অথবা, ভাববাদ ও বাস্তববাদের মধ্যে বৈসাদৃশ্য হলাে উল্লেখ কর।
ভূমিকাঃ জ্ঞান জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্ক প্রকাশ করে। যিনি জানেন তার নাম জ্ঞাতা। সমস্ত জ্ঞানেই কোনাে একজন লােক কোনাে একটি বস্তু জানে। সুতরাং জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় সম্পর্কই জ্ঞান। আমাদের আলােচ্য প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে বাস্তববাদের স্বরূপ উল্লেখ করে, বাস্তববাদ ও ভাববাদের মূল বিতর্কটি তুলে ধরতে সচেষ্ট হব।
বাস্তববাদ ও ভাববাদের পার্থক্য/বৈসাদৃশ্যঃ জ্ঞেয় বস্তু মন-নিরপেক্ষ না মন সাপেক্ষ সত্তা, এটাই হচ্ছে বাস্তুবাদ ও ভাববাদের মূল বিতর্কের বিষয়। এ সম্পর্কে উভয় মতবাদের যুক্তিগুলাে নিম্নে উল্লেখ করা হলাে-
(১) বাস্তববাদ অনুসারে জ্ঞেয় বস্তু মন-নিরপেক্ষ সত্তা। যেমন – গাছ-পালা, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদির অস্তিত্ব মানুষের মনের ওপর নির্ভরশীল নয়। মানুষের মনের বাইরে এদের অস্তিত্ব বিদ্যমান। অপরদিকে ভাববাদ অনুসারে, বস্তু হচ্ছে সত্তার জ্ঞান নির্ভর অভবাস, জ্ঞানের অতিরিক্ত সত্তা নয়। কারণ বস্তুর অস্তিত্ব নির্ভর করে বস্তুকে জানার ওপর। আমরা কখনও আমাদের চিন্তার জগৎ অতিক্রম করতে পারি না। সেজন্য বস্তুর অস্তিত্ব আমাদের চিন্তা বা জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে।
(২) বাস্তববাদের মতে, বস্তুর সাথে জ্ঞানের সম্পর্কটি বাহ্যিক। বস্তুর সাথে জ্ঞানের বাহ্য সম্পর্ক প্রমাণ করে যে জ্ঞেয় বস্তু জ্ঞান বা মন-নিরপেক্ষ। এই অপর দিকে ভাববাদের মতে, বস্তুর সাথে জ্ঞানের অন্তর সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, বস্তুর অস্তিত্ব জ্ঞাননির্ভর। অজ্ঞাত বস্তুর কোনাে জ্ঞানই থাকতে পারে না। বস্তুর সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক বস্তুর জ্ঞাননির্ভরতা প্রমাণ করে।
(৩) বাস্তববাদের মতে বস্তুর সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক বস্তুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং বস্তু জ্ঞান-নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র সত্তা। যেমন কালাে কাকের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না থাকলে, ‘কাক যে কালাে’- এরূপ জ্ঞান আমাদের হতাে না।
(৪) বাস্তববাদীরা বস্তুকেন্দ্রিক। আর ভাববাদীরা আত্মকেন্দ্রিক।
(৫) বাস্তববাদ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী। অপর পক্ষে ভাববাদীরা উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী।
(৬) বাস্তববাদ অনুসারে গােটা জগতে যা কিছু দেখি সবই বাস্তব। পক্ষান্তরে ভাববাদ অনুসারে গােটা জগৎটাই হচ্ছে এক মায়া বা মিথ্যার জগৎ।
(৭) বাস্তববাদীরা জড়কৈ মন থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করেন। পক্ষান্তরে ভাববাদীরা জড়কে মনের ওপর স্থাপন করেন।
(৮) বাস্তববাদের প্রকৃতি জড়াত্মক, অপরপক্ষে ভাববাদের প্রকৃতি আধ্যাত্মিক।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বাস্তববাদ ও ভাববাদ দুটিই চরমপন্থী মতবাদ। এ দু’টি মতবাদের মধ্যে বিতর্ক শেষ হওয়ার নয়। তবে এদের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য বস্তুগত ভাববাদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। বস্তুগত ভাববাদ অনুযায়ী, জীবাত্মা ও জড় জগৎ মূলত এক ও অভিন্ন। কারণ উভয়ই পরমাত্মার প্রকাশ।