অথবা, নীতিবিদ্যা ও মনােবিদ্যার মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আলােচনা কর।
অথবা, নীতিবিদ্যার সাথে মনােবিদ্যার সম্পর্ক বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ নীতিবিদ্যা সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচরণ সম্পৰ্কীয় বিজ্ঞান। মানুষের আচরণের ভালাে মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি নিরূপণ করতে গিয়ে নীতিবিদ্যা আদর্শ নিয়ে জড়িত। কিভাবে ইচ্ছা করা উচিত, কিভাবে কাজ করা উচিত নীতিবিদ্যায় সে সম্পর্কে আলােচনা করা হয়ে থাকে। নীতিবিদ্যা মানুষের আচরণ নিয়ে আলােচনা করে। আর মনােবিদ্যা মানুষের আচরণ সম্পৰ্কীয় বিষয়নিষ্ঠ বিজ্ঞান। ব্যক্তির আচরণকে সঠিকভাবে বুঝার জন্য মনােবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার বলে নীতিবিদ্যার সাথে মনােবিদ্যার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। কেননা, নীতিবিদ্যা ও সমাজবিদ্যা উভয়ই মানসিক বিজ্ঞান। নিম্নে নীতিবিদ্যা ও মনােবিদ্যার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যবলি আলােকপাত করা হলাে-
নীতিবিদ্যা ও মনােবিদ্যার সম্পর্কঃ নীতিবিদ্যা ও মনােবিদ্যা মানুষের পরম কল্যাণ নিয়ে আলােচনা করে। কারণ নীতিবিদ্যা মানুষের আচরণ ভালাে কি মন্দ, ন্যায় কি অন্যায়, সৎ কি অসৎ তা বিচার করে। আর মনােবিদ্যা মনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার প্রকৃতি, পদ্ধতি নিয়ম আবিষ্কার করে। নীতিবিদ্যা ও মনােবিদ্যার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। নীতিবিদ্যা ও মনােবিদ্যার সম্পর্ক জানতে হলে প্রথমে নীতিবিদ্যা ও মনােবিদ্যার পরিচয় জানতে হবে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলােকপাত করা হলাে।
নীতিবিদ্যাঃ নীতিবিদ্যার ইংরেজি ‘Ethics’ যা গ্রিক শব্দ Ethica’ থেকে আগত। ‘Ethica’ আবার ‘Ethos’ থেকে। ‘Ethos’ অর্থ-আচার, ব্যবহার, রীতি-নীতি ও অভ্যাস। ইংরেজিতে যাকে ‘Moral Philosophy’ও বলা হয়। সুতরাং শব্দের দিক থেকে নীতিবিদ্যা মানুষের রীতিনীতি বা আচার-ব্যবহার আলােচনা বলা যেতে পারে।
William Lillie বলেছেন, “Ethics is the normative science of conduct of human beings in socities.”
ম্যাকেঞ্জি বলেন, “আচরণের ন্যায় বা ভালাে নিয়ে যে আলােচনা করা হয়, তাকে নীতিবিদ্যা বলে।”
Aristotle বলেন, “যে বিদ্যা সমাজে বসবাসকারী মানুষের ভালাে-মন্দ বিচার করে তাকে নীতিবিদ্যা বলে”।
মনােবিদ্যাঃ মনােবিদ্যা আচরণ ও মানসিক প্রক্রিয়ার যুক্তিসম্মত পর্যালােচনা। তাই বলা যায়, এটি এক বিষয়নিষ্ঠ বিজ্ঞান। পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তির ক্রিয়াবলি সম্পকে আলােচনা করতে মনােবিদ্যা মানব ক্রি বিভিন্নরূপ ও তাদের বৈশিষ্ট্য আলােচনা করে।
নীতিবিদ্যা ও মননবিদ্যার সাদৃশ্যঃ নিম্নে নীতিবিদ্যা ও মনােবিদ্যার সাদৃশ্য তুলে ধরা হলাে-
প্রথমতঃ ঐচ্ছিক, অনৈচ্ছিক ও ইচ্ছার নিরপেক্ষ ক্রিয়াবলিকে তাদের মৌলিক উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের প্রেক্ষিতে মনােবিদ্যায় ব্যাখ্যা করা হয়। নীতিবিদ্যায় ন্যায় আচরণ সম্পৰ্কীয় মতবাদ গঠন করতে মনােবিদ্যার এসব আলােচনার ফলাফলকে মূল্যায়ন করে।
দ্বিতীয়তঃ নীতিবিদ্যা সুষ্ঠু আলােচনার স্বার্থে ইচ্ছা, কামনা, সংকল্প, উদ্দেশ্য অভিপ্রায় ইত্যাদি মনস্তাত্ত্বিক ধারণার উপর বিশেষ গুরুত্বারােপ করে।
তৃতীয়তঃ ‘Outline of the History of Ethics’ গ্রন্থে সিজউইক বলেন, “প্রায় সব নীতি দার্শনিক সম্প্রদায় এটা স্বীকার করেন যে, তাদের অনুসন্ধানের বিষয় অবশ্যই মানব জীবনের মনস্তাত্ত্বিক দিকের অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন পন্থায় নৈতিক প্রশ্নাবলি মনস্তাত্তিক আলােচনার দিকে অনিবার্যভাবে পরিচালিত হয়ে থাকে। বস্তুত আমরা বলতে পারি যে, সব গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক ধারণা মনস্তাত্ত্বিকও বটে।”
চতুর্থতঃ নীতিবিদ্যা ও মনােবিদ্যা মন সম্পর্কীয় আলােচনা করে। নীতিবিদ্যার আলােচনার জন্য মনােবিদ্যার যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। তাই বলা যায় উভয়ের মাঝে বেশ সাদৃশ্য আছে।
নীতিবিদ্যা ও মনােবিদ্যার বৈসাদৃশ্যঃ নীতিবিদ্যা ও মনােবিদ্যার মধ্যে সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও বৈসাদৃশ্যও বিদ্যমান। নিচে তা আলােচনা করা হলাে-
প্রথমতঃ মনােবিদ্যা মানব আচরণ সম্পৰ্কীয় বিজ্ঞান। মনােবিদ্যা কোনাে আদর্শের প্রেক্ষিতে মানব ক্রিয়ার বিচার বিবেচনা না করে কেবল মানব ক্রিয়ার প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্ককে আলােচনা করে। নীতিবিদ্যা আচরণ সম্পৰ্কীয় বর্ণনামূলক বিজ্ঞান নয়। বরং আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান। নীতিবিদ্যা মানব আচরণ কি হওয়া উচিত তা নিয়ে আলােচনা করে। Stont বলেন, “আমরা প্রকৃতই কিভাবে ইচ্ছা করে থাকি এ কথাটির পরিবর্তে কিভাবে ইচ্ছা করা উচিত তা নিয়ে নীতিবিদ্যা অনুসন্ধান চালায়। মােটকথা মনােবিদ্যা মানসিক আচরণ কিভাবে ঘটে তার বর্ণনা দেয়। আর নীতিবিদ্যা ঐচ্ছিক ক্রিয়ার ভালাে-মন্দত্ব ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা করে।
দ্বিতীয়তঃ মনােবিদ্যা বর্ণনামূলক বিজ্ঞান। নীতিবিদ্যা আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান হওয়ার ফলে এদের পদ্ধতি ভিন্ন। নীতিবিদ্যায় মানব আচরণের ন্যায়ত্ব-অন্যায়ত্ব, ভালােত্ব-মন্দত্ব নিয়ে আলােচনা করার জন্য মনােবিদ্যার মতাে কোনাে পরীক্ষাগার দরকার নাই। অপর দিকে, মনােবিদ্যায় মানব ক্রিয়ার আলােচনার ক্ষেত্রে পরীক্ষাগার দরকার আছে। বিশ্লেষণ, প্রকল্প প্রণয়ন, যাচাইকরণ ইত্যাদি অভিজ্ঞতামূলক আরােহ পদ্ধতির প্রয়োেগ মনােবিদ্যার মতাে সম্ভব নয় বলে নীতিবিদ্যার পদ্ধতি ও মনােবিদ্যার পদ্ধতি এক নয়।
তৃতীয়তঃ মনােবিদ্যার পরিসর নীতিবিদ্যার চেয়ে ব্যাপক। মনােবিদ্যা মানসিক প্রক্রিয়ার সব কিছু নিয়ে আলােচনা করে। পক্ষান্তরে, নীতিবিদ্যা ঐচ্ছিক ক্রিয়া চিন্তন ও অনুভূতি নিয়ে আলােচনা করে। মনােবিদ্যা স্নায়ুতন্ত্র থেকে শুরু করে মানসক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত সব বিষয় নিয়েও আলােচনা করে। নীতিবিদ্যা মানুষের নৈতিক ব্যবহার নিয়ে আলােচনা করে।
চতুর্থতঃ বর্তমানে মনােবিদ্যার আলােচনার দৃষ্টিভঙ্গি অভিজ্ঞতা ভিত্তিক। পক্ষান্তরে, নীতিবিদ্যার আলােচনার দৃষ্টিভঙ্গি তাত্ত্বিক হলেও গৌণভাবে এর ব্যবহারিক যােগ সম্পর্ক রয়েছে।
নীতিবিদ্যা ও মনােবিদ্যা পরস্পর নির্ভরশীলঃ নীতিবিদ্যা ও মনােবিদ্যা‘আচরণ নিয়ে আলােচনা করে। ঐচ্ছিক ক্রিয়ার সরূপ ঐচ্ছিক ও ইচ্ছা নিরপেক্ষ ক্রিয়ার পার্থক্য উদ্দেশ্য ইত্যাদি আলােচনার ক্ষেত্রে মনােবিদ্যার সাথে নীতিবিদ্যার বেশ মিল থাকলেও নীতিবিদ্যা এক নয়। নীতিবিদ্যার সাথে মনােবিদ্যার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। কিন্তু তাই বলে আমাদের এটা ভুললে চলবে না যে নীতিবিদ্যা আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান। মনােবিজ্ঞান বিষয়নিষ্ঠ বিজ্ঞান। আর এ দুটো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বিদ্যা।
শেষকথাঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যারা মনে করে নীতিবিদ্যা মনােবিদ্যার একটা শাখা এবং নীতিবিদ্যা কেবল মনােবিদ্যার উপর নির্ভরশীল তারা নীতিবিদ্যা সম্পর্কে একটা সঠিক ধারণা গঠন করতে পারে নাই বলেই নীতিবিদ্যাকে মনােবিদ্যার সাথে গুলিয়ে ফেলেন। যাই হােক, নীতিবিদ্যা ও মনােবিদ্যা দুটো স্বতন্ত্র বিদ্যা হলেও এদের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। কেননা, নীতিবিদ্যা ও মনােবিদ্যা মানব সম্পর্কে আলােচনা করে।