অথবা, সমালােচনাসহ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদটি বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকাঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদ অত্যন্ত প্রাচীন। প্লেটো ও এরিস্টটলের দর্শনে সামাজিক চুক্তির সন্ধান পাওয়া যায়। এ বিশ্বজগতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি কখন কীভাবে হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা অত্যন্ত কঠিন। যুগে যুগে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্র উৎপত্তির রহস্য উদঘাটনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন ও বিভিন্ন মতবাদ প্রচার করেছেন। এর মধ্যে সামাজিক চুক্তি মতবাদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টমাস হবস, লক ও রুশাের কাছ থেকে আমরা সামাজিক চুক্তি মতবাদের পূর্ণ ব্যাখ্যা ও সমর্থন পাই।
সামাজিক চুক্তি মতবাদের ধারণাঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটি জনগণের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করেছে। সামাজিক চুক্তিবাদীদের মতে, আদিম যুগে রাষ্ট্রের কোন অস্তিত্ব ছিল না। শাসক বা আইন-কানুন কিছুই ছিল না। মানুষ তখন প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করতাে। তখন সমাজে প্রাকৃতিক আইন নামে এক ধরনের আইনের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু এমন এক সময় এলাে যখন প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠল ও মানুষ বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হলাে। ফলে সেই অবস্থা হতে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করতে উদ্যোগী হয়। এই চুক্তিকেই সামাজিক চুক্তি মতবাদ বলে।
সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমর্থনঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রকৃত সমর্থক হলেন বৃটেনের টমাস হবস, জন লক এবং ফরাসি দার্শনিক জ্যা জ্যাক রুশাে। এ ব্যাপারে তিনজনই একমত যে, প্রকৃতির রাজ্যের অবস্থার হাত হতে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে।
হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদঃ ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লেভিয়াথান’-এ সামাজিক চুক্তি মতবাদের বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। হবস বলেন, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। একে অন্যের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকত। হবসের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, কলহপ্রিয়, কেউ কাউকে বিশ্বাস করত না, সবল দুর্বলকে অত্যাচার করত। প্রকৃতির রাজ্যে কোনাে শাসক ছিল না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভের আশায় মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করল।
জন লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদঃ ইংরেজ দার্শনিক লক ১৬৯০ সালে ‘Two Treatise on Civil Government’ নামক গ্রন্থে সামাজিক চুক্তি মতবাদটি ব্যাখ্যা করেন। লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে সাম্য, স্বাধীনতা ও শান্তি বিরাজ করত। প্রাকৃতিক আইনের অধীনে মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করত। কিন্তু সেখানে কতগুলাে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সমস্যাগুলাে হলাে- প্রথমতঃ প্রাকৃতিক আইনের কোনাে সুস্পষ্ট সংজ্ঞা ছিল না। দ্বিতীয়ত, এই আইনের ব্যাখ্যার কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। তৃতীয়তঃ এই আইন বলবৎ করার কোনাে কর্তৃত্বসম্পন্ন সংস্থা ছিল না। এ সমস্যাগুলাে দূর করার জন্য মানুষ স্বেচ্ছায় ও সর্বসম্মতিক্রমে চুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাজ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। লকের মতে দুটি চুক্তি হয়েছিল একটি সামাজিক চুক্তি ও আরেকটি সরকারি চুক্তি।
রুশাের সামাজিক চুক্তি মতবাদঃ ফরাসি দার্শনিক রুশাে ১৭৬২ সালে ‘The Social Contract’ গ্রন্থে সামাজিক চুক্তি মতবাদের পূর্ণ ব্যাখ্যা দান করেন। তার মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল সহজ, সরল, উত্তম ও সহানুভূতিশীল। সেখানে কোনাে হিংসা, দ্বেষ ও প্রতিশােধ স্পৃহা ছিল না। প্রকৃতির রাজ্য ছিল এক আদর্শ রাজ্য। তিনি এ অবস্থাকে পৃথিবীর স্বর্গ’ বলে অভিহিত করেন। কিন্তু ক্রমশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সম্পত্তির ধারণায় প্রকৃতির রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। এ অবস্থার অবসানের জন্য মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। এ চুক্তির ফলে জনগণ তাদের সকল ক্ষমতা সামগ্রিকভাবে সমাজ তথা একটি সাধারণ ইচ্ছার ওপর অর্পণ করে। রুশাের চুক্তিতে সাধারণ ইচ্ছা হলাে সার্বভৌম।
সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমালােচনাঃ নিম্নে সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমালােচনা আলােচনা করা হলাে-
(১) অনৈতিহাসিকঃ রাষ্ট্রের উদ্ভব যে সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে হয়েছে তার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। চুক্তির দ্বারা রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস কোথাও পাওয়া যায় না। কাজেই এটা অনৈতিহাসিক।
(২) অযৌক্তিকঃ আইনের ধারণার পূর্বে চুক্তিবলে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হতে পারে না। এটা একটা অযৌক্তিক বক্তব্য।
(৩) ক্ষণস্থায়ীঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদ দীর্ঘস্থায়ী নয়। কারণ অতীতে চুক্তির মাধ্যমে যারা রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল, তাদের মৃত্যুর সাথে-সাথে রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটেছে। সুতরাং যে চুক্তি স্বেচ্ছায় হয়েছিল তা আবার স্বেচ্ছায় ভেঙ্গে গেছে।
(৪) কাল্পনিকঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদটি কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে এর কোনাে মিল নেই। স্যার হেনরি মেইন অসংখ্য প্রাচীন আইন ও প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যের আলােকে প্রমাণ করেছেন যে, চুক্তির ন্যায় সূক্ষ্ম ধারণা আদিম মানুষের মধ্যে কখনও হতে পারে না। সুতরাং সামাজিক চুক্তি মতবাদটি কাল্পনিক ও অবাস্তব।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক চুক্তি মতবাদ একেবারে মূল্যহীন নয়। এর একটি মূল্যবান অবদান হলাে ব্যক্তিদের গােড়াপত্তন। লক ও রুশাে উভয়েই বলেছেন যে, মানুষ নিজেই তাদের রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ন্ত্রক। তাদের জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার এবং সম্পত্তির অধিকার সংরক্ষণের জন্যই মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করেছিল।
Assalamu alikum