মুবারক শাহ (১৪২১-‘৩৪ খ্রি:):
খিজির খাঁ’র মৃত্যুর পর দিল্লির সিংহাসনে বসেছিলেন তাঁর পুত্র মুবারক শাহ। এই মনোনয়নে অভিজাতদের সম্মতি থাকার ফলে সিংহাসনকে কেন্দ্র করে প্রাথমিক সমস্যা দেখা দেয়নি। পিতার মতোই মুবারক ভাষা, সাহিত্য ও সামরিক বিদ্যায় যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। প্রথম আট বছর মুবারক তৈমুর বংশের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে শাসন পরিচালনা করেন। অতঃপর মুবারক ‘শাহ’ (সুলতান) উপাধি গ্রহণ করে তৈমুর বংশের অধীনতা বর্জন করেন। নিজের নামে মুদ্রা খোদাই করে এবং ‘খুৎবা’ পাঠ করে বিদেশি নিয়ন্ত্রণমুক্ত শাসনের সূচনা করেন। কেন্দ্রীয় শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে মুবারক অভিজাতদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেন। কোনো অভিজাতকে তিনি অবশ্য জায়গিরচ্যুত করেননি, তবে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে যাতে কারো কায়েমি স্বার্থ গড়ে উঠতে না পারে, সেজন্য জায়গির পরিবর্তন করেন। বদায়ুন, এটাওয়া, কাটিহার গোয়ালিয়র প্রভৃতি স্থানের অবাধ্য মালিকদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর সামরিক ব্যবস্থা নেন এবং যথারীতি করপ্রদানে বাধ্য করেন।
দেশের ভিতর ও বাইরের একাধিক শক্তি মুবারক শাহকে বিব্রত করে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে খোক্করগণ, মালব ও জৌনপুরের শাসকগণ এবং বহিরাগত মুঘলদের পুনঃপুন আক্রমণ মুবারক শাহকে যথেষ্ট ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। মুবারক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই সকল আক্রমণ প্রতিহত করেন। দিল্লি সুলতানির রাজ্যসীমা তিনি বর্ধিত করেননি ঠিকই। তবে লব্ধ সাম্রাজ্যের সীমানা তিনি সংকুচিত হতেও দেননি। তাঁর রাজত্বের শেষদিকে কাবুল থেকে মুঘল আক্রমণ ঘটে। শাহরুখ-এর পৌত্র মামুদ মির্জার পক্ষে কাবুলের সহকারী গভর্নর শেখ আলি দিল্লি আক্রমণ করেন। ফেরিস্তার মতে, মুবারক শাহ তৈমুর বংশের অধীনতা অস্বীকার করে স্বাধীন সুলতানির সূচনা করার জন্য মুঘলরা ক্ষুব্ধ হয় এবং দিল্লি আক্রমণ করে। কিন্তু সিরহিন্দির বিবরণ থেকে অনুমান করা যায় যে, দিল্লির পক্ষে লাহোরের শাসক নিয়মিত কাবুলে উপঢৌকন পাঠাতেন। এমনকি শাহরুখ খাঁ মুবারক শাহ ও তাঁর উত্তরাধিকারী মহম্মদ শাহ’কে স্বীকৃতির নিদর্শনস্বরূপ ছাতা প্রেরণ করেছিলেন। সম্ভবত, শেখ আলি কাবুল ও গজনির শাসক মামুদ মির্জার ইচ্ছানুসারে দিল্লি আক্রমণ করেছিলেন; শাহরুখ এ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। যাই হোক্, এ ক্ষেত্রেও মুবারক শাহ দক্ষতার পরিচয় দেন এবং আক্রমণকারী মুঘল-বাহিনীকে বিতাড়িত করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সফল এই সৈয়দ শাসকের প্রাণনাশ ঘটে এক অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে। আমির ও মালিকদের একাংশ সুলতানের কর্তৃত্ব সহ্য করতে পারছিল না। এর মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় গোষ্ঠীর অভিজাতই ছিলেন। এদের নেতৃত্বে ছিলেন তাঁর প্রধানমন্ত্রী সরওয়ার-উল-মুল্ক। ইনিও ছিলেন ধর্মান্তরিত হিন্দু। ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি সুলতান যখন তাঁর নির্মীয়মাণ মুবারকাবাদ শহর পরিদর্শনে যান, তখন সিধপাল ও রণু নামক দুই আততায়ী মুবারক শাহকে হত্যা করেন।
ড. হামিদউদ্দিন সুলতান মুবারক শাহকে ‘সৈয়দ বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক’ বলে অভিহিত করে লিখেছেনঃ “He was just and kind towards all of his subjects and though a firm Muslim in belief and action was free from taint of bigotry.” পিতার সাম্রাজ্য তিনি দক্ষতার সাথে রক্ষা করেন এবং একজন সমরনায়কের মতোই অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শত্রুর মোকাবিলা করেন। তাঁর ধর্মীয় নিরপেক্ষতা ছিল লক্ষণীয়। অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মুবারক শাহর নীতি নিঃসন্দেহে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সহায়ক ছিল। তাঁর অনন্য কৃতিত্ব হল যে, তিনি বিদেশি মোঙ্গলদের অধীনতা থেকে সৈয়দ বংশের শাসনকে মুক্ত করে স্বাধীন শাসনের পত্তন করেন। অবশ্য কায়েমি স্বার্থে আঘাত হানার জন্য যে ধারাবাহিক সচেতনতা দরকার, তা মুবারক শাহের ছিল না। তাই তাঁকে ক্ষুব্ধ ও স্বার্থান্ধ অভিজাতদের ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছিল।
শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। যমুনা নদীর তীরে তিনি ‘মুবারকাবাদ’ নামে সুদৃশ্য শহর নির্মাণ করেন (১৪৩৩ খ্রিঃ)। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ইয়াহিয়া সিরহিন্দি ‘তারিখ-ই-মুবারকশাহি’ নামক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন।
মহম্মদ শাহ (১৪৩৪-৪৫ খ্রি:) :
নিঃসন্তান মুবারক শাহের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র মহম্মদ-বিন্-ফরিদ সিংহাসনে বসেন এবং ‘সুলতান মহম্মদ শাহ’ উপাধি নেন। রাজকীয় কোনো গুণই তাঁর ছিল না, তবে রাজকীয় অপগুণসমূহ—যেমন বিলাস ও ব্যভিচার ইত্যাদিতে তিনি ছিলেন খুবই রপ্ত। সুলতান মুবারক শাহের হত্যা ষড়যন্ত্রের নায়ক জেনেও সরওয়ার খাঁ’র বিরুদ্ধে মহম্মদ শাহ কোনো ব্যবস্থাই নেননি। পরস্তু তাঁকে ‘খান-ই-জাহান’উপাধিতে ভূষিত করে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করে দেন। সরওয়ার খাঁ ইচ্ছামতো আমির ও মালিকদের বদলি, পদচ্যুতি ও নিয়োগ ঘটিয়ে নিজের প্রভাব জাহির করতে চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত অভিজাতরা মিলিত হয়ে সরওয়ারকে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি করেন, নতুন প্রধানমন্ত্রী হন কামাল-উল-মুলক।
মহম্মদ শাহের অকর্মণ্যতা ও রাজধানী দিল্লির অস্থির ও দুর্বল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে মদত দেয়। জৌনপুরের শাসক ইব্রাহিম শাহ দিল্লির কয়েকটি অঞ্চল দখল করে নেন। গোয়ালিয়রের রাই-সহ কিছু হিন্দু জমিদার বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মালবের শাসক মামুদ শাহ খলজি এই সুযোগে দিল্লি দখল করার উদ্দেশ্যে এক অভিযান পাঠান। সৈয়দ শাসনের এই বিপদের মুহূর্তে মহম্মদ শাহের অনুরোধে সিরহিন্দ ও লাহোরের শাসনকর্তা বহলুল লোদী সুলতানকে সামরিক সাহায্য দিয়ে বিপন্মুক্ত করেন। মামুদ খলজির পশ্চাদ্ধাবন করে বহলুল তাঁর বহু সৈন্যকে হত্যা করেন এবং প্রচুর সম্পদ দখল করেন। কৃতজ্ঞ সুলতান মহম্মদ শাহ বহলুলকে নিজের পুত্রতুল্য বলে অভিহিত করেন এবং ‘খান-ই-খানান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সুলতান দিপালপুর ও লাহোরের জায়গির বহলুলের হাতে অর্পণ করেন।
মহম্মদ শাহের মৃত্যুর (১৪৪৫ খ্রিঃ) পর তাঁর পুত্র আলাউদ্দিন ‘আলম শাহ’উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। নিজের অদক্ষতা সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাই রাজক্ষমতা বিস্তারের স্বপ্ন না দেখে তিনি স্বেচ্ছায় শাসনদায়িত্ব হামিদ খাঁ নামক জনৈক আত্মীয়ের হাতে তুলে দিয়ে বদাউনে চলে যান। অবশ্য হামিদ খাঁ-র আচরণে আলম শাহ ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। এমতাবস্থায় হামিদ খাঁ বহলুল লোদীকে দিল্লি দখলের জন্য গোপনে আমন্ত্রণ জানান। বহলুল লোদী বহু আগে থেকেই দিল্লি দখলের ইচ্ছা পোষণ করতেন। এই সুযোগের তিনি সদ্ব্যবহার করেন এবং হামিদ খাঁকে প্রথমে বন্দি ও পরে হত্যা করে দিল্লির ক্ষমতা হস্তগত করেন (১৪৫০ খ্রিঃ)। অবশ্য বহলুল সুলতান আলম শাহকে দিল্লিতে এসে শাসন পরিচালনার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু আলম শাহ দিল্লির ওপর বহলুলের কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে স্থায়ীভাবে বদাউনে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। এখানেই তিনি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেন (১৪৫১-৬৪ খ্রিঃ)।
এইভাবে রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কোনো স্থায়ী অবদান ছাড়াই সৈয়দ বংশের সাঁইত্রিশ বছরের শাসনের সমাপ্তি ঘটে। মুলতানের একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের মধ্যে সৈয়দদের উত্থান হয় ; আর পতন ঘটে বদাউনের একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের শাসক হিসেবে। ড. নিজামীর ভাষায় : “Emerging as the principality of Multan, it ended as the principality of Badaun. Neither politicaly nor culturally did it contribute anything worth while to the history of medieval Idnia.”