অথবা, সামাজিক ইতিহাসের বিষয়বস্তু ও সাম্প্রতিক ধারা বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ ‘Society is a wave of social relationships and it is always changing. (MacIver)। পরিবর্তনশীল সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ও সামাজিক মূল্যবােধের পরিবর্তন ধারাকে কেন্দ্র করে সামাজিক ইতিহাস গড়ে ওঠে। সামাজিক ইতিহাস মূলত পরিবর্তনশীল সমাজের দর্পণ। মানবসমাজের আচার-আচরণ, প্রথা-প্রতিষ্ঠান, আর্থ-সামাজিক সংগঠন প্রভৃতির মূর্ত প্রতিচ্ছবি সামাজিক ইতিহাসে ফুটে ওঠে এবং স্বয়ং মানুষ সম্পর্কে যে ইতিহাস আলােচনা করে তাই সামাজিক ইতিহাস।
সামাজিক ইতিহাসের বিষয়াদিঃ সমাজের মানুষের সার্বিক জীবনযাপন প্রণালিই সামাজিক ইতিহাসের কাঙিক্ষত বিষয়াবলী। নিম্নে তা ধারাবাহিকভাবে আলােচনা করা হলােঃ
(১) সামাজিক ইতিহাস সমাজের পূর্ণাঙ্গ পাঠ।
(২) সামাজিক ইতিহাস সমাজের গঠন প্রণালি তথা সমাজের কাঠামােগত উপাদান নিয়ে আলােচনা করে।
(৩) সামাজিক ইতিহাস সমাজ তথা সমাজকাঠামাের যুক্তি তথা বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ প্রদান করে থাকে।
(৪) নৈতিকতার প্রশ্নে সমাজ ইতিহাস নিরপেক্ষ।
(৫) সামাজিক ইতিহাসে ব্যক্তি ও সমষ্টির উত্থান-পতন ও ক্রমবিকাশ, অপরাধপ্রবণতা ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়।
(৬) সামাজিক ইতিহাসে সমাজের গতি ও শক্তির পরিবর্তনশীলতা ও মাত্রাভেদ প্রভৃতি পরিলক্ষিত হয়। (৭) সমাজের উন্নতির পর্যায় ও বিভিন্ন ধরনের সমাজের অভ্যুদয় সামাজিক ইতিহাসে পরিস্ফুটিত হয়।
(৮) সামাজিক ইতিহাস সমাজস্থ মানুষের অতীত জীবনযাপন প্রণালি, তথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলােচনা করে থাকে।
সামাজিক ইতিহাসের সাম্প্রতিক ধারাঃ সাম্প্রতিককালে সামাজিক ইতিহাস যেসব বিষয় নিয়ে আলােচনা করে সেগুলাে নিম্নরূপঃ
(১) সমাজকাঠামাে নিয়ে আলােচনা করেঃ বর্তমান সামাজিক ইতিহাস সমাজকাঠামাে সম্পর্কে আলােচনা করতে নগরায়িত ও শিল্পায়িত সমাজের ইতিহাসের ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যেখানে আগে বাজা-বাদশাদের নিয়ে আলােচনা হতাে সেখানে বর্তমানে সমাজকাঠামাের উত্থান-পতনের ওপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচিত হচ্ছে।
(২) সমাজকাঠামাের রূপান্তরঃ আজকের সমাজকাঠামাে হয়ে যাচ্ছে আগামী দিনের ইতিহাস। কাজেই সমাজ কাঠামাের রূপান্তর সামাজিক ইতিহাসে বেশ গুরুত্ব সহকারে আলােচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে সমাজ যেভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে এতে করে সমাজকাঠামাে অধ্যয়ন না করলে সমাজ ইতিহাসের এক বিরাট অস্তিত্ব নষ্ট হয়ে যেত।
(৩) শ্রেণি ও দলঃ সমাজের সকল দল ও শ্রেণি প্রাচীন ইতিহাসের আলােচনায় আসেন না। আর সেই রাজা বাদশাহদের দলকে আলােচনায় না এনে সমালােচনাকে মাথায় রেখে বর্তমান সামাজিক ইতিহাস সমাজের সকল দল ও শ্রেণির উদ্ভব ও ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা করে।
(৪) জনগােষ্ঠি ও জনগােষ্ঠির মধ্যকার সম্পর্কঃ আধুনিক সামাজিক ইতিহাস জনসংখ্যা সমস্যা, সমাধান ও জনগােষ্ঠির মধ্যকার আত্মীয়তা নিয়ে আলােচনা করে। প্রাচীন ইতিহাসে সাধারণ জনগণের আলােচনা নেই।
(৫) সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থাঃ প্রাচীন ইতিহাস এবং সামাজিক ইতিহাস রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বেশি গুরুত্ব দিত। কিন্তু সাম্প্রতিক সামাজিক ইতিহাস রাজনীতির পাশাপাশি সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপরও বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে।
(৬) অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানঃ সামাজিক ইতিহাস সমাজের ছােট-বড় সব অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে আলােচনা করে। যেমনঃ পরিবারের উৎপত্তি, বিকাশ ও বিবর্তন নিয়ে সামাজিক ইতিহাসে সাম্প্রতিককালে ব্যাপক আলােচনা করা হচ্ছে।
(৭) সংস্কৃতিঃ প্রাচীন ইতিহাস রাজাদের সংস্কৃতি নিয়ে আলােচনা করতাে। সামগ্রিক সংস্কৃতি নয়। তবে আধুনিক ইতিহাস সমাজ ও তার সংস্কৃতিকে নিয়ে আলােচনা বা অধ্যয়নের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্ব দিয়েছে।
(৮) যুদ্ধ-বিগ্রহঃ প্রাচীন ইতিহাসের রেশ ধরে সমাজের বিভিন্ন যুদ্ধ-বিগ্রহের তারিখ এবং বিভিন্ন দেশের সামরিক জয়-পরাজয়গুলাে সামাজিক ইতিহাস আলােচনা করে।
(৯) জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখাঃ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমনঃ নৃ-বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, মনােবিজ্ঞান ইত্যাদির উৎপত্তি ও আলােচনার পরিধি সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞান আলােচনা করে।
(১০) যৌক্তিকঃ পূর্বের ইতিহাস ছিল কাহিনী-উপাখ্যানভিত্তিক। কিন্তু যুক্তিশীল না হলে সুধী সমাজে সামাজিক ইতিহাসের কোন দাম নেই। কাজেই সাম্প্রতিক সামাজিক ইতিহাস যুক্তিনির্ভর। বর্তমান সমাজে সামাজিক ইতিহাস মূলত সমাজের সবগুলাে দিক নিয়ে আলােচনা করে।
পরিশেষঃ উপযুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি যে, সামাজিক ইতিহাস সাম্প্রতিককালে মানুষের ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস পায়। সমাজস্থ মানুষের আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, ক্রিয়াকলাপ, পরিবর্তনশীল সামাজিক সম্পর্ক এবং বিশ্বাস ও মূল্যবােধের যুক্তি ও প্রমাণনির্ভর বিজ্ঞানভিত্তিক অধ্যয়নই সামাজিক ইতিহাস। সামাজিক ইতিহাসের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক।