ভূমিকাঃ বর্তমান বিশ্বে প্রত্যেকটি রাষ্ট্র একে অপরের ওপর অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক প্রভৃতি বহুবিধ বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল; কোনাে রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সহযােগিতা ও তাদের পারস্পরিক বন্ধন, পারস্পরিক ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে আন্তর্জাতিক আইনের।
আন্তর্জাতিক আইন কীঃ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র যেসব বিধি-বিধান ও নিয়মকানুনের মধ্যে নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখে, তাই আন্তর্জাতিক আইন। আন্তর্জাতিক আইন মূলত যেসব বিধি-বিধানের সমন্বয়ে গঠিত, সেগুলােকে জাতিসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক বলে বিবেচনা করা হয়।
আর্ন্তজাতিক আইনের সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তা নিম্নে আলােচনা করা হলাে-
Oppenheim তার International Law নামক গ্রন্থে বলেন, যেসব চিরাচরিত সামাজিক বিধি-বিধানসমূহ সভ্য রাষ্ট্রসমূহ তাদের নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে বৈধভাবে অবশ্য পালনীয় বলে মনে করে, সেগুলােকে আন্তর্জাতিক আইন বলে বিবেচনা করা হয়।
Joseph Frankle -এর মতে, আন্তর্জাতিক আইন রাষ্ট্রসমূহের ওপর নয় বরং রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে কার্যকরী আইন।
Fenwick-এর মতে, আন্তর্জাতিক আইন হলাে সেসব সাধারণ নীতি এবং নির্দিষ্ট নিয়মের সমষ্টি যা, আন্তর্জাতিক সমাজের সদস্যগণ তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে মেনে চলে।
সুতরাং বলা যায়, যেসব বিধি-বিধান রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, রক্ষা, আন্তর্জাতিক বিরােধ নিষ্পত্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সব সময় মেনে চলার চেষ্টা করে, তাই আন্তর্জাতিক আইন।
আন্তর্জাতিক আইন কি সত্যিই আইনঃ আন্তর্জাতিক আইন সত্যিই আইন কিনা সে প্রশ্নে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মাঝে রয়েছে নানা বিতর্ক, নানা মত ও আলােচনা। আন্তর্জাতিক আইন আইন কিনা তার পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক যুক্তি রয়েছে, নিম্নে তা আলােচনা করা হলাে-
পক্ষের যুক্তিঃ হেনরি মেইন, ম্যাভিগনি প্রমুখ ঐতিহাসিক আইনবিদ এবং লরেন্স, কোলম্যান, পােলক প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে, আন্তর্জাতিক আইন সত্যিই আইন। কারণ তা স্বীকৃত শাশ্বত প্রথা, ন্যায় নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। আন্তর্জাতিক আইন যথার্থ আইন।
(১) উৎসঃ উৎসগত বিষয়ের দিক থেকে বিবেচনা করলে আন্তর্জাতিক আইন যথার্থ আইন। আন্তর্জাতিক আইন জাতীয় আইনের মতই বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান আকার ধারণ করেছে। আর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের উৎসগুলি মােটামুটি এক।
(২) সার্বভৌম আইনের একমাত্র শর্ত নয়ঃ সার্বভৌমের ঘােষণা ব্যতিত আন্তর্জাতিক আইনকে আইনের মর্যাদা থেকে বাদ দেয়া যৌক্তিক নয়। আর সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ আইনের প্রয়ােগের জন্য কখনােই আইনের উৎসের জন্য নয়। আন্তর্জাতিক আইন প্রয়ােগের বিশ্বে অনেক সংস্থা আছে। ফলে একে আইনের মর্যাদা দেয়া সঙ্গত।
(৩) শ্রদ্ধা ও আনুগত্যঃ জাতীয় আইনের প্রতি মানুষের যেমন শ্রদ্ধা আছে, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিও তেমন মানুষের শদ্ধা আছে। এ কারণেই বিভিন্ন রাষ্ট্র কোনাে আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করলে তা স্বীকার না করে ভিন্নভাবে তা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা চালায়। রাষ্ট্রসমূহের আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি এ ধরনের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রমাণ করে যে আন্তর্জাতিক আইন সত্যিই আইন।
(৪) বলবৎকরণঃ জাতীয় আইনের মত বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইনও বলবৎযােগ্য। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার আন্তর্জাতিক আইন প্রয়ােগ ও তা কার্যকর করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, সারাবিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ তা মেনে চলছে। তাই এক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক আইনকে আইন হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া যায়।
(৫) শাশ্বত প্রথাঃ ন্যায়নীতি ও জাতীয় আইনের মত আন্তর্জাতিক আইনও কতগুলাে শাশ্বত প্রথা ও ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর প্রথা ও রীতিনীতির ভিত্তিতেই আইনের সৃষ্টি। সুতরাং এ যুক্তিতে আন্তর্জাতিক আইন সত্যিই আইন।
(৬) শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাঃ আইন মান্য করা হয় রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে। আন্তর্জাতিক আইনকেও মান্য করা হয় আন্তর্জাতিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করার স্বার্থে। এ যুক্তিতে আন্তর্জাতিক আইন পরিপূর্ণ আইন। সুতরাং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন আইনগত শৃঙখলা প্রতিষ্ঠার যথাযথ প্রচেষ্টাস্বরূপ।
(৭) বিশ্বজনমত সৃষ্টিঃ আন্তর্জাতিক আইনের পক্ষে বর্তমানে সারাবিশ্বে জনমত গড়ে ওঠেছে। কোনাে রাষ্ট্র সরাসরি কোনাে আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করলে সারাবিশ্বে সমালােচনার ঝড় ওঠে। সুতরাং জাতীয় আইনের মত আন্তর্জাতিক আইনের জনপ্রিয়তাও তুঙ্গে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনকে আইন হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া যায়।
বিপক্ষের যুক্তিঃ আন্তর্জাতিক আইনের বিপক্ষেও অনেক যুক্তি রয়েছে। যেমন-
(১) সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সৃষ্ট নয়ঃ অস্টিনপন্থি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ মনে করেন, আন্তর্জাতিক আইন কোন Supreme authority কর্তৃক সৃষ্ট নয় বা প্রযুক্ত নয় বিধায় তাকে আইন হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া যায় না।
(২) শাস্তির ব্যবস্থাঃ আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শাস্তির কোনাে ব্যবস্থা নেই এবং তা মেনে চলতেও কোনাে রাষ্ট্র বাধ্য নয় । Laski মনে করেন, “International Law is only valid for a given state to the degree that it is prepared to accept its substance.”
(৩) কোন সুনির্দিষ্ট রূপ নেইঃ আন্তর্জাতিক আইন কতকগুলাে এলােমেলাে ও অসম্পূর্ণ নিয়মের সমষ্টি। এর কোন নির্দিষ্ট ও সর্বসম্মত রূপ নেই। সুযােগ-সুবিধা ও অবস্থার প্রেক্ষিতে বিভিন রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে একে ব্যাখ্যা করে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক আইন সত্যিকার অর্থে আইন কিনা তার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মত রয়েছে। তবে বর্তমান বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়ােজনীয়তা উত্তরােত্তর বদ্ধি পাচ্ছে। তাই বর্তমানকালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ আন্তর্জাতিক আইনকে পরিপূর্ণ আইনের মর্যাদা দিতে আগ্রহী। আন্তর্জাতিক আইনের একটি বড় অনুমােদন হলাে জাতিসংঘ ও বিশ্বজনমত।