অথবা, নীতিবিদ্যা ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক লিখ।
অথবা, নীতিবিদ্যা ও ধর্মের সম্পর্ক কি?
অথবা, নীতিবিদ্যার সাথে ধর্ম কিভাবে সম্পর্কিত সংক্ষেপে আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ নাতিবিদ্যা মানুষের আচরণ সম্পৰ্কীয় বিজ্ঞান। তাই এটা মানব জীবনের নানা দিক নিয়ে আলােচনা করে। মানষের নৈতিকতা বা আচরণের মল্যায়ন করাই নীতিবিদ্যার কাজ। ধর্ম সমগ্র বিশ্বজগতের সৃষ্টিকতা, ধারক ও নৈতিক কর্তা হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপনের কথা বলে ধর্ম ঈশ্বরকে নৈতিক কর্তা হিসেবে মনে করে বলে নীতিবিদ্যা ও ধর্মের মধ্যে একটা নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। নিচে নীতিবিদ্যা ও ধর্মের মধ্যে আলােচনা করা হলা-
নীতিবিদ্যার সংজ্ঞাঃ যে বিদ্যা সমাজে বসবাসকারী মানুষের ঐচ্ছিক আচরণের ভালাে-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় একটা বিশেষ আদর্শের আলােকে বিচার করে তাকে নীতিবিদ্যা বলে।
William Lillie বলেন, “নীতিবিদ্যা হচ্ছে সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচরণ সম্পর্কীয় এমন একটা আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান যা আচরণের ন্যায় বা অন্যায়, ভালাে-মন্দ যে পন্থায় বিচার করে।”
নীতিবিদ্যার সাথে ধর্মের সম্পর্কঃ ধর্ম আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করে। নীতিবিদ্যাও আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করে। নৈতিক আদর্শ হলাে জীবনের অন্যতম পরম আদর্শ। যাকে ক্ষুদ্র জীবনে লাভ করা সম্ভব নয়। এজন্য আত্মার অমরত্বকে স্বীকার করে না নিলে মানুষের এ নৈতিক প্রচেষ্টার কোনাে সার্থকতা থাকে না। যেহেতু ধর্ম ও নীতি আত্মার অমরত্বকে স্বীকার করে নেয় সেহেতু উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। নিম্নে নীতিবিদ্যার সাথে ধর্মের সম্পর্ক আলােকপাত করা হলাে-
১. ধর্ম থেকে নীতির উৎপত্তিঃ ডেকার্ট, লক, প্যালে দার্শনিকের মতে- ধর্ম থেকে নীতির উৎপত্তি হয়েছে। নীতি ও নৈতিক আদর্শ ঈশ্বরের অবদান। ঈশ্বর নিজ ইচ্ছায় নীতি ও বিধান সৃষ্টি করেন। ঈশ্বরের বিধানই নৈতিক জীবনের শ্রেষ্ঠ বিধান। এ বিধান মেনে চললে মানুষ শান্তি পাবে এবং ভঙ্গ করলে শাস্তি পাবে। কাজেই প্রথমে ঈশ্বর, তারপর ধর্ম, তারপর নীতি। সুতরাং ধর্ম থেকেই নীতির উৎপত্তি হয়েছে।
সমালােচনাঃ এ মতবাদ গ্রহণযােগ্য নয়। ভালাে-মন্দ ঈশ্বরের খেয়াল-খুশির উপর নির্ভর করে না। যদি তাই হতাে তবে ঈশ্বর ভাললাকে মন্দ এবং মন্দকে ভালাে নির্দেশ দিতে পারতেন। প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর হলেন নৈতিক আদর্শের পূর্ণ প্রকাশ। যা তার স্বভাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাই ভালাে। আর যা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় তাই মন্দ। এ মতবাদ অনুযায়ী নীতিবােধকে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। শাস্তির ভয়ে বা পুরস্কারের আশায় যে কাজ করা হয় তার কোনাে নৈতিক মূল্য নেই।
২. নীতি থেকে ধর্মের উৎপত্তিঃ কান্ট, মাটিনিউ প্রমুখ দার্শনিক এ মতবাদের সমর্থক। মানুষ সৎ আচরণ করলে সুখ পায়। আর অসৎ আচরণ করলে শাস্তি পায়। কিন্তু বাস্তবে আমরা সব সময় সৎ ব্যক্তিকে সুখী হতে এবং অসৎ ব্যক্তিকে শাস্তি পেতে দেখি না। কান্ট বলেন- এ জীবনে না হােক পরবর্তী জীবনে সৎ ব্যক্তি সুখী এবং অসৎ ব্যক্তি শাস্তি ভােগ করবে। সুতরাং, নীতি আমাদের ঈশ্বরের ধারণা এনে দেয়। তাই নীতি থেকেই ধর্মের উৎপত্তি।
৩. ধর্ম ও নীতি পরস্পর পৃথকঃ ধর্মের উদ্ভব পরম সত্তা থেকে। আর নীতির উদ্ভব মানুষের বিবেক থেকে। যদিও নীতি ও ধর্মের উৎপত্তি পৃথক তবুও উভয়ে পরস্পরের উপর প্রভাব বিস্তার করে। মানুষের ধর্মজ্ঞান মানুষকে সৎ পথে চলার প্রেরণা দেয়। সুতরাং ধর্মজ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে তার নীতিবােধও বৃদ্ধি পায়। আবার, নীতিবােধ যতই বৃদ্ধি পায় ধর্মভাব ততই গভীর হয়ে উঠে।
৪. ধর্ম ও নীতিবিদ্যার সাদৃশ্যঃ ধর্ম ও নীতিবিদ্যার সম্পর্ক নিয়ে, বেশ বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও এদের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। ধর্ম ও নীতিবিদ্যা উভয়ে নীতিকথা নিয়ে আলােচনা করে। তাছাড়া ধর্ম ও নীতিবিদ্যা যদিও দুটো স্বতন্ত্র বিদ্যা, তথাপি অনেক ক্ষেত্রে নৈতিক নিয়মের সাথে ধর্মের যথেষ্ট সাদৃশ্য দেখা যায়।
৫. ধর্ম ও নীতিবিদ্যার বৈসাদৃশ্যঃ ধর্ম ও নীতিবিদ্যার নিজস্ব উৎস আছে। কেননা, সুষ্ঠু নৈতিক সূত্রের উপর নির্ভরশীল না হয়েও ধর্ম থাকতে পারে না। আবার ধর্মকে স্বীকার না করেও অনেক লােক নৈতিকতা পালন করতে পারে। এ দিক থেকে ধর্ম ও নীতিবিদ্যা দুটো স্বতন্ত্র বিষয়।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ধর্ম ও নীতিবিদ্যার মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। মানুষের ধর্মভাব যতাে বৃদ্ধি পায় তার আচরণও তত বেশি সৎ হয়। সুতরাং, ধর্ম জ্ঞান বৃদ্ধি পেলে নীতিজ্ঞান উন্নত হয়। আবার নীতি বৃদ্ধি পেলে ধর্মজ্ঞান নিবিড় হয়ে উঠে। সুতরাং, বলা যায় যে ধর্ম ও নীতি পরস্পর নিভরশীল।