অথবা, অবভাসিক ভাববাদ কাকে বলে?
অথবা, অবভাসিক ভাববাদ কী?
ভূমিকাঃ ভাববাদ হলাে এমন একটি মতবাদ, যে মতবাদ মনে করে সত্তা হল আধ্যাত্মিক, এবং বাহ্যবস্তুর (বা জ্ঞেয় বস্তুর) জ্ঞান বা মননিরপেক্ষ কোন স্বতন্ত্র সত্তা নেই। জ্ঞানবিদ্যার দিক থেকে যে মতবাদ অনুসারে জ্ঞেয় বস্তুর জ্ঞাননিরপেক্ষ কোন অস্তিত্ব নেই, জ্ঞেয় বস্তুর অস্তিত্ব তথা জ্ঞান জ্ঞাতার ওপর নির্ভরশীল তাকে ভাববাদ বলে। ভাববাদ মূলত একটি জটিল মতবাদ। তাই বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ভাব প্রকাশ করেছেন। জ্ঞানতাত্ত্বিক ও পরাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাববাদকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-(১) বার্কলির আত্মগত ভাববাদ (২) কান্টের পরিদৃশ্যমান বা অবভাসিক ভাববাদ (৩) লাইবনিজের অধ্যাত্মবাদী ভাববাদ (৪) হেগেলের বস্তুগত ভাববাদ। নিম্নে কান্টের পরিদৃশ্যমান বা অবসিক ভাববাদ ব্যাখ্যা করা হলাে-
অবভাসিক ভাববাদঃ জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪) একজন অবসিক ভাববাদী চিন্তাবিদ। তিনি আত্মগত ভাববাদ ও বস্তুগত ভাববাদের মধ্যবর্তী স্থান দখল করে রয়েছেন। যেহেতু কান্টের দ্বারা আলােচিত জগৎ কোন এক অর্থে মনের দ্বারা সৃষ্ট জগৎ, সেহেতু আমরা তার দর্শনের আলােচনার মধ্য দিয়েই আত্মগত ভাববাদ থেকে বস্তুগত ভাববাদ পাই। কান্টের মতে, তিনটি রাজ্য রয়েছে অবসিক জগতে। আত্মগত অবস্থাসম্পর্কীয় অভ্যন্তরীণ রাজ্য, যা বিশুদ্ধ ব্যক্তিগত এবং যা জ্ঞানের রাজ্য নয়। মৌলিক সত্তাসম্পৰ্কীয় বাইরের জগৎ, অর্থাৎ আন্তরসত্তা রয়েছে, যা এর নিজস্ব গুণে অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। এই রাজ্যের সাথে মানুষের সম্পর্ক হয় কর্তব্য বা নৈতিক নিয়মের অর্থে। প্রাকৃতিক জগৎ বা অবসিক জগৎ সম্পৰ্কীয় একটি রাজ্য রয়েছে, যা মানবজ্ঞানের রাজ্য।
কান্টের মতে, আমাদের মননিরপেক্ষ এক জগতের সত্তা আছে এবং এ সত্তা হচ্ছে অতীন্দ্রিয় জগতের সত্তা। এই অতীন্দ্রিয় জগতের সত্তাকে জানা সম্ভব না হলেও এই অতীন্দ্রিয় জগৎই আমাদের সব সংবেদনের উৎস। সংবেদন দেশ ও কালের মাধ্যমে উপস্থিত হলে মন বা আত্মা এসব সংবেদনের ওপর বােধজাত কতগুলাে আকার প্রয়ােগ করে এগুলােকে সুসংবদ্ধ করে জাগতিক বস্তুর অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে। মন একটা অলিখিত সাদা কাগজের মতাে- লকের নিষ্ক্রিয় মনের এই ধারণাকে খণ্ডন করে কান্ট জ্ঞানের ক্ষেত্রে মনের সক্রিয়তার কতগুলাে সহজাত পন্থার কথা বলেন। প্রকৃতির ওপর আকার বা রূপও ক্রমবিন্যাস রূপের দ্বারাই চাপানাে হয়; সংবেদনের সাহায্যে জ্ঞানের নিছক উপাদান পাওয়া যায়। অর্থাৎ সংবেদন বা ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা নিছক উপাদান সরবরাহ করে।
মন সক্রিয় এবং এ সংবেদনের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের অসংবদ্ধ উপাদানকে সুসংবদ্ধ করে জ্ঞানের স্তরে উন্নীত করে। কুমার যেমন আকারহীন কাদা থেকে এক আকারের বা অন্য আকারের পাত্র তৈরি করেন, মনও তেমনি সংবেদনের মাধ্যমে প্রাপ্ত অসংবদ্ধ উপাদানের ওপর আকার দেয় বা তা সুসংবদ্ধ করে। সংবেদন মনের দ্বারা ব্যাখ্যাত হলেই জ্ঞানের স্তরে উন্নীত হয়। কান্টের মতে, অতীন্দ্রিয় জগৎকে জানা যায় না, জগৎ আমাদের কাছে যেভাবে প্রকাশিত হচ্ছে তাকেই আমরা জানতে পারি বলে বস্তুর অবভাসই জ্ঞানের একমাত্র বিষয়। অর্থাৎ বস্তুর অবভাস জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। এদিক থেকে কান্টের ভাববাদকে অভবাসিক ভাববাদ বলা হয়ে থাকে। আবার কান্টের মতে, বস্তুর অতীন্দ্রিয় সত্তা অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু তা আমাদের জ্ঞানের বাইরে বা জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল নয়! এদিক থেকে কান্টের ভাববাদ অতীন্দ্রিয় ভাববাদ।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়,পরবর্তী সময়ে কান্টের এই মতবাদ নিয়ে যদিও বিতর্কের সৃষ্টি হয় তবু ভাববাদের ইতিহাসে অভবাসিক ভাববাদের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।