উত্তরঃ ওসমান চরিত্রটিকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের প্রতীকী ও কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওসমান ও তার পরিপার্শ্ব এবং পরিচিতের সীমার মধ্যেই উপন্যাসের মূল ভাষ্য ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। ফলে ওসমানের প্রতি লেখকের মনোেযােগ ছিল সবচেয়ে বেশি। সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে ওসমানও মধ্যবিত্তের সন্তান। তার মনােজগৎ মধ্যবিত্ত সুলভ মানসিকতায় পূর্ণ।
ওসমান চিলেকোঠার বাসিন্দা। সে রহমতউল্লাহর চিলেকোঠায় বাস করে। বাবা ইব্রাহিম শেখ ইন্ডিয়ায় থাকে। আর ওসমান থাকে ঢাকায়। সে আর্মানিটোলা স্কুলে পড়াশােনা করেছে। সে চাকরি করে ইপিআইডিসিতে। ওসমানের ভাবনা মনে মনে- স্বপ্ন কল্পনা ও ভাবনার পুষ্টিতে তার বেঁচে থাকা। উপন্যাসের শুরুতে পাওয়া যায় ওসমানের দেখা। শেষেও ওসমান। উপন্যাসের সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করে আছে যে চরিত্র, সে ওসমান। অথচ এই উপন্যাসের মূল ঘটনাপঞ্জির সাথে তার সম্পৃক্ততা সবচেয়ে কম। সে শুধু ঘটনার একজন দর্শক মাত্র। পর্যবেক্ষণও করে না। কারণ পর্যবেক্ষণের সাথে জড়িয়ে আছে পর্যালােচনা। গণআন্দোলন বা প্রায় ঘটতে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান নিয়ে কোনাে পর্যালােচনা তাকে করতে দেখা যায়নি উপন্যাসের কোথাও। পুরান ঢাকায় আইয়ুব খানের অনুসারী মহাজন রহমতউল্লাহর বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠার একমাত্র ঘরে তার বসবাস। সেখান থেকে সে দেখতে পায় বেবিট্যাক্সি, রিকসা, নারায়ণগঞ্জগামী বাসের পাশাপাশি হেঁটে চলা মানুষের ভিড় ও মিছিল। অফিসে যাওয়ার পথে বাহাদুর শাহ পার্কে জনসভা দেখে। পল্টনেও জনসভা দেখে। রেস্টুরেন্টে বসে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় বন্ধুদের কাছে শােনে আন্দোলন সংগ্রামের কথা। কিন্তু নিজে থাকে ফেলে আসা বাপের চিন্তায়, এই বাড়ির দোতালার ভাড়াটের মেয়ে রানুর চিন্তায়, অন্য বন্ধুদের চিন্তায়।
সে নীরব বিদ্রোহী চিন্তার ফ্রেমে তার আন্দোলন সংগ্রাম। তার বাসার নিচের বাসিন্দা তালেব স্বৈরচারীর গুলিতে মারা গেলে তালেবের লাশ দেখানাের জন্য সে রাস্তার মানুষকে ডাকতে চায়। কিন্তু ডাকতে পারে না। স্টাইকের দিনও সে অফিসে যায়। ৬৯ এর গণঅভ্যুথানে সে প্রতিটি মিটিং মিছিলে অংশ নেয়। তবে দূরে থাকে। সে নির্বাক শ্রোতা। তার সমস্ত প্রতিবাদস্পৃহা মনের মধ্যে গুমরে মরে। গণঅভ্যুত্থানের প্রথম পর্যায়ে অনেকটা নির্লিপ্ত দর্শকের মতাে ওসমানের গতিবিধি। সে রাজনীতি সচেতন অথচ আত্মমগ্নতার মানস গড়নের মধ্যেই এক ধরনের সক্রিয়তা বিদ্যমান। কিন্তু সংগ্রামে, মিছিলে-রক্তপাতে শিহরিত ঢাকার বহির্জীবন তাকে আকর্ষণ করে। রাজনীতি তার কাছে হয়তােবা বুদ্ধিবিলাস, কিন্তু এই অস্ফুট চেতনাবীজ থেকেই জন্ম নেয়- সমষ্টিলগ্ন সংগ্রামী জীবনাকাঙ্ক্ষা। ইপিআরের জোয়ানদের দেখে তার লাথি মারতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু মানে না।
সে বাম রাজনৈতিক নেতা আনােয়ারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাঝেমধ্যে তার সবকিছু এলােমেলাে হয়ে যায়। সে বন্ধু আনােয়ারকে প্রতিদিন একবার ফোন দেয়। কিন্তু জরুরি সময় সে আনােয়ারের নম্বর মনে রাখতে পারে না। নিচতলার রানু তার কাছে অংক করে। রানুকে তার অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু কিছুই বলতে পারে না। রানুদের বাসায় চাবি রেখে যায়, বাইরে থেকে আসতে একটু রাত হয়, রানুরা ঘুমিয়েছে বলে তাদেরকে আর ডাকে না। ওসমান রােমান্টিক। সারাদিন শেষে ডেরায় ফিরলে রানু বলেছিল- ‘এতক্ষণে আসলেন’- রানুর এ কথাটিই তার কানে বাজে। কিন্তু রানুকে কখনাে মুখ ফুটে বলতে পারেনি। সে কিছু বলতে পারে না বলে পুড়ে পুড়ে নিঃশেষিত হয়।
স্বাধীনতার কথায় তার তপ্ত করােটিতে শীতল হাওয়া খেলে। শেখ মুজিবুর রহমান বন্দি বলে ওসমানের সবকিছু তেতাে মনে হয়। মিছিলে গুলি হলে, লাশ দেখলে বা লাশের কথা শুনলে চিনচিন করে তার পেটব্যথা শুরু হয়। ওসমানের জ্বালানাে আগুনে আইয়ুব খানের ছবি পােড়ানাে হয়েছে- এটাই তার গৌরব, অহংকার। নিজের খাচা, থেকে বেরুবার জন্য সে ডানা ঝাপটায়। এক পর্যায়ে সেটি পরিণত হয় ক্রোধে। শেষে সে নার্সিসাসে ভােগে। এক সময় ওসমানের মস্তিষ্কবিকৃত হয়। একা একা মৃতদের সাথে কথা কয়। খিজির তাকে ডাকে- এক সময় গভীর রাতে খিজিরের ডাকে সাড়া দিয়ে চিরতরে হারিয়ে যায়। তার মস্তিষ্ক বিভ্রাটই তার চরিত্রের বিশেষ মাত্রা ও সর্বৈব সাফল্যের দ্যোতক।