অথবা, ব্রিটিশ সংবিধানের বৈশিষ্ট্যগুলাে লিখ।
অথবা, ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর।
অথবা, ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের প্রকৃতি বর্ণনা কর।
অথবা, ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের স্বরূপ বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ বর্তমান বিশ্বের সংবিধানগুলাের মধ্যে ব্রিটেনের সংবিধানই সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবিধানের উপর এর প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ প্রভাব বিরাজমান। তাই Prof. Munro বলেছেন, “The British constitution is the mother of all constitution.” এ সংবিধান কেউ তৈরি করে নি। এটি বিভিন্ন ঐতিহাসিক সনদ বা দলিল, পার্লামেন্টের আইন, প্রচলিত প্রথা বা রীতিনীতি, বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত প্রভৃতির মাধ্যমে দীর্ঘ কয়েক শতাব্দীর বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে।
ব্রিটিশ সংবিধানের বৈশিষ্ট্যঃ ব্রিটেনের সংবিধান কোন দলিলে লিপিবদ্ধ না হলেও এর কার্যকারিতা, শাসনব্যবস্থার স্বরূপ প্রভৃতি বিচার করে এ সংবিধানের নিলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলাে লক্ষ্য করা যায়ঃ
১. অলিখিত সংবিধানঃ ব্রিটিশ সংবিধান প্রধানত অলিখিত এবং এর উপাদানসমূহ প্রথা, রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। তাই টমাস পেইন একে সংবিধান বলতে নারাজ। ফরাসি ঐতিহাসিক টকভিল বলেছেন, “ব্রিটিশ সংবিধানের কোন অস্তিত্বই নেই।” অবশ্যই পৃথিবীর কোন সংবিধানই সম্পূর্ণ লিখিত নয়। লিখিত ও অলিখিত অধ্যায়ের সমন্বয়েই সংবিধান গঠিত হয়। এখানেও কিছু কিছু লিখিত উপাদান রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, ১২১৫ খ্রিস্টাব্দের ম্যাগনাকার্টা, ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দের পিটিশন অব রাইটস, ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দের বিল অব রাইটস, ১৭০১ খ্রিস্টাব্দের অ্যাক্ট অব সেটেলমেন্ট ও পরবর্তী সময়ের প্রতিনিধি নির্বাচনের আইনসমূহ ব্রিটিশ সংবিধানের স্তম্ভস্বরূপ।
২. ধারাবাহিকতা ও বিবর্তনশীলতাঃ এ সংবিধান একদিনে বা একটি নির্দিষ্ট সময়ে তৈরি হয় নি অথবা কোন মতবাদ হতেও এর উৎপত্তি হয় নি। যুগ যুগ ধরে স্বাভাবিক নিয়মে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান রূপ লাভ করেছে। ক্রমিক ধারাবাহিকতায় এটি অনন্য। তাই অধ্যাপক মনরাে (Munro) একে ‘A Process of Growth’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ডাইসির মতে, “The English constitution has not been made; it has grown.” এটি বিবর্তনের উত্তম ফসল। প্রকতপক্ষে, ব্রিটিশ সংবিধান ধীর, স্থির ও মন্থর গতিতে পরিবর্তিত হতে হতে বর্তমান রূপ লাভ করেছে।
৩. এটি নমনীয়ঃ এ সংবিধানটি অত্যন্ত নমনীয়। কেননা প্রয়ােজন অনুসারে আইন প্রবর্তনের পদ্ধতিতেই একে পরিবর্তিত করা চলে। এতে কোন জটিলতার সৃষ্টি হয় না। শাসনতান্ত্রিক আইন ও সাধারণ আইনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তবে মতবাদের দিক থেকে ব্রিটেনের সংবিধানকে নমনীয় বললে কার্যত ইংরেজদের রক্ষণশীলতার জন্য এটি তেমন সুপরিবর্তনীয় নয়। ফাইনার এর মতে, “The British constitution is the most flexible constitution among the states.”
৪. এককেন্দ্রিক সংবিধানঃ ব্রিটেনের সংবিধান আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় বা কানাডার ন্যায় যুক্তরাষ্ট্রীয় নয়। একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রের সমুদয় শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করে। রাজা ও পার্লামেন্ট রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। স্বায়ত্তশাসিত কাউন্টি বা বরাে (Borough) প্রভৃতি কতকগুলাে স্থানীয় সরকার আছে এবং এদের কিছু ক্ষমতাও আছে। তবে এদের অস্তিত্ব পুরােপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
৫. নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রঃ এটি বলা প্রয়ােজন যে, ব্রিটেনে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র সমাসীন রয়েছে। রাজা এখানে। নামেমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। প্রকৃত প্রস্তাবে তার ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। অধ্যাপক অগ (Ogg) বলেছেন, “ব্রিটেনের যুক্তরাজ্যের শাসনব্যবস্থা আইনত অবাধ রাজতন্ত্র, তবে এটি কার্যত গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। তাই বলেছেন, “The king reigns but does not govern.”
৬. দুর্বল বিচার বিভাগঃ মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান বিরােধী এবং ন্যায়নীতি বিরােধী যে কোন আইনকে বাতিল করে দিয়ে সংবিধানের পবিত্রতা অক্ষুন্ন রাখে। কিন্তু ব্রিটেনের বিচার বিভাগ পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ব্যাখ্যা করতে পারলেও তার বৈধতা বিচার করতে পারে না। তাই ব্রিটেনের বিচার বিভাগকে দুর্বল বিচার বিভাগ বলে অভিহিত করা হয়।
৭. অবাস্তবতাঃ ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের সাথে বাস্তব কার্যধারার যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তাই এরূপ শাসনতন্ত্রকে অনেকে অবাস্তব শাসনতন্ত্র বলে অভিহিত করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তত্ত্বগতভাবে রাজা বা রাণীর পরামর্শদাতা হল মন্ত্রিপরিষদ। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, মন্ত্রিপরিষদই হল দেশের প্রকৃত শাসক আর রাজা বা রাণী হলেন তাদের উপদেষ্টা মাত্র।
৮, সরকারের দায়িত্বশীলতাঃ ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য সরকারের দায়িত্বশীলতা। মন্ত্রিপরিষদ আইন পরিষদের নিকট দায়ী থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করে। আবার এটি জনসাধারণের নিকটও দায়ী রয়েছে। রাজার নিকটও মন্ত্রিপরিষদ দায়ী। সুতরাং দায়িত্বশীলতা ছাড়া এটি অনুধাবন করা অত্যন্ত কঠিন।
৯. মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারঃ ব্রিটিশ সরকার যথার্থই মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিপরিষদ ব্রিটেনের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়ােগ করে থাকে। কমন্সসভার আস্থাভাজন হয়ে এটি ক্ষমতা প্রয়ােগ করে। পার্লামেন্টের আস্থা হারালে মন্ত্রিপরিষদ ক্ষমতাচ্যুত হয়। অন্যদিকে, মন্ত্রিপরিষদ জনগণ এবং রাজা বা রাণীর নিকটও দায়ী থাকে। তবে পার্লামেন্টের নিকট বিশেষ করে কমন্সসভার নিকট এর দায়িত্বশীলতা মৌলিক।
১০. পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বঃ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব। পার্লামেন্টের উপর কোন আইনগত বাধানিষেধ আরােপ করা যায় না। পার্লামেন্ট যে কোন আইন প্রণয়ন, সংশােধন বা বাতিল করতে পারে। আদালত পার্লামেন্টের সব আইনকেই বৈধ বলে প্রয়ােগ করে।
১১. আইনের শাসনঃ ব্রিটেনের সংবিধানের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হল আইনের শাসন বা আইনের প্রাধান্য। ব্রিটেনের জনসাধারণ বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা শাসিত হয়। নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানই হল আইনের শাসনের মূলকথা।
১২. সুপরিবর্তনীয় সংবিধানঃ ব্রিটেনের সংবিধান সুপরিবর্তনীয়। এরূপ সংবিধান সংশােধন বা পরিবর্তন সাধনের জন্য বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বনের কোন প্রয়ােজন নেই। সাধারণ আইন প্রণয়নের পদ্ধতিতেই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এ শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন সাধন করতে পারে।
উপসংহারঃ উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলাে কোন একটি নির্দিষ্ট দলিলে লিপিবদ্ধ নেই। বিভিন্ন উৎসের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের উপাদানসমূহ নিহিত আছে। তাছাড়া এ সংবিধান কোন ব্যক্তি বা সংস্থা কর্তৃক নির্দিষ্ট কোন দিন বা সময়ে তৈরি হয় নি।