অথবা, প্রয়ােগবাদ বলতে কী বুঝ? সত্য সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে উইলিয়াম জেমসের প্রয়ােগবাদ আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ মানুষের ব্যবহারিক জীবনের উদ্দেশ্য মেটানাের জন্য প্রয়ােগবাদের যাত্রা শুরু হয়। প্রয়ােগবাদ প্রধানত ভাববাদের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ একটি নতুন ও সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গি সংবলিত মতবাদ। প্রয়াগবাদ হলাে একটি দৃষ্টিভঙ্গি। একটি পদ্ধতি বা ব্যবহারিক মূল্যকে চিন্তা, ধারণার বা বিশ্বাসে সত্য মিথ্যার মাপকাঠি হিসেবে মনে করে। উইলিয়াম জেমস প্রয়ােগবাদ নামক দার্শনিক মতবাদের প্রধান প্রবক্তা।
প্রয়ােগবাদঃ প্রয়ােগবাদ একটি মতবাদ যেটি মনে করে কোনাে অবধারণের সত্যতা, বাস্তব জীবনে তার কার্যকারিতা বা উপপযােগিতার ওপর নির্ভর করে। ভাববাদের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ উদ্ভূত এ মতবাদ মনে করে যে, “জীবন বাস্তব এবং বাস্তবতাই জীবন”। সত্যের মানদণ্ড সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে প্রয়ােগবাদ মনে করে, কোনাে অবধারণের ফলপ্রসূতা, উপযযাগিতা, সন্তোষজনক ফল ব্যবহাররিক ফল বা মূল্য, কার্যকারিতা ইত্যাদি হচ্ছে অবধারণের সত্যতা নিরূপণের মাপকাঠি। বস্তুত এ মতবাদ অনুযায়ী যে অবধারণের ব্যবহারিক মূল্য রয়েছে সে অবধারণটি সত্য এবং যে অবধারণের ব্যবহারিক মূল্য নেই সে অবধারণটি মিথ্যা।
সত্য সম্পর্কে উইলিয়াম জেমসের প্রয়ােগবাদঃ উইলিয়াম জেমস অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সত্যতার বিষয়টি আলােচনা করেছেন। জেমসের মতে, বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কোনাে ধারণা বা বিশ্বাসের কার্যকারিতা নিরূপণের মধ্যেই সত্যতা নিহিত। কোনাে ধারণাকে সত্য বলে স্বীকার করার পূর্বে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তার ব্যবহারিক মূল্য বা ফলপ্রসূতা যাচাই করতে হবে। কেননা অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ চিরন্তন বা সনাতন সত্য বলে কিছু নেই। তার মতে, আমাদের আচরণের ক্ষেত্রে যে ধরনের আচরণ সুবিধাজনক বা হিতকর তা যেমন ন্যায় বা ঠিক। ঠিক তেমনি আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রে যে ধরনের চিন্তা সুবিধাজনক তা সত্য। সুবিধাজনক বা হিতকর বিশ্বাসমাত্রই সত্য। সত্য হচ্ছে আপেক্ষিক। সব বিশেষ বিশেষ সত্যের মধ্যে যে স্বরূপ বা লক্ষণ সাধারণভাবে বর্তমান তা এই যে, তারা প্রয়ােজন বা কাজে লাজে। একট ধারণা সত্য হয় যতক্ষণ তা আমাদের জীবনের জন্য হিতকর হয়। সত্য হচ্ছে ভালাের অন্তর্গত একটা প্রজাতি বা শ্রেণি। সত্যতা একটা ধারণাতে ঘটে। ধারণাটি ঘটনার সাহায্যে সত্য হয়। সত্যতা সম্পর্কে জেমসের প্রয়ােগবাদী মতকে নিম্নক্ত বৈশিষ্টের আলােকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
(১) সত্যতা কোনাে বচনের অন্তর্নিহিত গুণ নয়। সত্যতা বচনের মধ্যে অন্তর্নিহিতভাবে থাকেনা। এট বচনের কোনাে আবশ্যিক গুণও নয়। বরং আমরা বচনের ওপর এটি আরােপ করে থাকি।
(২) সত্যতা প্রয়ােগিক উপযােগিতা সাপেক্ষ। এটা বাস্তবিক জীবনের কার্যকারিতা বা উপযােগিতার ওপর নির্ভরশীল।
(৩) জেমসের মতে, সত্যতা বিশ্বাস সাপেক্ষ, কিন্তু এ বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে উপযােগিতা।
(৪) সত্যতা পরিবর্তনশীলঃ সত্যতা যেহেতু উপযােগিতার সাথে সম্পর্কিত তাই যে ধারণা যখন উপযােগিতা দেবে। তা তখন সত্য। আর এ কারণে সত্যতা ভিন্ন ভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন রকমের হতে পারে।
(৫) সত্যতা নির্বাচনধর্মী। সত্যতা কোনাে ব্যক্তির আত্মগত চেতনার ওপর নির্ভরশীল। সে যেভাবে তাকে নির্বাচন করে সত্যতা সে প্রকৃতির হয়ে থাকে।
সমালােচনাঃ জেমসের প্রয়ােগবাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সমালােচনাগুলাে নিম্নে বিস্তারিত আলােচনা করা হলাে-
প্রথমতঃ সত্য সম্পর্কিত প্রয়ােগবাদী মত বাট্রান্ড রাসেলসহ অন্যান্য দার্শনিকদের দ্বারা কঠোরভাবে সমালােচিত হয়েছে। প্রয়ােগবাদ থেকে সত্যতার একটা মানদণ্ড পাওয়া যেতে পারে। তবে এটাই সত্যের সর্বোত্তম ও একমাত্র মানদণ্ড নয়। তার চেয়ে ও বড় কথা সত্যের অর্থ সম্পর্কে প্রয়ােগবাদী মত সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিমূলক এবং সামাজিক দিক দিয়েও বিপজ্জনক বটে।
দ্বিতীয়তঃ জেমস বচনের অর্থ সম্পর্কে যে ধরনের মত প্রকাশ করে তা গ্রহণযােগ্য হতে পারে না। কোনাে বচন উক্তি বা বিবৃতির অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে এ মতবাদ কার্যকারিতার আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু কার্যকারিতা যদি অর্থের মানদণ্ড হয় তাহলে যেকোনাে ব্যক্তি তার আত্মসার্থ অনুযায়ী কোনােকিছু অর্থ নির্ধারণ করে বসবে।
তৃতীয়তঃ জেমস তার মতামত প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তত্ত্ব ও যুক্তিচিন্তাকে কোণঠাসা করে ব্যবহারিক ফলাফলের ওপর অধিক গুরুত্বারােপ করেছেন এবং এমন সব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন যা নিতান্তই উদ্ভট। যার ফলে তার দার্শনিব দৃষ্টিভঙ্গি কালক্রমে উপেক্ষার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিশেষঃ আলােচনার বিদায় ঘণ্টা বাজানাের আগে একথা বলা যায় যে, উইলিয়াম জেমসের প্রয়ােগবাদের মূল্যকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। উইলিয়াম জেমস সত্য সম্পর্কিত যে মতবাদ প্রকাশ করেছেন তা বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। তিনি সর্বাধিক গুরুত্বসহকারে সত্যতার বিষয়টি আলােচনা করেছেন। তাই সত্যতার প্রকৃতি বিশ্লেষণে জেমসকে অনুসরণীয় আদর্শ বলা যেতেই পারে।