উত্তরঃ ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসটি। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দুই বছর আগে বিপুল গণঅসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল। এর ফলে সারা দেশে আইয়ুব বিরােধী মিছিল আর মিটিং এ ফেটে পড়ে। এরই অংশ হিসেবে ‘৬৯-এ আয়ুববিরােধীয় আন্দোলনে শহরের পাশাপাশি গ্রামের মানুষও সংগঠিত হয়। এ ক্ষেত্রে বৈরাগী ভিটার বটগাছটির প্রসঙ্গ বারবার উঠে আসে।
বৈরাগী ভিটায় বিশাল এক বটগাছ, যার বয়স আনুমানিক আড়াইশ বছর। বিশাল বিশাল ঝুরি- শিক, ডালপালা বিস্তৃত। বটগাছতলায় ইঞ্চি দুয়েক উঁচু বাঁধানাে একটি ইটের বেদি। এখানেই বৈরাগী বসবাস করেছে। বৈরাগী এককালের সম্মানিত ব্যক্তি। সর্বজনশ্রদ্ধেয় মহাপুরুষ। ইংরেজ শাসনের গােড়ার দিকে, কোম্পানি আমলের শুরুতে ফকির সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ হয়, যার সাথে জড়িত ফকির মজনু শাহ, মুসা শাহ, ভবানী পাঠক প্রমুখ। বটগাছের গহীন ভেতরে এই ভাঙাচোরা পাকা জায়গার সাথে বিদ্রোহের একজন নেতার স্মৃতি জড়িত। ইংরেজদের হাতে তখন আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। এদেশি বড়লােকেরা পরিণত হলাে তাদের লাঠিয়ালে। মার খেয়ে, সন্ন্যাসী ফকিরের দল ছিটকে পড়ে এদিক ওদিক। যমুনার পশ্চিম তীরে নওখিলা পরগণায় ইংরেজদের হাতে তখন আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। বৈরাগী ভিটায় এসে ভবানী পাঠক মিলিত হন। ফকিরদের পলাতক কিছু কর্মীর সাথে। বটগাছের তলায় ভবানী পাঠক নির্মাণ করেন এই বেদি। তার স্থায়িত্ব ছিল না, তিনি বিদ্রোহীদের সাথে কখনাে কখনাে চলে যান মহাস্থান। মহাস্থান ফরিকরদের বড়াে আস্তানা ছিল। বিদ্রোহ ধীরে ধীরে নির্বাপিত হয়ে এলাে। খানদানি কেউ ফকির সন্ন্যাসীদের সহায়তা করেনি বরং ইংরেজদের চাকরে পরিণত হয়ে তারা হামলে পড়ল দেশবাসীর ওপর। কোথায় যেন যুদ্ধে আহত হয়ে সন্ন্যাসী একবার ফিরে এসেছিলেন। একটু সুস্থ হলে মজনু শাহের কয়েকজন সাগরেদ সুলতান শাহ একটি মক্তব খােলে। চিরকুমার সুলতান শাহ এর মৃত্যুর পর তার ভাইপাের ছেলে কুদুস শাহ পাঠশালা করে। এ অঞ্চলের বিখ্যাত পাঠশালা আবদুল কুদুসের পাঠশালা। নদীতে গােছল করতে গিয়ে আবদুল কুদ্স কুমিরের পেটে যায়। এই আব্দুল কুদুস জালাল মাস্টারের প্রপিতামহ। বটগাছটা বড়াে লােভী- ক্ষুধা আর ক্ষুধা। সমস্ত জমি দখল করে আছে। পুরােনাে গাছ, প্রাচীন কালের সাক্ষী। গাছটি হলাে এলাকার মুরুব্বি। এর দেহে আঘাত করলে মুরুব্বিকে আঘাত করা হয়। গাছ কাটতে গেলে বা কুড়ালে কেউ কোপ দিলে সেই মানুষটির অকল্যাণ হয়। যে কোপ দেবে তার রক্তবমি হবে, নইলে মাথায় বায়ু চড়ে নিজেই গলায় দড়ি দেয়। অভাবে পড়ে এর ডাল কেটে যারা বাজারে নিয়ে বেচেছে তারাই মরেছে। এ ইউনিয়নে ৩০-৪০ জন এভাবে মরেছে।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই” উপন্যাসে বৈরাগী ভিটার বটগাছটাকে জীবন্ত করে তুলেছেন।