অথবা, অনুরূপতাবাদ বলতে কী বােঝ?
ভূমিকাঃ সত্যবিষয়ক সবচেয়ে বহুল প্রচলিত মতবাদটি অনুরূপতাবাদ নামে পরিচিত। এ মতানুসারে, বাস্তব সত্তা বা বাস্তব ব্যাপারের সঙ্গে আমাদের বিশ্বাস ও ধারণার মিল বা অভিন্নতার মধ্যেই সত্যতা নিহিত। একটা বিশ্বাসকে তখনই সত্য বলা হয়, যখন তা একটা প্রকৃত ঘটনার ব্যাপারে অনুরূপ হয়। সােজা কথায়, সত্য তা-ই যাতে প্রকৃত বস্তুর প্রত্যক্ষ প্রতিফলন ঘটে। বাস্তব ব্যাপারের অনুরূপ ধারণার নামই সত্য ধারণা। অনেকে এ মতবাদকে লােকায়ত মতবাদ বলেও অভিহিত করে থাকেন। প্রখ্যাত দার্শনিক, চিন্তাবিদ বার্ট্রান্ড রাসেল এ মতবাদের একজন সফল প্রতিনিধি।
অনুরূপতাবাদঃ এমতানুযায়ী, কোন বচনের সাথে যদি বাস্তবতার অনুরূপতা থাকে তাহলে ঐ বচনটিকে সত্য বচন, আর কোন বচনের সাথে যদি বাস্তবতার অনুরূপতার অভাব থাকে তাহলে ঐ বচনটিকে মিথ্যা বচন বলে অভিহিত করা যায়। অনুরূপতাবাদীরা অনুরূপতাকেই সত্যতার স্বরূপ ও মানদণ্ড বলে মনে করে থাকেন। আমরা উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। যেমন, ‘মানুষ পালকবিহীন প্রাণী’- এ বচনটি সত্য। কেননা এ বচনের বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার মিল রয়েছে এবং মানুষ সত্যিই পালকবিহীন প্রাণী। আবার, ‘মানুষ অমর’- এ বচনটি মিথ্যা। কেননা এ বচনের বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই এবং মানুষ প্রকৃতপক্ষে অমর নয়। এভাবেই অনুরূপতাবাদীরা সত্যতার রূপ এবং সত্যতা নিরূপণের মানদণ্ড হিসেবে অনুরূপতাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন।
অনুরূপতাবাদ মতবাদের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সত্যতা সম্বন্ধে এ মতবাদের দাবি প্রধানত দুটো। এক. সত্যতা হল একধরনের বিশ্বাস যা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট বাস্তবতার সম্বন্ধের ওপর। দুই. এই সম্বন্ধ হচ্ছে বিশেষ একধরনের সম্বন্ধ, যাকে আমরা অনুরূপতা শব্দের দ্বারা প্রকাশ করে থাকি। অনুরূপতাবাদ আগেভাগে ধরে নেয়- আমাদের ইন্দ্রিয় সংবেদন এতই পরিষ্কার যে, তারা জগতের প্রকৃত রূপকে হুবহু প্রকাশ করে। ভাববাদী ও প্রয়ােজনবাদী দার্শনিকরা এ ধারণার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের বক্তব্য, প্রত্যক্ষণের সময় মন আমাদের জগৎসংক্রান্ত ধারণাকে কম-বেশি বদলে দেয় বা বিকৃত করে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, অনুরূপতাবাদ কেবল একটি বহুল প্রচলিত দার্শনিক মতই নয়, সহজ বুদ্ধি বা কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গেও এর একটা বিশেষ সঙ্গতি আছে। এ কারণেই এ মতের প্রতি এত ব্যাপক সমর্থন। সাধারণ মানুষ সহজেই বিশ্বাস করে- আম, জাম, আলু, মরিচ প্রভৃতি যেসব বস্তুর অস্তিত্বে আমাদের বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসের অনরূপ বস্তুর বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে। এ কথা কেবল বাহ্যবস্তুর বেলায়ই নয়, মানসিক ধারণার বেলায়ও সত্য। যেমন, ‘অমুকের দুর্ব্যবহারে সেদিন আমি ব্যথিত হয়েছিলাম’। এই যে উক্তি তাকে আমি সত্য বলতে পারি, যদি উল্লিখিত দিনে আমি সত্যি সত্যি ব্যথিত হয়ে থাকি। এটা সত্যতার কাণ্ডজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা।