অথবা, দর্শনে স্বরূপ কী? দর্শনের সাথে লৌকিক জ্ঞানের সম্পর্ক আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ সত্যের অনুসন্ধান করতে গিয়েই দর্শনের উৎপত্তি ঘটেছে। দর্শন, বুদ্ধি, বিচার ও চিন্তা যুক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরমসত্তা, জগতও জীবনের সাথে জড়িত সমস্যাবলির সূক্ষ্ম ও যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা প্রদান করে। অন্যান্য বিষয়ের স্বরূপ বা প্রকৃতির মত দর্শনের স্বরূপ বা প্রকৃতি জানা যায় না। বরং তা জানতে হয় প্রতিটি আলােচ্য বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দর্শন কোনাে নৈর্ব্যক্তিক বিষয়ের আলােচনা নয়। বরং এটি জগত ও জীবনের সামগ্রিক আলােচনা। এই সামগ্রিক আলােচনার মাধ্যমেই দর্শনের স্বরূপ উন্মােচিত হয়। জীবনের সাথে দর্শনের যে গভীর সম্পর্ক তা মূলত দর্শনের স্বরূপ ও প্রকৃতির মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
দর্শনের স্বরূপ ও প্রকৃতিঃ দর্শনের স্বরূপ সম্পর্কে নিম্নোক্ত বিষয়গুলির উল্লেখ প্রয়ােজন। যথাঃ
(ক) বিস্ময়ই হলাে দর্শনের জনকঃ জীবন ও জগতের অনন্ত রহস্য মানব বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করে এবং তা থেকেই দর্শনের উৎপত্তি।
(খ) দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি সামগ্রিক, ব্যাপক ও সমন্বয়ীঃ বিজ্ঞান বিশ্ব জগৎকে জানতে গিয়ে খণ্ডখণ্ড বিষয় নিয়ে আলােচনা করে। দর্শন বিভিন্ন বিজ্ঞানের খণ্ডিত জ্ঞানসমূহ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমন্বিত করে একটি সার্বিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।
(গ) দর্শনের আলােচ্য বিষয় জগৎ-জীবন ও মানব অভিজ্ঞতাঃ বিজ্ঞান বস্তুকে অভিজ্ঞতার বিষয় হিসেবে না দেখে বস্তু হিসেবে দেখে থাকে। কিন্তু দর্শন বস্তুকে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের বিষয় হিসেবে দেখে থাকে। এভাবে দর্শন বস্তুর একটা পূর্ণাঙ্গ বিচার ও সমালােচনা করে।
(ঘ) দর্শনের কাজ হলাে ব্যাখ্যা ও মূল্যায়নঃ পরম আদর্শের স্বরূপ নির্ণয় ও তার পরিপ্রেক্ষিতে জীবনের মূল্যায়ন দর্শনের অন্যতম কাজ। এজন্য দর্শনকে বলা হয় জীবনের সমালােচনা। সুতরাং পরম সত্তা, জগৎ ও জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত সমস্যাবলির বিচার-বিশ্লেষণ দর্শনের প্রকৃত রূপ।
দর্শন ও লৌকিক জ্ঞানের সম্পর্কঃ নিম্নে এগুলাে আলােচনাপূর্বক দর্শন ও লৌকিক জ্ঞানের সম্পর্ক আলােচনা করা হলােঃ
দর্শনঃ আভিধানিক অর্থে দর্শন হচ্ছে জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ ও সত্যের অনুসন্ধান। দর্শন যুক্তি ও চিন্তার মাধ্যমে পরমসত্তা সম্পর্কিত বিষয়াবলির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা প্রদান করে। দর্শন জীবন ও জগতের লক্ষ্য অবধারণ করে। জগত ও জীবনের চলার পথে মানুষ যেসব মৌলিক সমস্যাবলির মুখােমুখি হয় দর্শন সেগুলাের ব্যাখ্যা দান করার প্রয়াস চালায়। আসলে দর্শন হচ্ছে জগত ও জীবনের প্রতি মানুষের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি। যাবতীয় সমস্যার যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টার মধ্যেই দর্শনের স্বরূপ বিদ্যমান।
লৌকিক জ্ঞানঃ লৌকিক জ্ঞান বলতে আমরা বুঝি, বিচার-বিবেচনা ও যুক্তিনির্ভরতা বিযুক্ত মতকে। লৌকিক জ্ঞানের উৎস কোনাে যৌক্তিক উপাদান নয়। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক প্রথা, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা, বিচ্ছিন্ন চিন্তাধারা লৌকিক জ্ঞানের উৎস হিসেবে ধরা হয়। লৌকিক জ্ঞানকে অনেকে লােকায়িত জ্ঞান বলেও অভিহিত করেন। জে.হসপার্স তার, “An Introduction to Philosophical” গ্রন্থে বলেন, “লৌকিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা যৌক্তিক কিছু পাই না। সবই হচ্ছে সাধারণ মানুষের মতাে”।
দর্শন ও লৌকিক জ্ঞানের সাদৃশ্যঃ দর্শন ও লৌকিক জ্ঞানের স্বরূপ আলােচনা করলে উভয়ের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তা নিম্নরূপঃ
প্রথমতঃ দর্শন হচ্ছে চিন্তার নীতিমালা সম্পর্কিত বিজ্ঞান। চিন্তার নীতিমালা অনুসরণের মধ্যদিয়েই দর্শন সত্যে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করে। আবার লৌকিক জ্ঞানের ক্ষেত্রেও ব্যক্তিচিন্তার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। কাজেই চিন্তাগত দিক থেকে উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
দ্বিতীয়তঃ দর্শনের পরিধি অত্যন্ত ব্যপক। জ্ঞানের এমন কোনাে শাখা নেই দর্শনের আলােচনার আওতাভুক্ত নয়। লৌকিক জ্ঞান ও জাগতিক বিষয়গুলােকে নিয়ে সার্বিকভাবে কাজ করে। কাজেই পরিধিগত দিক দিয়েও উভয়ের সাদৃশ্য চোখে পড়ার মতাে।
তৃতীয়তঃ দার্শনিক চিন্তাধারার লক্ষ্য হলাে মানবকল্যাণ। দর্শন যুক্তিভিত্তিক উপায়ে মানবকল্যাণে নিয়ােজিত। দর্শন ও লৌকিক জ্ঞান উভয় ক্ষেত্র থেকেই প্রাপ্ত জ্ঞান মানবস্বার্থ সংরক্ষণের কাজে নিয়ােজিত। সাধারণ লােক লৌকিক জ্ঞানের দ্বারা দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে থাকে।
চতুর্থতঃ দর্শন ও লৌকিক জ্ঞান উভয়েরই লক্ষ্য হলাে- জীবন ও জগতের মধ্যে যে অজানা রহস্য রয়েছে তা খণ্ডন করা।
পঞ্চমতঃ দর্শনের উৎপত্তির ক্ষেত্রে যেমন সংশয় কাজ করে। তেমনি লৌকিক জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রেও সংশয়ের প্রভাব লক্ষণীয়।
ষষ্ঠতঃ বিষয়বস্তুগত দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, জীবন ও জগতের মধ্যে যে রহস্য আছে তা উদঘাটন করে চরম সত্য প্রতিষ্ঠা করাই দর্শন ও লৌকিক জ্ঞানের মূল বিষয়বস্তু। আমরা এ দৃষ্টিকোণ থেকেও দর্শন ও লৌকিক জ্ঞানের সাদৃশ্যতা খুঁজে পাই।
দর্শন ও লৌকিক জ্ঞানের বৈসাদৃশ্যঃ দর্শন ও লৌকিক জ্ঞানের স্বরূপ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আলােচনা করলে উভয়ের মধ্যে কিছু বৈসাদৃশ্যও দেখা যায়, তা নিম্নে প্রদত্ত হলােঃ
প্রথমতঃ দর্শন জীবন ও জগত বিষয়ক মৌলিক প্রশ্নাবলির যৌক্তিক অনুসন্ধানে নিয়ােজিত। পক্ষান্তরে লৌকিক জ্ঞান কোনাে যুক্তি, বিচার-বিবেচনার ধার ধারে না বললেই চলে।
দ্বিতীয়তঃ দর্শন সবকিছুকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করে, মানব অভিজ্ঞতার কোনাে দিকই দর্শনের আলােচনা থেকে বাদ যায় না। অপরপক্ষে লৌকিক জ্ঞান মানবজীবনের সাময়িক বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত।
তৃতীয়তঃ দর্শন যুক্তির মাধ্যমে আলােচ্য বিষয়ের সমাধান করার চেষ্টা করে। পক্ষান্তরে লৌকিক জ্ঞান আলােচ্য বিষয়ের সমাধান করে লৌকিক উপায়ে।
চতুর্থতঃ দর্শনে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের কোনাে স্থান নেই, সাথে সাথে সেখানে স্থান নেই কোনাে অযৌক্তিক ব্যাখ্যার। অন্যদিকে লৌকিক জ্ঞান কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস মুক্ত নয়।
পঞ্চমতঃ দার্শনিক চিন্তাধারা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পদ্ধতিভিত্তিক। পক্ষান্তরে লৌকিক জ্ঞান সামঞ্জস্যহীন ও অসংলগ্ন।
ষষ্ঠতঃ দার্শনিক জ্ঞান পুরােপুরি নির্ভরযােগ্য। অপরপক্ষে লৌকিক জ্ঞান ততটা নির্ভরযােগ্য নয়।
পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও দর্শনঃ লৌকিক জ্ঞানের মধ্যে কিছু বৈসাদৃশ্য থাকার পরও এরা পরস্পর একে অন্যের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে নির্ভরশীল। কেননা সহজ বুদ্ধি বা লৌকিক জ্ঞানের অসামঞ্জস্যতা ও অনিশ্চয়তা থেকেই দর্শনের আগমন ঘটেছে। সহজ বুদ্ধি বা লৌকিক জ্ঞানের প্রাথমিক জ্ঞান ও দার্শনিকদেরকে সর্বোচ্চ স্তরের জ্ঞান বলা হয়। লৌকিক মতামতকে ছুঁড়ে ফেলার বা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করার প্রয়ােজন নেই যা প্রয়ােজন তা হলাে- (১) এগুলােকে যুক্তি দ্বারা বিচার বিশ্লেষণ করা; (২) বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও দার্শনিক প্রজ্ঞা জটিল পরিবেশের ওপর যে আলােকপাত করে তার প্রেক্ষিতে এগুলাে সংশােধন করা। তাহলেই লৌকিক জ্ঞান দর্শনের জ্ঞানে উন্নিত হবে। সুতরাং লৌকিক জ্ঞান দার্শনিক জ্ঞানের সূচনা করে। এভাবে তুলনা করে বােঝা যায় যে, লৌকিক জ্ঞান ও দর্শন পরস্পর ওতােপ্রােতভাবে নির্ভরশীল।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দর্শন ও লৌকিক জ্ঞানের মধ্যে নানাবিধ পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্তমান। চিন্তা ও পরিধিগত উভয়দিক দিয়েই দর্শন ও লৌকিক জ্ঞান সম্পর্কিত। তবে এ দুয়ের মধ্যে দার্শনিক জ্ঞানই মানবমনকে যথার্থভাবে তৃপ্ত করতে পারে। জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে দার্শনিক জ্ঞানই আমাদেরকে প্রকৃত সত্যের সন্ধান দিতে পারে। কিন্তু তাই বলে লৌকিক জ্ঞানকে অস্বীকার করা যায় না। লৌকিক জ্ঞান দর্শনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।