অথবা, সার্বভৌমত্বের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচ্য বিষয়সমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত হয়। যে চারটি উপাদানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র গঠিত তাদের মধ্যে সার্বভৌমত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযােগ্য উপাদান। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও স্বরূপ বহুলাংশে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকৃতি ও অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। Prof. Gettle মনে করেন, সার্বভৌমত্বের ধারণাটি আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভিত্তিস্বরূপ। এটি সকল প্রকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কও নিয়ন্ত্রণ করে।
সার্বভৌমত্বের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশঃ আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের সাথে সার্বভৌমত্বের ধারণাটি ওতপ্রােতভাবে সম্পর্কযুক্ত। সার্বভৌমত্বের বর্তমান ধারণার বিকাশ সাধনে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ পর্যায়ক্রমে অবদান রেখেছেন। নিম্নে সেগুলাে পর্যায়ক্রমে আলােচনা করা হলাে-
(১) প্রাচীন গ্রিক ও রােমান ধারণাঃ সার্বভৌমত্ব শব্দটি নতুন হলেও এর ধারণা অতীতকালের। প্রাচীন গ্রিক ও রােমান যুগের লেখকগণ চরম ক্ষমতা অর্থে সার্বভৌমত্বের ধারণাটি ব্যবহার করতেন। এরিস্টটলের আমলেও সার্বভৌমত্বের ধারণা ছিল অস্পষ্ট। এরিস্টটলের মতানুসারে এই ক্ষমতা একজন, কয়েকজন বা বহুজন ব্যবহার করতে পারেন। আধুনিক অর্থে সার্বভৌমত্বের এ ধারণা গ্রহণ করা যায় না। রােমান সাম্রাজ্যের আমলেও সার্বভৌমিকতার ধারণা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি।
(২) মধ্যযুগে সার্বভৌমত্বঃ মধ্যযুগে ধর্মগুরু পােপকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্য সভ্যতা গড়ে ওঠে। এ সময় সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ পর্যায়ে সমাজের বিভিন্ন লােক বিভিন্ন ধরনের অধিকার ভােগ করত এবং নিয়ন্ত্রণের কোনো সুনির্দিষ্ট কর্তৃত্ব ছিল না। কোকারের মতানুসারে তখন সব কিছু ছিল চার্চের কর্তৃত্বাধীন, রাষ্ট্রের নয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে রোমক আইনের চর্চাকে কেন্দ্র করে জনগণের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত ধারণার সৃষ্টি হয়। ত্রয়ােদশ শতাব্দীর অ্যাকুইনাস চরম ক্ষমতার ভিত্তি হিসেবে জনগণের কথা বলেছেন। মারসিগলিও এবং অকহ্যাম এই ধারণাকে সম্প্রসারিত করেন।
(৩) ষােড়শ শতাব্দীর সার্বভৌমত্বঃ পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে সমাজব্যবস্থার চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। জনসাধারণ শক্তিশালী একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করতে থাকে। ফলে ষােড়শ শতাব্দীতে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং সঙ্গে সঙ্গে সার্বভৌমিকতার ধারণা সৃষ্টি হয়। ষােড়শ শতাব্দীর ধর্মীয় সংঘর্ষই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের উৎস। এই সময় শান্তি ও ঐক্যের জন্য রাজার কর্তৃত্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সার্বভৌমিকতার ধারণাও বিকশিত হয়েছে।
(8) সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে ম্যাকিয়াভেলীর ধারণাঃ পঞ্চদশ শতাব্দীর পরিষদ আন্দোলনের ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র চিন্তার ইতিহাসে মধ্যযুগের অবসান হয় এবং আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয়। ষােড়শ শতাব্দীর ইতালীয় চিন্তানায়ক ম্যাকিয়াভেলী রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ইঙ্গিত দেন। এ সময় রাষ্ট্রের ওপর গীর্জার প্রভাব হ্রাস পায় এবং ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। এরূপ যুগসন্ধিক্ষণে পঞ্চধাবিভক্ত ইতালির একত্রীকরণে ন্যাকিয়াভেলী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত আধুনিক জাতীয় সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণা প্রচার করেন।
(৫) জিন বডিনের ধারণাঃ জিন বডিন সার্বভৌমত্বকে রাষ্ট্রের নির্দেশদানকারী, নিরংকুশ ও স্থায়ী ক্ষমতা বলে বর্ণনা করেছেন। তার মতে “আইনের দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত নাগরিক ও প্রজাগণের ওপর প্রযুক্ত সর্বময় ক্ষমতাই হলাে সার্বভৌমিকতা।” বস্তুত জিন বডিনই প্রথম রাষ্ট্রের উপাদান হিসেবে সার্বভৌমিকতার স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। তবে তার সার্বভৌম ক্ষমতা ঐশ্বরিক আইন, প্রাকৃতিক আইন এবং সাংবিধানিক আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ। অন্যান্য রাষ্ট্র ও জনগণের সাথে রাজার চুক্তি দ্বারাও সার্বভৌমত্ব সীমিত।
(৬) থমাস হবসের ধারণাঃ থমাস হবসও সার্বভৌম ক্ষমতাকে চূড়ান্ত ও অপ্রতিহত ক্ষমতা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি তার লিভিয়েথান গ্রন্থে বর্ণনা করেন, জনগণ প্রকৃতির রাজ্যের বিভীষিকা থেকে মুক্ত হবার জন্য কীভাবে নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে তাদের শাসন করার অধিকার শাসকের হাতে তুলে দেয় এবং শাসক বা রাজাকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী করে তােলে। তার মতে, সার্বভৌমত্ব অসীম, অবিভাজ্য, স্থায়ী এবং চরম ক্ষমতা।
(৭) গ্রোটিয়াসের ধারণাঃ সপ্তদশ শতাব্দীর ডাচ আন্তর্জাতিক আইনবিদ গ্লোটিয়াস সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তিনি সার্বভৌমিকতার বাহ্যিক দিকের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন। তিনি সার্বভৌম রাষ্ট্রের বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীনতা এবং বিভিন্ন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সম-মর্যাদার কথা বলেছেন। এর ফলে আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম হয়ে ওঠল।
(৮) জন লকের ধারণাঃ সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ রাষ্ট্র দার্শনিক জন লক আধুনিক গণতন্ত্রের জনক হিসেবে পরিচিত। তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘ট্র ট্রটিজেস অন সিভিল গভর্নমেন্ট’-এ সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করেছেন। তার মতে, শাসকের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকবে না। তার সার্বভৌমত্বের ধারণা তার সামাজিক চুক্তির ধারণা থেকে ক্ষমতার উৎস বলে ধারণা ব্যক্ত করেন। এ চূড়ান্ত ক্ষমতাই সার্বভৌম ক্ষমতা।
(৯) রুশাের ধারণাঃ অষ্টাদশ শতকের অবিসংবাদিত ফরাসি রাষ্ট্র দার্শনিক রুশাে তার অমর গ্রন্থ ‘দি স্যোসাল কন্ট্রাক্ট’-এ সার্বভৌম তত্ত্বের ধারণা ব্যক্ত করেন। তিনি তার সাধারণ ইচ্ছা মতবাদে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা সুদৃঢ় কণ্ঠে প্রকাশ করেন। তার মতে, ‘জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস’। তার মতে, সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট রাজনৈতিক সমাজই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। চুক্তি অনুসারে সকলেই তাদের অধিকার সকলের কাছে সমর্পণ করে একটি সাধারণ ইচ্ছার অধীনে এল।
(১০) জন অস্টিন-এর ধারণাঃ জন অস্টিন সার্বভৌমত্বের একাত্ববাদের তত্ত্ব প্রচার করেন। উনবিংশ শতাব্দীতে তিনি সার্বভৌমিকতার ধারণাটি বিশেষভাবে বিকশিত করেন। প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌমিকতার ধারণা বিকাশের ক্ষেত্রে তার অবদান অপরিসীম। তিনি আইনগত সার্বভৌমত্বের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন। তার মতে, যদি কোনাে নির্দিষ্ট ঊর্ধ্বতন মাননীয় কর্তৃপক্ষ অন্য কোনাে উধ্বতনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন না করে এবং কোনাে বিশেষ সমাজের অধিকাংশের স্বভাবগত আনুগত্য লাভ করতে থাকে, তাহলে সেই সমাজে উক্ত নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ হলাে সার্বভৌম। তার মতে সার্বভৌম আদেশই আইন।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব বা ধারণা একদিনে গড়ে ওঠেনি। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বর্তমানে সাবভৌমতু বলতে রাষ্ট্রের অধীন সকল ব্যক্তি প্রজা এবং সংঘের ওপর মৌলিক, চরম এবং সীমাহীন ক্ষমতাই হলাে সার্বভৌমত্ব। এই ক্ষমতাবলে রাষ্ট্র বহিঃশত্রুর নিয়ন্ত্রণমুক্ত।