযরত মহাম্মদ (স)-এর যুদ্ধবিরতির সূচনা করেছিল। ফলে মহানবীর নেতৃত্বে মুসলমানগণ নিজেদেরকে সুসংহত ও প্রশিক্ষিত করার সুযােগ লাভ করে।
৬. মহানবী (স)-এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাঃ ঐতিহাসিকগণ নির্দ্বিধায় হােদায়বিয়ার সন্ধিকে মহানবী (স)-এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার বহিঃপ্রকাশ বলে স্বীকার করেছেন।
৭. রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় মর্যাদাঃ হােদায়বিয়ার সন্ধি পরােক্ষভাবে ইসলামের রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় মর্যাদা বৃদ্ধি করে। রাষ্ট্র ও ধর্ম হিসেবে ইসলামের সম্প্রসারণের কথা চিন্তা করেই আবু বকর (রা) বলেন, হােদায়বিয়ার সন্ধির ফলে আমরা যেরূপ জয়ী হয়েছিলাম সেরূপ আর কখনােই হয়নি।
৮. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইসলামঃ হােদায়বিয়ার সন্ধির পরেই রােম, পারস্য মিসর, খােরাসান, বসরা, সিরিয়াসহ বহু দেশে মহানবী (স) ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানাের সুযােগ পান।
৯. খােজায়া গােত্র সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ঃ হােদায়বিয়ার চুক্তির শর্তানুসারে বিভিন্ন গােত্র মুসলমানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। এদের মধ্যে আরবের বিখ্যাত খােজায়া গােত্রও রয়েছে।
১০. সাংস্কৃতিক যােগাযােগঃ এ সন্ধির ফলে কুরাইশ ও মুসলমানদের মধ্যে সাংস্কৃতিক যােগাযােগ শুরু হয়। কেননা সংস্কৃতি হলাে একটি জাতিসত্তার নিজেকে প্রকাশের অন্যতম বাহন।
১১. মক্কা বিজয়ের সূচনাঃ হােদায়বিয়ার সন্ধির সুযােগে রাসূল (স) মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধি করেন। ফলে হােদায়বিয়া সন্ধির দু’বছর পর মুসলমানগণ বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, হােদায়বিয়ার সন্ধিই মক্কা বিজয় ত্বরান্বিত করেছিল।
১২. ইসলামের ছায়াতলে শ্রেষ্ঠবীরঃ এ সন্ধির মাঝখানে পূর্ণ এক বছর যেতেই খালেদ ইবনে ওয়ালিদ ও আমর ইবনুল আসের মতাে শ্রেষ্ঠ বীরদ্বয়সহ দলে দলে লােক ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।
১৩. কুরাইশদের ক্ষমতা হ্রাসঃ এ সন্ধির ফলে কুরাইশরা নিজেদের জালে নিজেরাই বন্দি হয় এবং তাদের শক্তি দিন দিন ক্ষীয়মান হতে থাকে। মহানবীর জীবনী। লেখক ইমাম যুহুরী বলেন- There was no man of sense and judgment among of the idolaters who was not led there by to join Islam.
১৪. কুরাইশদের মানসিক দুর্বলতাঃ এ সন্ধির ফলে মুসলমানগণ সাহসিকতা ও দৃঢ় চিত্তের পরিচয় দেন। ফলে কুরাইশরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। তাদের এ মানসিক দুর্বলতা মুসলমানদের জন্য মক্কা বিজয়ের ভিত রচিত হয়।
১৫. আর্থ-সামাজিক উন্নতিঃ হােদায়বিয়ার সন্ধির ফলে মুসলমানগণ আর্থ-সামাজিক অবকাঠামাের উন্নয়নে সুযােগ লাভ করেন। যুদ্ধ বিরতির ফলে মুসলিম ব্যবসায়ীরা নিরাপদে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জতিক বাণিজ্যে অংশ গ্রহণের পরিবেশ লাভ করে। মদিনার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উনতি হয়।
১৬. দক্ষিণ আরবে ইসলামঃ এ সন্ধির ফলে মুসলমান এবং অমুসলমানদের অবাধ মেলামেশার ফলে দক্ষিণ আরবের সাথে মদিনার সংযােগ স্থাপিত হয়। সেখানকার বানু দাউস গােত্রের একটি দল রাসূল (স)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে ইসলামের মূলমন্ত্রের সাথে পরিচিত হন।
১৭. কুটনৈতিক বিজয়ঃ এ সন্ধির অন্যতম শর্ত মক্কার কোনাে লােক মদিনায় গেলে তাকে ফেরত দিতে হবে-পরবর্তীকালে মক্কার কুরাইশদের ক্ষতির কারণ হয়। ফলে তারা এ শর্ত বাতিলের আবেদন জানায়। এভাবে মুসলমানগণ কূটনৈতিকভাবে জয় লাভ করেন।
১৮. মুসলিম শক্তির স্বীকৃতি লাভঃ ড. ইমামুদ্দিন বলেন, হােদায়বিয়ার সন্ধি মুসলমানদের একটি স্থায়ী রাজনৈতিক মর্যাদা প্রদান করে এবং খােদাদ্রোহী কুরাইশরা মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক শক্তিরূপে স্বীকার করে নেয়।
উপসংহারঃ হােদায়বিয়ার সন্ধি ইসলামের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়ের শুভ সূচনা করে এবং পরবর্তী স্বল্প সময়ের মধ্যেই ইসলাম আরবের বাইরে সর্বজনীনভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তাই হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) যথার্থই বলেছেন, হােদায়বিয়ার সন্ধির ফলে আমরা যেরূপ জয়ী হয়েছিলাম, সেরূপ আর কখনাে হইনি।