উত্তরঃ
নামকরণের প্রাথমিক কথাঃ নামের মধ্য দিয়েই কোনকিছুর সাথে আমাদের প্রাথমিক পরিচয় ঘটে। শিরােনাম হলাে শনাক্তকারী প্রতীক। নামের মাধ্যমে ব্যক্তি বস্তু শিল্পকর্ম বা যে-কোন বিষয়ের মৌল বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণও আর্টের অন্তর্ভুক্ত। উৎকৃষ্ট নামকরণ আয়নার মতাে শিল্পের মূল উপজীব্য প্রতিফলিত করে। একারণেই সার্থক সাহিত্যকর্মের অন্যতম শর্ত অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ নামকরণ। কবি-সাহিত্যিকগণ মূলভাব, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, কেন্দ্রীয় চরিত্র, রূপক বা প্রতীকধর্মিতা, তার জীবনদৃষ্টি প্রভৃতির আলােকে সাহিত্যকর্মের নামকরণ করেন।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের (১৯১৪-১৯৫৬) ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ [১৯৫৬] বাংলাদেশের আঞ্চলিক উপন্যাস সাহিত্যে একটি অনবদ্য ও যুগান্তসৃষ্টিকারী সংযােজন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত তিতাস-তীরবর্তী অঞ্চলের দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত, সংগ্রামশীল, পরিশ্রমজীবী, ধীবর সম্প্রদায়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা, হতাশা-বেদনা, শ্রম-বিশ্রাম, সংকীর্ণতা- ঔদার্য লেখক শিল্পরূপ দিয়েছেন এ উপন্যাসে। এ উপন্যাসের বিষয় আলােচনার মাধ্যমে আমরা নামকরণের সার্থকতা বিচার করব। এ উপন্যাসে তিতাস তীরের স্থানীয় বৈশিষ্ট্যসমূহের মাধ্যমে মালােদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, হতাশ, বেদনা মােট কথা তাদের ধ্বংসের বিস্ময়কর কাহিনির সঙ্গে যে সব সফল চরিত্র উপস্থাপনা অদ্বৈত মল্লবর্মণ করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান চরিত্র তিতাস নদী। তিতাস নদীকে এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বলা হয়।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক কেন্দ্রীয়ভাবে এমন কোনাে একটি চরিত্রকে বিকশিত করেননি, যাকে ঘিরে আবর্তিত হতে পারতাে অন্যান্য চরিত্র। রচনাটিতে স্থান পেয়েছে তিতাস তীরের মালােদের জীবনের একের পর এক ঘটনা। তিতাস একটি নদী- সে বয়ে যায় নিজের মতাে। তার মাছের ভাণ্ডার দিয়ে সে সাহায্য করেছে মালােদের। এবং এভাবেই এ উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিতাস নদী থেকেছে ক্রিয়াশীল। ফলে, উপন্যাসটির অন্যতম চরিত্রে যেন রূপায়িত হয়েছে তিতাস নদী। একটি আঞ্চলিক উপন্যাসের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে নির্দিষ্ট ভৌগােলিক পটভূমির সঙ্গে লেখকের অন্তরঙ্গ সংশ্লিষ্টতা।
তিতাস নদীর উৎসস্থল ও মােহনার মাঝামাঝি সাদকপুর থেকে নবীনগর, গােকনঘাট, আমিনপুর, বিরামপুর, ভৈরববাজার, নয়াকান্দা, শুকদেবপুর, উজানিনগর পর্যন্ত বিস্তৃত নদীর প্রবাহ পথই এ উপন্যাসের নির্বাচিত ভৌগােলিক পরিবেশ প্রসঙ্গে উপন্যাসে বলা আছে যে, ‘ঝড় তুফানের রাতেও তিতাসের বুকে মাছ ধরতে যাওয়া স্বামীপুত্রদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয় না স্ত্রীরা, মায়েরা। কারণ, তিতাস প্রকৃতিতে শান্ত।’
এ ভৌগােলিক পরিসরে অবস্থানকারী জনগােষ্ঠীর জীবন তিতাস নদী ও তার আচরণের বাইরে খুব একটা যায়নি। এ উপন্যাসের কাহিনি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রথাগত সাংগঠনিক কাঠামাে অনুসৃত হয়নি বললেই চলে। তিতাস তীরের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার সমাবেশ ঘটিয়েই যেন উপন্যাসটি তৈরি করা হয়েছে। লেখক যেন প্রকৃতির মতাে ভ্রুক্ষেপহীনভাবে তার চিত্রগুলাে সাজিয়ে গেছেন। তবে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার প্রতিবেশের সঙ্গে উপন্যাসের মূল সুরের রয়েছে সুগভীর ঐক্য।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে শ্রমজীবী মালােদের চিরায়ত চিত্র বর্ণিত হয়েছে। উপন্যাসের চরিত্রগুলাে এ নিঃস্ব জীবনের প্রবহমান দ্বন্দ্বে বিকশিত হয়েছে। শত বৈরিতা ও প্রতিকূলতার মধ্যে বেঁচে থেকেই এসব চরিত্রের শক্তি ও প্রাণ নির্মিত হয়েছে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে যেমন তার ‘দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্যা সী’তে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা, মানুষের সংগ্রাম, ম্যাগনিচিউড ও জীবনের সমস্যাকে উন্মােচিত ও চিহ্নিত করেছেন, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস’ও তেমনি একটি দৃঢ় পদচিহ্ন।
অতএব, তিতাসের স্রষ্টা হিসেবেই অদ্বৈত একজন বড়াে লেখক হয়ে ওঠেন। রাইন, টেমস, সীন বা দানিয়ুবের মতাে ক্ষুদ্র নদীর তীরে যেমন গড়ে উঠেছিল নদীকেন্দ্রিক ইউরােপীয় সভ্যতা, তেমনি তিতাসের তীরেও গড়ে উঠেছিল এক সৃষ্টিশীল জীবন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে জেলে পল্লির খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলা হয়েছে। লেখকের সাবলীল বর্ণনায় এ উপন্যাসের চরিত্রগুলাে বাস্তব হয়ে উঠেছে। উপন্যাসের প্রধান দুই চরিত্র বাসন্তী ও তিতাস নদী। বাসন্তী বৈরী শক্তির বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী চরিত্র। আর ‘তিতাস নদী’ জেলে জীবনের উৎস ও প্রতীক। ঔপন্যাসিকের ভাষায়
“তিতাস একটি নদীর নাম। ক্লজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভােরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়, রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।”
এই তিতাসকে ঘিরে রয়েছে গ্রাম বাংলার মালােদের সংগ্রাম ও প্রতিরােধের কাহিনি। তিতাসের দীর্ঘপথে তারা নৌকা চালায়। উপন্যাসে মালাে পাড়ার বর্ণনা, মসজিদ ও মক্তবের বর্ণনা তিতাসের সাথে একাকার হয়ে গেছে। জীবনের গভীরতা এসেছে বিজেশ্বর গ্রাম, বিরামপুর, সাদকপুর, আনন্দ বাজার, জগৎ বাজার, কালীসীমার ময়দান ও গরীবুল্লার বটগাছের উল্লেখে ও লেখকের বর্ণনার সত্যতায়।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীর তীরবর্তী মালাে জেলেদের কর্ম-ধর্ম-স্বপ্ন সংস্কৃতিভিত্তিক জীবন নিয়ে রচিত। শুধু এ অঞ্চলের মানুষের কাহিনি এবং তার সীমার মধ্যেই সেটি আবদ্ধ থেকেছে। এমনকি কাহিনিটি নিকটস্থ কুমিল্লাতেও বিস্তৃত হতে পারেনি। সে কারণে, উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে একটি অঞ্চলভিত্তিক। সেদিক থেকে বলা যেতে পারে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ একটি ভৌগােলিক অঞ্চল নির্ভর হয়ে সূচিত ও বিকশিত হয়েছে। ঐ অঞ্চলের অখণ্ডতা কাহিনির কোন পর্যায়ে খণ্ডিত হয়নি। উক্ত অঞ্চলের বাইরের মানুষ ও প্রকৃতির ব্যাপক কোনাে খোঁজ খবরও উপস্থাপিত হয়নি এ রচনায়। উপন্যাসটির নির্দিষ্ট ভৌগােলিক পরিসরের মধ্যে থেকে উপন্যাসের চরিত্রগুলাে নিয়ত সংগ্রামশীল থেকে বেঁচে থাকার জন্য। চলমান জীবনে তাদের দুঃখবহ পরিণতি রচনার কুশলতায় গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। এসব বৈশিষ্ট্যের আলােকে তিতাস একটি নদীর নাম’কে অনেকে আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে একজন সমালােচক বলেছেন, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় যে জীবনকে অঙ্কন করেছেন, সে জীবন নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত মানসের অভিজ্ঞতা বহির্ভূত। তিতাস বিধৌত জনপদের স্থানিক বর্ণনার সঙ্গে সে অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার বিশ্বস্ত রূপায়ণসূত্রে এ উপন্যাসী হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বাংলাদেশের আঞ্চলিক উপন্যাস সাহিত্যে এটি একটি কালজয়ী সংযােজন।
শুধু কল্পনা ও অনুভূতি দিয়ে কোনাে অঞ্চলের স্থানীয় বৈশিষ্ট্য উপন্যাসে উপস্থাপন করা একজন লেখকের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে অবস্থানের মাধ্য অর্জিত অভিজ্ঞতা যদি লেখকের কল্পনা ও অনুভূতির সঙ্গে সমন্বিত হয়, তা হলে জন্ম নিতে পারে একটি সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাস। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ক্ষেত্রে প্রায় এমনটি ঘটেছে বলা যেতে পারে। মালাের সন্তান অদ্বৈত তিতাস পাড়ের মালাে জীবনের সঙ্গে আজন্ম সম্পর্কিত। মালােদের জীবনের বঞ্চনা ও যন্ত্রণার সঙ্গে সুপরিচিত বলেই অদ্বৈতের পক্ষে এ ধরনের একটি উপন্যাস লেখা সহজতর হয়েছে।
উপন্যাসটির কাহিনি বা ঘটনার সূত্রপাত ঘটে পূজা ব্রতকে কেন্দ্র করে, দিননাথ মালাের মেয়ে বাসন্তীর মাঘমণ্ডলের বতে চৌয়ারি বানানাে এবং ভাসানাে নিয়ে। এ পূজার মাধ্যমে কুমারী মালাের কন্যারা উপযুক্ত বর প্রার্থনা করা। কিশাের ও সুবলের মাধ্যমে তৈরি হয় বাসন্তীর চৌয়ারি। তা কেন্দ্র করেই দূরন্ত দুই বালকের অনুরাগ জন্মে বাসন্তীর প্রতি। কুমারী কন্যাদের জন্য চৌয়ারি ব্যবস্থার মাধ্যমে বর প্রার্থনা জেলেদের রীতি। শত দুঃখবেদনার মধ্যে তারা তাদের এ উৎসব অনুষ্ঠান করে থাকে। এখানে এ ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির ঘটে স্বাভাবিক যােগাযোেগ। এর মধ্য দিয়েই সূচিত হয় কিশাের, সুবল ও বাসন্তীর ভবিষ্যতের জীবনবােধ। কিশােরের প্রতি বাসন্তীর অনুরাগ প্রকাশ পায় তার কথায়। সুবলের মধ্যেও কিশাের ও বাসন্তীর পরস্পরের প্রতি অনুরাগ সম্পর্কিত ধারণা বদ্ধমূল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে বাসন্তী ও সুবলের বিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমাণ করে কিশাের।
শুকদেবপুরে অবস্থান করার মধ্যে যেন কিশােরের জীবনবােধের পরিবর্তন ঘটে। সেখানে খলা বাইতে যাওয়া আসার পথে নদী প্রকৃতির বহু বিচিত্র রূপ কিশাের সুবলের জীবনের সঙ্গে যেন নিবিড়ভাবে সংশ্নিষ্ট হয়ে পড়ে। নদী পথেই তারা সেখানে উপস্থিত হয়েছে। নদীকে অবলম্বন করেই যেন কিশাের লাভ করেছে সুন্দরী নর্তকী স্ত্রী। আবার নদী পথেই ডাকাত হরণ করেছে তার স্ত্রী ও অর্থ। নদী পথ অথবা নদীনির্ভর জীবন প্রায়ই ঝুঁকিপূর্ণ। মেঘনার যে মােহনায় তারা বিপদগ্রস্ত হলাে সেটিও বিপদসঙ্কুল। এ প্রসঙ্গে উপন্যাসে বলা আছে-
“মােহনাটি সত্যই ভয়ংকর। এপার হইতে ওপারের কুল কিনারা চোখে ঠাহর করা যায় না। হু হু করিয়া চলিতে চলিতে স্রোত এক একটা আবর্তের সৃষ্টি করিয়াছে। দুই ধারের স্রোত মুখােমুখি হইয়া যে ঝাপটা খাইতেছে, তাহাতে প্রচণ্ড শব্দ করিয়া জল অনেক উপরে উঠিয়া ভাঙিয়া পড়িতেছে।”
নদীই যেন বাসন্তীকে ভাসিয়ে এনেছে সুবলের কাছে। আবার সে নদীই কেড়ে নিয়েছে তার প্রাণ। নদীর উথান পতনের ঢেউই যেন সুখ দেয়নি বাসন্তীকে। স্বামীর মৃত্যুতে তাকে আজীবন থাকতে হয়েছে বিধবা। নদীই তার দুঃখের মূল। চার বছর পর কিশােরের স্ত্রীর অনন্তসহ গােকনঘাটে ফিরে আসা এ উপনাসের উল্লেখযােগ্য বাঁক। নদীর সঙ্গে এমন সাক্ষাৎ না ঘটলে গােকনঘাটের কঠিন বাস্তবতা তাকে করতাে না স্পর্শ। সুতাে কাটার কাজ করে তাকে করতে হতাে না জীবিকা নির্বাহ। উপন্যাসে আঞ্চলিকতা প্রসঙ্গে জীবন বাস্তবতার এ দৃষ্টান্ত অনেকটা যথার্থ। একইভাবে বিবেচনাযােগ্য গােকনঘাটে অনন্তর মায়ের স্থায়ী বসতি হওয়া। এ বিষয়ে বলা আছে-
“অবশেষে উঠিল অনন্তর মার কথা। তার বুক দূর দূর করিতে লাগিল। এ কথাটাও ভারতকেই তুলিতে হইল, নতুন যে লােক আসিয়াছে, আপনারা সকলেই শুনিয়াছেন। তারে নিয়া কীভাবে সমাজ করিতে হইবে আপনার বলিয়া যান। তারে কার সমাজে ভিড়াইবেন, কিষ্ট কাকার, না দয়াল কাকার, না বাসন্তীর বাপ কাকার…. রামপ্রসাদ জিজ্ঞাসা করিল, কারে কারে লইয়া তাের সমাজ? সুবলার শ্বশুর আর কিশােরের বাপেরে লইয়া। তা হইলে নতুন মানুষ লইয়া তাের সমাজ হইল চাইর ঘর। হ কাকা।”
শুধু মালােরাই নয়, তিতাস তীরের মুসলমানদের জীবনের সঙ্গেও নদীর সংযুক্ত গভীরভাবে। তিতাসকে কেন্দ্র করে তাদের জীবনও আবর্তিত। কাদির মিয়া ছাদির মিয়ার মাধ্যমে সে নির্ভরশীলতার চিত্র ফুটে উঠেছে উপন্যাসে। তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য আলু বাজারে নেওয়া হয় নদী পথেই। সে সময়ের তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ নদীর ছবি উপন্যাসের উপস্থাপিত হয়েছে বাস্তবভাবে। জন্ম-মৃত্যু বিয়ের ক্ষেত্রে মালাে সমাজের নিয়ম নীতি, ধর্মাচার, এমনকি মায়ের মৃত্যুর পর সন্তানের হবিস্যি পালনের প্রথাও উপন্যাসে তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। শুধু গােকনঘাট নয়, নবীনগরের মানুষের জীবনাচারের নানা প্রসঙ্গও উপস্থাপিত হয়েছে উপন্যাসের এ পর্যায়ে। একটি এলাকার নানাবিধ বিবরণ ও চিত্র থাকায় তিতাস একটি নদীর নাম আঞ্চলিক উপন্যাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
উপন্যাসের ‘রাঙা নাও’ পর্বে স্থানীয় পরিবেশ আরাে ভালােভাবে ফুটে উঠেছে। নৌকা বাইচ একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। এর সঙ্গে জড়িত কাঠ সংগ্রাহক, করাতি, মিস্ত্রি নকশাকার প্রভৃতি। প্রতিযােগীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাউল ভাটিয়ালি গায়কদের অবেগময় উচ্ছাস তিতাস তীরবাসীদের জীবনে আনন্দ সঞ্চারক। কাহিনির এক পর্যায়ে নদীই কাছে এনে দিয়েছে অনন্ত ও অনন্তবালাকে তৈরি করেছে রমু ও অনন্তর বন্ধুত্ব। অনন্তবালা গড়তে চেয়েছে অনন্তর সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক অনন্তর জীবনে নদী এসেছে বার বার নদীর বাকের মতােই। অনন্ত নদী পথেই গােকনঘাট এসেছিল। এখানে মা মারা যাওয়ার পর নদীর আশেপাশে ঘুরে ফিরে অনন্ত সঙ্গী হয় উদয়তারা ও বনমালীর। তাদের সঙ্গে নদীপথে নবীনগর আসে সে। এখানে এসেই সে যেন পায় তার জীবনের সঠিক ঠিকানা। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর নাপতানির পরামর্শে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য কুমিল্লা শহরে চলে যাওয়ার পেছনেও যেন নদী থেকেছে ক্রিয়াশীল। এ উপন্যাসে একমাত্র অনন্তই তিতাস পরিধির বাইরে গেছে, অন্য সব চরিত্র থেকেছে তিতাস নদীর আওতায়।
মালাে সম্প্রদায় এতই প্রকৃতি নির্ভর এবং সেই অর্থে অসহায় যে, তিতাসই যেন তাদের ঈশ্বর। তিতাসের বুকে চর জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মাছ ধরার পথ বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধ হয়ে যায় তাদের অর্থ উপার্জনের উৎস। তাদের ক্ষুধা আছে, কিন্তু তা নিবৃত্তির বিকল্প কোন পথ নেই তিতাসে মাছ ধরা ছাড়া। ফলে দ্রুত তাদের জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। সংগত কারণেই এই উপন্যাসের কাহিনিতে তিতাস নদী পালন করেছে বড়াে একটি ভূমিকা। এই ভূমিকাকে আশ্রয় করে প্রাধান্য লাভ করেছে স্থানীয় বৈশিষ্ট্য। এ কারণে একজন সমালােচক বলেছেনঃ
“আঞ্চলিক জীবনের সরল ও নিপুণ বিন্যাসে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে অসাধারণত্বে ভাস্বর।”
সুতরাং সার্বিক আলােচনার মাধ্যমে বলা যায়- ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কোনাে রক্ত মাংসময় চরিত্র নয়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র স্বয়ং তিতাস নদী। তিতাসকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র আবর্তিত হয়েছে। তিতাস ছাড়া কোনাে চরিত্রই আদি মধ্য অন্ত্য সমন্বিত সমগ্র নয়। কিশাের, কিশােরের স্ত্রী, সুবল, বাসন্তী, অনন্ত, কেউই এ উপন্যাসে বিকশিত হয়ে ওঠেনি। বিশেষ কোনাে চরিত্র নয়, মূলত তিতাস তীরের সমগ্র মানুষের জীবনালেখ্য রচনাই ছিল লেখকের অন্তর্গত উদ্দেশ্যে। লেখক তিতাসের প্রবহমানতার সঙ্গে তাঁর তীরবর্তী জনপদকে একীভূত করে অঙ্কন করেছেন। যতদিন তিতাস তীরের অধিবাসীরা ছিল আত্মসচেতন, প্রাণরসে উদ্দাম, ততদিন তিতাস নদীও ছিল বহমান ও চলমান। পক্ষান্তরে যখনই তিতাস তীরবর্তী পরিশ্রমজীবী মাললা সম্প্রদায় হয়ে পড়ে আত্মউদাসীন, আত্মসংস্কৃতিবিরূপ, তখন তিতাসও হয়ে পড়ে বন্ধ্যা ও স্থবির। তাই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে- নামকরণের দিক থেকে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ শিল্পসফল এবং সার্থক।