অথবা, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে বর্ণিত জেলেদের করুণ পরিণতির চিত্র উপস্থাপন কর।
উত্তরঃ অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের প্রদত্ত উক্তিতে তিতাস নদী-তীরে গােকঘাটের মালােদের ধ্বংসোন্মুখ চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে।
মালােদের মধ্যে ঐক্য ছিল বজ্রের মতাে, পাড়াতে তারা ছিল আঁটসাঁট, সামাজিকভাবে সুদৃঢ় গাঁথুনির মধ্যে সংঘবদ্ধ। কেউ তাদের কিছু বলার সাহস করেনি। পাড়ার মধ্যে যাত্রা দল ঢুকে তাদের সেই ঐক্যে ফাটল ধরায়। সুলভ চাকচিক্যময় আধুনিক ‘বাবু’ সংস্কৃতির পাদমূলে তাদের অমূল্য সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার মুখ থুবড়ে পড়ে। মালােদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অবলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবনে করুণ বিপত্তি নেমে আসে। যাত্রাদলের কাছে পরাজয়ে মালােরা একেবারেই আত্মসত্তা হারিয়ে বসে। তাদের ব্যক্তিত্ব, বৈশিষ্ট্য, সংস্কৃতি ধীরে ধীরে লােপ পেতে থাকে। তাদের নিজস্ব একটা সামাজিক নীতির বন্ধন ছিল, সেটিও ক্রমে ক্রমে আলগা হয়ে যায়। একসঙ্গে কাজ করতে তারা আর জোর পেতাে না- সামান্য বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে তারা ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায়। বর্ষাকালে তিতাসে জলে পূর্ণ হলেও কিছুদিন পরে তা একেবারে শুকিয়ে ছােটো খালে পরিণত হয়- দূরদূরান্ত থেকে জোতদার-জমিদাররা লাঠিয়াল নিয়ে আসে তিতাসের চর দখল নিতে। পরস্পর লাঠালাঠি করে তিতাসের চর তারা দখল করে নেয়। জেলেরা শুধু তীরে বসে সে দৃশ্য দেখলাে। যতদিন জল ছিল- তিতাস ছিল তাদের; এখন জল নেই চর আছে জমি হয়েছে জোতদারদের। সময়-সুযােগমতাে আবার জোতদারের লাঠিয়াল বাহিনি মালােদের বাড়িসােজা চরের মাটি দখলের জন্য ঝাপিয়ে পড়ে। রামপ্রসাদ বাধা দিতে গিয়ে প্রাণ হারায়- করমআলি, বেন্দ আলি প্রভৃতি ভূমিহীন চাষীরা এসেছিল। কিন্তু তারা মার খেয়ে ফিরে গেল- কেউ.এতটুকু মাটির দখল রাখতে পারেনি। শেষে দেখা গেল যাদের জোর বেশি- তারাই তিতাসের বুকের নয়া-মাটির- সবকিছুর মালিক হয়ে বসে। উপন্যাসের অন্তিম পর্যায়ে মহামারীর মতাে মৃত্যু এসে মালােদেরকে নিশ্চিহ্ন ও সর্বস্বান্ত করে দেয়। সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে কোনাে রকমে টিকে থাকে বাসন্তী আর কিশােরের বৃদ্ধ পিতা রামকেশব। যারা মরেছে তারা একপ্রকার রক্ষা পেয়েছে। আর যারা বেঁচে আছে তারা যেন মৃত্যুরই প্রতীক্ষা করছে- মৃত্যু আর কতদূর। তিতাসও যেন তাদের কথার জবাব দেয়- আর বেশি দূরে নয়।
মালােরা চেয়েছিল মালােদের দুঃসময়ে শিক্ষিত অনন্ত যেন সরকারের কাছে একটি চিঠি লিখে মালােদের বেঁচে থাকার একটা উপায় বের করে দেয়। কিন্তু বিপদের সময়ে মালােরা অনন্তকে পাশে পায়নি। অনন্ত কুমিল্লার শাহরিক পরিবেশে শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠলেও গােকনঘাটের মালো সম্প্রদায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক মেরুদূর। অনন্তবালারা চলে যায় আসামে। নিস্তব্ধ ও প্রায়লুপ্ত বিশাল মালােপড়া কালের সাক্ষী হয়ে হতশ্রী রূপ নিয়ে পড়ে থাকে। লেখাপড়া শেখার ফলেই সে যেন শ্রেণিচ্যুত হয়ে উঠে গেছে ওপরের শ্রেণিতে। রামকেশব ও বাসন্তীর অন্তিম সময়ে মানব কল্যাণের নামে তাদের মুখােমুখি হলেও পরিচয় গােপন করেছে অনন্ত। উপন্যাসের পরিণতিতে লেখক মালােপাড়ার যে হতদশা অঙ্কন করেছেন তা একান্তভাবে হৃদয়স্পর্শীঃ
“ধানকাটা শেষ হইয়া গিয়াছে। চরে আর একটিও ধানগাছ নাই। সেখানে এখন বর্ষার সাতার জল। চাহিলে কারাে মনেই হইবে না যে এখানে একটা চর ছিল। জলে থই থই করিতেছে। যতদূর চোখ যায় কেবল জল। দক্ষিণের সেই সুদূর হইতে ঢেউ উঠিয়া সে ঢেউ এখন মালােপাড়ার মাটিতে আসিয়া লুটাইয়া পড়ে। কিন্তু এখন সে মালােপাড়ার কেবল মাটিই আছে। সে মালােপাড়া আর নাই। শূন্য ভিটাগুলিতে গাছ গাছড়া হইয়াছে। তাতে বাতাস লাগিয়া সস সসা শব্দ হয়। এখানে পড়িয়া যারা মরিয়াছে, সেই শব্দের তারাই বুঝি বা নিঃশ্বাস ফেলে।”
সুতরাং বলা যায়- জেলেদের দখল ছিল জলে, জল হারিয়ে তারা হয়ে পড়ে বাষ্পের মতাে ভাসমান। তিতাস নদীর জল হারানাের সাথে সাথে তারাও সবকিছু হারিয়ে আত্মহারা হয়ে পড়ে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় তিতাস তীরের স্থানিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গে এতদঞ্চলের মালাে সম্প্রদায়ের আশা আকাঙ্ক্ষা, হতাশা বেদনা এবং উত্থান পতনের বিস্ময়কর কাহিনি শিল্পসফলভাবে উপস্থাপন করেছেন। সমাজ জীবনের অন্তর্কাঠামাের পরিবর্তনের সঙ্গে সংগীত রেখে চৈতন্য প্রবাহও যে পরিবর্তিত হয়ে যায় তা এ উপন্যাসের বিপুল পরিসরে প্রত্যক্ষ করা যায়।