রাজতান্ত্রিক বা নরপতিত্বের আদর্শ:
দিল্লির সুলতানদের মধ্যে একমাত্র বলবন রাজতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর আদর্শ ও নীতি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন। জিয়াউদ্দিন বারাণীর ফতোয়া-ই-ফিরোজশাহি গ্রন্থে বলবনের রাজতন্ত্রের আদর্শ-সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে ইসামী কিছু না বলার ফলে বিষয়টির যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। কারণ বারাণী নিজেও বংশমর্যাদা বা জাতপাতের ভেদাভেদ সম্পর্কে বেশ গোঁড়া ছিলেন। বলবনের রাজতন্ত্রের আদর্শেও বংশমর্যাদার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। তাই এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে, বারাণী তাঁর নিজের মনোভাব কোনো কোনো ক্ষেত্রে বলবনের মুখ দিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। যাই হোক, নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবহেতু বারাণীর বক্তব্যকেই সঠিক বলে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
রাজতন্ত্রের মর্যাদা ও সুলতানের শক্তিবৃদ্ধির গুরুত্ব সম্পর্কে বলবন সদাসচেতন ছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, একমাত্র এই পথেই ব্যক্তিগতভাবে তাঁর এবং সামগ্রিকভাবে সুলতানির অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব রক্ষা করা সম্ভব। বলবন নিজে ছিলেন ক্রীতদাস। দক্ষতার জোরে তিনি ‘তুর্কান-ই-চাহেলগানী’র সদস্য হয়েছেন এবং ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পরবর্তীকালে ইচ্ছামতো সুলতানি প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রিত করেছেন। তুর্কি আমির ও মালিকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা যে সুলতান তথা সুলতানি সাম্রাজ্যের স্বাভাবিক বিকাশের পথে প্রধান অন্তরায়, এ সত্য তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে। তাই বলবন সুলতান এবং রাজতন্ত্রকে মর্যাদা ও কর্তৃত্বের এমন একটা স্তরে উন্নীত করতে চেয়েছিলেন, যাকে স্পর্শ করা তুর্কি আমির বিশেষত, চাহেলগানীর সদস্যদের পক্ষে কেবল অসম্ভব নয়, অবাস্তব বলে মনে হবে। এই লক্ষ্যের সহায়ক হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল তাঁর রাজতন্ত্রের আদর্শ। অধ্যাপক নিজামী তাই লিখেছেন: “Apart from everything else it necessitated the re-establishment of the power and dignity of the Delhi Sultan and for India-a new, if transient, theory of kingship.”
বলবন পারস্যের সাসানীয় বংশের রাজতান্ত্রিক আদর্শের অনুকরণে তাঁর নরপতিত্বের আদর্শ প্রচার করেন। তিনি বলেন, মানুষের পৃথিবীতে রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। বলবন নিজেকে ‘খোদার নায়েব’ (নিয়াবৎ-ই-খুদাই) এবং ঈশ্বরের ছায়া’ (জিলুল্লাহ) বলে ঘোষণা করেন। তাঁর মতে, রাজার হৃদয় হল ঈশ্বরের স্বর্গীয় ধ্যানধারণার ভাণ্ডার এবং এখান থেকেই ঈশ্বরের ইচ্ছা জনগণের মধ্যে বিকিরিত হয়। রাজার ক্ষমতা ও মর্যাদা প্রসঙ্গে বলবন একদা তাঁর পুত্র বুগরা খাঁ’কে বলেছিলেন : “The heart of the king is the special repository of God’s favour and in this he has no equal among mankind.” এর দ্বারা তিনি রাজতন্ত্রের ঐশ্বরিক উৎস এবং অভিজাতবর্গ কিংবা প্রজাসাধারণের থেকে রাজার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও কর্তৃত্বের তত্ত্ব প্রচার করেন। ইতিমধ্যে মুসলিম অধিকৃত অধিকাংশ অঞ্চল মোঙ্গলদের অধীনে চলে গিয়েছিল এবং খলিফারও পতন ঘটেছিল। কিন্তু বলবন তাঁর রাজতন্ত্রের প্রতি খলিফার স্বীকৃতির কথা প্রায়শই প্রচার করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মুসলিম রাজতন্ত্রের প্রধান শাসক হিসেবে খলিফার অনুমোদন আবশ্যিক। তাঁর মুদ্রায় খলিফার নাম উল্লেখ করে এবং খুৎবায় তাঁর নাম পাঠ করে তিনি ইসলামীয় রাজতন্ত্রের ঐতিহ্য রক্ষা করেন।
রাজার স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদার অসাধারণত্বকে তিনি রাজতন্ত্রের পক্ষে আবশ্যিক বলে মনে করতেন। নিজেকে তিনি পারস্যের বিখ্যাত আফ্রিসিয়াব বংশের শরিক বলে ঘোষণা করেন এবং অভিজাতবংশীয় নয় এমন কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে আসাকে রাজার মর্যাদার হানিকর বলে বিশ্বাস করতেন। সাধারণ মানুষের সাথে বাক্যালাপকে তিনি ঘৃণা করতেন। এমনকি রাজকীয় পদে বংশকৌলীন্যহীন কোনো ব্যক্তির নিয়োগ তাঁর কাছে ছিল অমার্জনীয় অপরাধ। নীচবংশোদ্ভূত মানুষ সম্পর্কে বলবনের উক্তি পাওয়া যায় বারাণীর গ্রন্থে। বলবন বলেছিলেন: “যখনই আমি নীচবংশোদ্ভূত মানুষ দেখি, তখন রাগে আমার প্রতিটি শিরা-উপশিরা জ্বলতে শুরু করে। তাকে হত্যা করার জন্য আমি তরবারির দিকে হাত বাড়াই।” বারাণী আরও লিখেছেন, “একদিন রাজসভা চলাকালে বলবন যখন জানতে পারেন, কমল মাহিয়ার নামক জনৈক ধর্মান্তরিত মুসলমানকে আমরোহার মুতাশরিফ পদে নিয়োগ করা হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং সভাকক্ষ ত্যাগ করে চলে যান।” মকতুবত-ই-আসরিফ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, বলবন সরকারি পদে নিয়োগের পূর্বে সমস্ত পদপ্রার্থীর বংশকৌলীন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করার ব্যবস্থা করেন। এজন্য বহু কুলাচার্য নিয়োজিত ছিলেন।
বলবন তাঁর রাজতান্ত্রিক আদর্শের পরিপূরক হিসেবে দরবারী আদবকায়দা ঢেলে সাজান। দরবারে তিনি পারসিক রীতিনীতি অনুসরণের কঠোর নির্দেশ দেন। সুসজ্জিত পোশাক এবং উন্মুক্ত তরবারি হস্তে বিশেষ রাজকীয় বাহিনী দ্বারা পরিবৃত না-হয়ে তিনি কখনো দরবারে বা জনসমক্ষে বের হতেন না। দরবারে লঘু চপলতা বা হাস্যপরিহাস ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তিনি মদ্যপানও নিষিদ্ধ করে দেন। পারসিক রীতি অনুযায়ী সুলতানের সামনে আসার সময় ‘সিজদা’ অর্থাৎ নতজানু হয়ে প্রণাম এবং ‘পাইবস’ অর্থাৎ সিংহাসনের পদচুম্বন করার নিয়ম প্রবর্তন করেন। ষোড়শ শতকের জনৈক লেখক ফাজুনী অস্তারবাদী লিখেছেন যে, “সুলতানের মুখমণ্ডল সর্বদা এক অদৃষ্টপূর্ব গাম্ভীর্য দ্বারা আবৃত থাকত, যাতে তাঁর দাম্ভিকতামিশ্রিত ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠত। দরবারে তিনি অতি নিম্নস্বরে একমাত্র উজিরের মাধ্যমে অভিযোগ শুনতেন এবং প্রতিবিধানের নির্দেশ দিতেন।” লেনপুল লিখেছেন, দীর্ঘ শাসনকালে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও কোনো সাধারণ মানুষের সাথে কথোপকথোন করেননি। প্রিয়পুত্র মহম্মদের মৃত্যুসংবাদ শুনেও তিনি দরবারে অচঞ্চল থাকেন, যদিও আপন কক্ষে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে বহু অর্থ ব্যয় করে দরবার সাজানো হত। দরবারের জাঁকজমক ও চাকচিক্যে ঝল্সে যেত সাধারণ মানুষের দৃষ্টি। বারাণী লিখেছেন : “The shining of the sun. the glittering of the sword’s and the brightness of the face (of Balban) all taken together made remarkable show.” এইভাবে শক্তি, মর্যাদা ও কর্তৃত্বের সম্মিলিত প্রকাশ দেশের অবাধ্য শক্তিগুলিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করত এবং সাধারণ মানুষের হৃদয়ে সম্ভ্রম ও সন্ত্রাসের সঞ্চার করত, — যা ছিল বলবনের রাজাদর্শের মূল লক্ষ্য।
বলবনের রাজাদর্শের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল তুর্কি আমির ও মালিকদের এবং সিংহাসনে আসীন রাজার মধ্যে অবস্থানগত এবং অনতিক্রম্য তারতম্যের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা। বলবন তাঁর একদা সহকর্মী চল্লিশচক্রের ক্ষমতাবান ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী আমিরদের মাঝে মাঝেই স্মরণ করিয়ে দিতেন যে, ষড়যন্ত্র বা গুপ্তহত্যা দ্বারা অভিজাতদের ক্ষমতা অর্জন বা বৃদ্ধি করা যায়; কিন্তু রাজপদ শুধুমাত্র বিষ বা তরবারি দ্বারা অর্জনের বস্তু নয়। এজন্য প্রয়োজন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অনুমতি ও সাহায্য। তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী এই পদে উন্নীত হয়েছেন; সাধারণের ইচ্ছায় নয়। তাই তাঁর কাজের কৈফিয়ত তিনি ঈশ্বর ছাড়া অন্য কারও কাছে দিতে বাধ্য নয়। ঈশ্বরের প্রতিভূ হিসেবে তিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে রাজার কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেন। অধ্যাপক নিজামীর ভাষায় : “Balban realised that his position as a sultan would be judged by the peace or the justice he gave to the country.” জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য তিনি বিচারব্যবস্থায় পক্ষপাতিত্ব করার বিরোধী ছিলেন। এমনকি অপরাধী অভিজাতদের উপযুক্ত শাস্তিবিধানেও তিনি কুণ্ঠিত ছিলেন না। নিজের গৃহভৃত্যকে পিটিয়ে হত্যা করার অপরাধে বলবন বদাউনের শাসক মালিক বারবককে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতের নির্দেশ দেন। অযোধ্যার গভর্নর হায়বৎ খাঁ’কে মদ্যপ অবস্থায় এক ব্যক্তিকে হত্যা করার অপরাধে পাঁচ শত বেত্রাঘাতের ও নিহত ব্যক্তির বিধবা পত্নীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার আদেশ দেন। কথিত আছে হায়বং খাঁ অপমানে জর্জরিত হয়ে আমৃত্যু আর লোকচক্ষুর সামনে বের হননি। চাহেলগানীর অন্যতম সদস্য তথা অযোধ্যার গভর্নর আমির খাঁ বাংলাদেশের বিদ্রোহদমনে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলে বলবন তাঁকে অযোধ্যা নগরীর প্রধান ফটকের কাছে প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেন। তুর্কি অভিজাতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিবিধান করে বলবন দুটি উদ্দেশ্য পূরণ করেন—(১) সুলতানের ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে জনমনে আস্থা স্থাপন করেন এবং (২) তুর্কি অভিজাতদের মধ্যে এমন সন্ত্রাসের সৃষ্টি করেন, যাতে তাঁরা ভবিষ্যতে সুলতানের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহস দেখাতে না পারেন।
বলবন বিশ্বাস করতেন যে, পারসিক রীতিনীতিকে বাদ দিয়ে রাজতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই তিনি ব্যক্তিজীবনে ও রাষ্ট্রীয়জীবনে অন্ধের মতো পারসিক আদবকায়দা অনুসরণ করেন। সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে তাঁর দুই পুত্রসন্তান জন্মেছিলেন। তাদের নামকরণের সময় মুসলিম সাধারণ রীতি অনুযায়ী ‘মামুদ’ ও ‘মহম্মদ’ রাখেন; কিন্তু সুলতানি সিংহাসনে বসার পরবর্তীকালে আগত পৌত্রদের সময় তিনি পারসিক ধারা অনুযায়ী কাইখসরু, কাইকোবাদ, কাইকাউস ইত্যাদি নাম ব্যবহার করেন।
সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবন প্রচারিত রাজতন্ত্রের আদর্শ আপাতদৃষ্টিতে রাজতন্ত্রের মর্যাদা বৃদ্ধি, সাম্রাজ্যের সংহতি ও নিরাপত্তাবিধান, শরিয়তের নির্দেশানুযায়ী প্রজাপালন ও ন্যায়বিচার প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি বহন করে এনেছিল। কিন্তু অধ্যাপক কে. এ. নিজামী, আর. পি. ত্রিপাঠী প্রমুখ মনে করেন, এই রাজাদর্শ প্রচারের পেছনে বলবনের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং তা থেকে উত্তরণের একান্ত ইচ্ছা কাজ করেছিল। বলবনের রাজতান্ত্রিক কোনো ঐতিহ্য ছিল না। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি সিংহাসন দখল করেছিলেন এবং এ কাজে তাঁর সহযোগী ছিলেন চাহেলগানীর অন্যান্য সদস্যরা। এখন বলবন তাঁর রাজকর্তৃত্বের ওপর ঐশ্বরিক অনুমোদনের ছাপ লাগিয়ে অন্যান্য আমিরদের থেকে নিজেকে পৃথক করতে এবং রাজকর্তৃত্বকে বৈধতা দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। মিনহাজ-উস্-সিরাজ বা জিয়াউদ্দিন বারাণী বলবনের ‘দাসত্বমুক্তি’ সম্পর্কে কোনো উল্লেখ করেননি। সম্ভবত বলবনের দাসত্বমুক্তি আদৌ হয়নি। তাই রাজতন্ত্রের ঐশ্বরিক তত্ত্ব প্রচার করে তিনি নিজের দুর্বলতা আড়াল করতে সচেষ্ট হন। নিজামীও লিখেছেন : “Perhaps he was never manumitted and this basic disqualification to rule over the people, he tried to cover under a shrewdly designed mask of ‘divine commitment of regal authority.” বলবন রাজাদর্শ হিসেবে শরিয়তি আইনের রক্ষক বা ন্যায়পরায়ণতা প্রবর্তনের যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তা-ও ছিল ছলনা মাত্র। বারাণী লিখেছেন যে, সাধারণক্ষেত্রে বলবন ন্যায়বিচারের চেষ্টা করলেও, যখন তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থবিজড়িত ঘটনার সম্মুখীন হতেন, তখন তিনি ন্যায়বোধ বা শরিয়তের বিধানের তোয়াক্কা করতেন না। একজন মধ্যযুগীয় স্বেচ্ছাচারী শাসকের মতোই তিনি আচরণ করতেন। এর পরিণামে তাঁর ভাবমূর্তি ও মর্যাদা নষ্ট হয়েছিল।
খলজিরা নতুন রাজতান্ত্রিক আদর্শ অনুসরণ করে। খলজিরা জাতিগত বৈশিষ্ট্য প্রচার করে জনগণের আনুগত্য আদায়ের চেষ্টা করেনি। মুসলিম রাজতন্ত্রের সাফল্যের বা বৈধতার ক্ষেত্রে তাঁরা খলিফার অনুমোদন গ্রহণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাননি। খলজিরা দিল্লির মসনদ দখল থেকে রাজ্যশাসন করার কাজে সামরিক শক্তিকেই প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করতেন। আলবেরী তুর্কিদের আমলে মুসলিম সর্বোচ্চ ধর্মগুরুর সনদপ্রাপ্তি দ্বারা রাজতন্ত্রকে বৈধতাদানের রীতি থেকে সরে গিয়ে খলজিরা ভারতে মুসলিম রাজতন্ত্রের মতাদর্শে নতুনত্বের সূচনা করেন। এই পরিবর্তনের ছাপ আলাউদ্দিনের বক্তব্য ও কর্মধারার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছিল। আলাউদ্দিন খলজি রাজাদর্শ সম্পর্কে আরও বিশদ ও স্পষ্টভাবে তাঁর অভিমত জ্ঞাপন করেন। তবে বলবনের বক্তব্যের সাথে আলাউদ্দিনের বক্তব্যের মধ্যে মূলগত মিল থাকলেও প্রকৃতিগত স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয়। বলবন বাজার স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, তবে সিংহাসনকে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদাদানের চেষ্টা তিনি করেননি। বলবন সুলতানের ব্যক্তিগত মর্যাদা ও দৈবনির্দিষ্ট প্রতিপত্তির তত্ত্ব প্রচার করেন। কিন্তু আলাউদ্দিন সিংহাসনকে নির্দিষ্ট কর্তৃত্ব ও মর্যাদাদানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রকে একটি স্বনির্ভর ও লৌকিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার উদ্যোগ নেন।
বলবনের মতো আলাউদ্দিনও নিজেকে ‘সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতিনিধি’ বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, ঈশ্বরের ‘মনোনীত ব্যক্তি’ হিসেবে সুলতান যে-কোনো মানুষের তুলনায় অধিক প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। তাই সুলতানের ইচ্ছাই ছিল আইন। “Kingship knows no Kinship”- এই তত্ত্বানুসারে আলাউদ্দিন মনে করতেন, রাষ্ট্রের সমস্ত মানুষ সুলতানের চাকর কিংবা প্রজা; সুলতান অতুলনীয়। যে-কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত হয়ে রাষ্ট্রপরিচালনা করা রাজার পবিত্র কর্তব্য শুধু নয়; এটি রাজতন্ত্রের মহান অধিকারও বটে। ব্যক্তিগতভাবে আলাউদ্দিন ছিলেন মুসলমান এবং একথা তিনি গর্বের সাথে প্রকাশও করতেন। কিন্তু রাজতন্ত্রের ওপর ধর্মতন্ত্রের প্রাধান্য কিংবা রাষ্ট্রনীতির ওপর ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রভাব স্থাপন করতে দিতে তিনি রাজি ছিলেন না। আলাউদ্দিনের রাজতান্ত্রিক আদর্শের বৈশিষ্ট্য, স্বাতন্ত্র্য এবং মহানুভবতা হল ধর্ম থেকে রাষ্ট্রনীতির বিচ্ছিন্নকরণ।
মধ্যযুগীয় রীতি অনুযায়ী তখন রাজতন্ত্রের ওপর অভিজাতশ্রেণি এবং উলেমাদের প্রভাব ছিল সর্বময়। আমির, মালিক প্রভৃতি অভিজাতশ্রেণির মানুষ ছিলেন রাজনৈতিক পদাধিকারবলে সুবিধাভোগী শ্রেণি এবং প্রবল কর্তৃত্বের অধিকারী। নবপ্রতিষ্ঠিত দিল্লি-সুলতানির রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির উৎসভূমি এই শ্রেণির বিরুদ্ধাচরণ করার ক্ষমতা বা সাহস আলাউদ্দিনের পূর্ববর্তী শাসকদের ছিল না। বলবন সুলতান হিসেবে তাঁর নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট ছিলেন; কিন্তু শ্রেণি হিসেবে অভিজাতদের মর্যাদা তিনি খর্ব করতে চাননি। অন্যদিকে ইসলামীয় রাষ্ট্রের ধ্যানধারণা অনুযায়ী বিশ্বের যে-কোনো অঞ্চলের মুসলমান রাজতন্ত্র খলিফার অধীন এবং পবিত্র কোরান, হাদিস, শরিয়ত ইত্যাদির ভিত্তিতে শাসিত হতে বাধ্য। এবং ধর্মের রক্ষক ও ব্যাখ্যাকার হিসেবে ‘উলেমা’দের রাজনৈতিক প্রাধান্য অর্জন অনিবার্য। কিন্তু আলাউদ্দিন দৃঢ়ভাবে অভিজাতশ্রেণি এবং উলেমাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অস্বীকার করে রাজতন্ত্রকে একটি নতুন মর্যাদা দেন। আলাউদ্দিন অভিজাতদের দমন করার জন্য একাধিক আইন প্রণয়ন করেন এবং কঠোরভাবে তা প্রয়োগ করেন। অভিজাতদের ‘গোষ্ঠীতন্ত্র’কে ভেঙে দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন যে, সুলতানের ইচ্ছানুসারে এবং রাজ্যের প্রয়োজনানুসারে তাঁরাও নিয়ন্ত্রিত হতে দায়বদ্ধ।
একইভাবে আলাউদ্দিন রাষ্ট্রনীতির ওপর থেকে উলেমাদের মৌরুসীপাট্টার অবসান ঘটান। কোরানে উলেমাদের স্থান নির্দিষ্ট করা আছে। কে. এম. আসরাফ লিখেছেন : “উলেমাদের দায়িত্ব ছিল কর্মাদর্শের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ধর্মপথে আকৃষ্ট করা।” কিন্তু কোরানের ব্যাখ্যাকার হিসেবে ভারতে সুলতানি শাসনের সূচনা থেকেই উলেমারা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ভোগ করতে শুরু করেন। এমনকি বলবনের আমলেও রাষ্ট্রনীতির ওপর উলেমাদের প্রভাব অব্যাহত ছিল। কিন্তু আলাউদ্দিন দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন যে, ‘রাষ্ট্রনীতি’ এবং ‘ধর্মনীতি’ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দুটি দিক। উলেমাদের কাজ ধর্মনীতি চর্চা করা, রাজনীতি চর্চা করা নয়। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের ন্যায়বিধান সম্পর্কে উলেমাদের তুলনায় সুলতানের জ্ঞান অনেক বেশি। বেয়ানার কাজি মুখিসউদ্দিন উলেমাদের কর্তৃত্বের প্রশ্নে সুলতানের সাথে একমত ছিলেন না। তাই তিনি পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর ধর্মের প্রভাবকে স্বাভাবিক বলে বর্ণনা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আলাউদ্দিন তাঁর সঙ্গে কথোপকথন প্রসঙ্গে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, “আমি জানি না কোন্টি আইনসম্মত এবং কোন্টি বে-আইনি। রাষ্ট্রের পক্ষে যা মঙ্গলজনক কিংবা আপৎকালে যা জরুরি বলে মনে করি, আমি তাই বাস্তবায়িত করি; এবং সেক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিচারের দিন আমার কি হবে সে চিন্তা আমি করি না” (“I do not know whether this is lawful or unlawful; whatever I think to be for the good of the state or suitable for the emergency that I decree, and as for what may happen to me on the approaching day of judgement that I know not. “)। আলাউদ্দিন কথা প্রসঙ্গে কাজিকে বলেন, “সাধারণ মানুষ একরোখা এবং রাজাদেশ অগ্রাহ্য করার প্রবণতাই তাদের বেশি। তাই সুলতানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি তাদের ওপর কঠোরতম শাক্তি চাপিয়ে দিতে বাধ্য।” ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে আলাউদ্দিনের এই ধারণা হল ঘটনাপ্রবাহের অনিবার্য পরিণতি। মোঙ্গলদের আক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা থেকে আলাউদ্দিন যেভাবে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিয়েছিলেন; তাতে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত ব্যক্তিত্ব হিসেবে আলাউদ্দিনকে গ্রহণ করার ব্যাপারে প্রজাদের মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। নিজের এই ভিত্তি সম্পর্কে আলাউদ্দিন সচেতন ছিলেন বলেই ত্রয়োদশ শতকের এত বড়ো একটা অচলায়তনকে ভেঙে বেরিয়ে আসার সৎ সাহস দেখিয়েছিলেন।
সুলতানের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য খলিফার অনুমোদন একান্ত আবশ্যিক বলে আলাউদ্দিন মনে করতেন না। তাই তিনি কখনোই খলিফার অনুমোদনলাভের চেষ্টা করেননি বা নিজেকে ‘খলিফার ভৃত্য’ বলে অভিহিত করেননি। অবশ্য তিনি নিজেকে খলিফার সহকারী হিসেবে প্রতিভাত করার জন্য ‘ইয়াসিন-উদ্-খলিফা’ উপাধি গ্রহণ করেন। শ্রীবাস্তবের মতে, “আলাউদ্দিন রাজনৈতিক প্রভু হিসেবে খলিফাকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে এই উপাধি নেননি। আসলে আলাউদ্দিন খিলাফতের তত্ত্বীয় ঐতিহ্য ও ঐক্যকে রক্ষা করার জন্যই এই উপাধি ধারণ করেছিলেন।”
আলাউদ্দিন রাজনীতিকে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করলেও, তাঁর রাজাদর্শ কতখানি ধর্মনিরপেক্ষ ছিল, তা বলা কঠিন। নাসিরুদ্দিন চিরাগ বা আমির খসরু তাঁদের গ্রন্থে যথাক্রমে ‘খয়ের উল-মজলিস’ এবং ‘খাজাইন-উল-ফুতুহ’তে আলাউদ্দিনের চরিত্রের যে চিত্র এঁকেছেন, তাতে তাঁকে ‘মুসলমান শাসক’ বলা চলে, কিন্তু ‘মুসলমানের শাসক’ নয়। ‘খয়ের-উল্-মজলিসে’ সুলতানের একটি উক্তিতে শাসক হিসেবে প্রজাসাধারণের প্রতি তাঁর কর্তব্যবোধ এবং তাকে রূপায়িত করার আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে। সুলতান আন্তরিকভাবে বলছেন, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সৃষ্ট অসংখ্য জীব আছে। কিন্তু তিনি আমাকে তাদের ওপরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সুতরাং এখন তাদের মঙ্গলার্থে আমার এমন কিছু করা উচিত, যার সুযোগ সকলের কাছে পৌঁছাতে পারে। আমির খসরু লিখেছেন : “The Sultan’s fostering care for the sons of Adam is greater than that of the sun for the moon and stars.” অর্থাৎ আলাউদ্দিন সামগ্রিকভাবে প্রজাদের মঙ্গলবিধান করা সুলতানের অন্যতম কর্তব্য বলে মনে করতেন। আধুনিক কোনো কোনো লেখকও এই মত পোষণ করেন। কিন্তু ড. শ্রীবাস্তবের মতে, আলাউদ্দিন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আদর্শে আদৌ আস্থাবান ছিলেন না। হিন্দুদের ওপর দমনমূলক আইনপ্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দ্বিধাহীন। তাই হিন্দুদের অধিকার সম্পর্কে কাজি মুঘিসউদ্দিন যখন বলেন যে, “রাজস্ব সংগ্রাহক হিন্দুদের কাছে রৌপ্যমুদ্রা দাবি করলে তাদের স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া উচিত, কিংবা ঈশ্বর স্বয়ং তাদের লাঞ্ছিত করার বিধান দিয়েছেন।” তখন আলাউদ্দিন প্রতিবাদ না করেই হৃষ্টচিত্তে তা অনুমোদন করেন। অথচ ইমাম আবু হানিফা পরিষ্কার ব্যাখ্যা করেছেন যে, “জিজিয়া প্রদানের পরিবর্তে হিন্দুরা রাজনৈতিক অধিকার ও নিরাপত্তা ভোগের অধিকারী।” আসলে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয়; আলাউদ্দিনের লক্ষ্য ছিল তাঁর ব্যক্তিগত অধিকার ও কর্তৃত্ব যাতে উলেমাদের হস্তক্ষেপের দ্বারা বিঘ্নিত না হয়, তা সুনিশ্চিত করা। তাই ড. আর. পি. ত্রিপাঠী বলেছেন: “যে অর্থে আকবরকে ধর্মনিরপেক্ষ বলা যায়, সেই অর্থে আলাউদ্দিনকে বলা চলে না। কারণ আলাউদ্দিনের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা ছিল প্রয়োজনভিত্তিক, আদর্শভিত্তিক নয়।” ড. শ্রীবাস্তব মনে করেন, আলাউদ্দিন সচেতনভাবেই হিন্দুদের ওপর নিষ্পেষণ চালান এবং তা ধর্মের জন্যই। তিনি লিখেছেনঃ “His policy which was one of repressing them completely, was not due to a momentory vagary, but formed part of his settled ideology.” ড. কে. কে. দত্ত মনে করেন, “উদারনৈতিক প্রজাকল্যাণমূলক আদর্শের ওপর ভিত্তি করে আলাউদ্দিনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ গড়ে উঠলে, তা স্থায়ী হত। কিন্তু রাজনৈতিক চোরাবালির ওপর গড়ে ওঠা তাঁর সাম্রাজ্য তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ধ্বসে পড়ে।”
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আলাউদ্দিনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ নতুন পথের দিশারী হিসেবে স্মরণীয়। মধ্যযুগীয় পরিমণ্ডলে তিনি প্রবল প্রতাপশালী অভিজাত এবং উলেমাদের প্রভাব থেকে রাজতন্ত্রকে মুক্ত করার যে উদ্যোগ নেন, তা অভূতপূর্ব। এইভাবে আলাউদ্দিন সিংহাসনকে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে মর্যাদাদানের যে কাজ শুরু করেন, মহম্মদ-বিন-তুঘলক তাকেই পূর্ণতা দেবার চেষ্টা করেন।
তুঘলক বংশের শাসকদের চিন্তাধারায় আর একটা পরিবর্তন দেখা যায়। ইলবেরি তুর্কি শাসকগণ কিংবা খলজিদের বিশাল অনুগত উপজাতীয় অনুচরবৃন্দ ছিল। এই অনুচরদের সন্তুষ্ট রেখেই তাঁদের রাষ্ট্রনীতি স্থির করতে হয়েছিল। কিন্তু তুঘলকদের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাভোগী একটি শ্রেণিকে উৎসাহ দিতে হয়নি। আবার আলাউদ্দিনের আমলে রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মাচরণের মধ্যে যে বিচ্ছেদ ঘটানো হয়েছিল, তুঘলকদের কাছে সেটাও অনুকরণযোগ্য বিবেচিত হয়েছিল।
মহম্মদ-বিন্-তুঘলক উত্তরাধিকার সূত্রে যে বিশাল সাম্রাজ্য ও অতিসমৃদ্ধ রাজকোষ পেয়েছিলেন, সম্ভবত দিল্লির অন্য কোনো মুসলমান শাসক তা পাননি। কাশ্মীর, আফগানিস্তান ও বালুচিস্তান ছাড়া সমগ্র ভারত ছিল দিল্লির অধীনস্থ। সুলতানি রাজ্যের সীমানা প্রসারিত ছিল উত্তর-পূর্বে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে উত্তর-পশ্চিমে সিন্ধু পর্যন্ত। পূর্ব-পশ্চিমে এর বিস্তৃতি ছিল সমুদ্র থেকে সমুদ্র। সাম্রাজ্য বিভক্ত ছিল প্রায় ২৪টি প্রদেশে। অবশ্য প্রদেশের সংখ্যা সম্পর্কে বারাণী কিছুই লেখেননি। ইবন বতুতা কেবল আংশিক উল্লেখ করেছেন। তবে সাম্রাজ্যের পরিধি ছিল বিশাল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু চিরাচরিত অর্থে মহম্মদ তাঁর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে রক্ষা করতে উৎসাহী ছিলেন না। তাঁর মস্তিষ্ক ছিল উর্বর। কল্পনাপ্রবণ ছিল তাঁর মন। যুক্তি, তর্ক ও দর্শনের সমন্বয়ে তিনি একদিকে ভারতীয় সীমারেখার মধ্যে জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে তুলতে এবং অন্যদিকে দেশের সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিকতার আদর্শ প্রচার করতে উদ্যত হয়েছিলেন। রাজনৈতিক এবং ধর্মনৈতিক চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে মহম্মদ তুঘলক যে অসাধারণ এবং অস্বাভাবিক মৌলিকত্বের অধিকারী ছিলেন, তা বোঝাতেই বারাণী ‘ইকৃতিরাহ্’, ‘তহকিমত্-ই-মুজাদ্দিদ’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করেছেন।
মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের রাজনৈতিক আদর্শের মূল কথা ছিল ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক ঐক্য। তাঁর সিংহাসনারোহণের কালে ভারত-রাষ্ট্রের ধারণা ছিল অসম্পূর্ণ। কারণ উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারত রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক বিচারে একই ধারার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। উত্তর ভারতে ছিল সুলতানির প্রত্যক্ষ শাসন, কিন্তু দক্ষিণ ভারতে ছিল স্থানীয় রাজাদের আনুগত্যমূলক স্বশাসন। উত্তর ভারতে ছিল হিন্দু-মুসলিম মিশ্র সংস্কৃতির অবস্থান, কিন্তু দক্ষিণে ছিল হিন্দু সংস্কৃতির প্রাধান্য। সুলতান মহম্মদ দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করে দক্ষিণ ভারতের সাংস্কৃতিক রূপান্তরের সূচনা করেন। দিল্লি থেকে দৌলতাবাদ হয়ে মুলতান কিংবা বাংলাদেশ থেকে গুজরাট পর্যন্ত সুলতানি-বাহিনীর পদচারণার সাথে সাথে বণিক, পণ্ডিত, মরমিয়া সাধক, কবি, ছাত্র ইত্যাদি সমাজের নানাস্তরের মানুষের যাতায়াতের সুবাদে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন সম্ভাবনাপূর্ণ হয়। মহম্মদ তুঘলকের কর্তৃত্বে এই সংহত ভারতরাষ্ট্র গঠনের প্রয়াসের প্রশংসা করে ড. কে. এ. নিজামী লিখেছেন: “Perhaps no ruler after Asoka had visualised India as a political and administrative unit in the same way as Muhammad bin Tughluq.”
সমসাময়িক এশিয়ার রাজনৈতিক শূন্যতার পরিপ্রেক্ষিতে সুলতানের মনে মধ্য-এশিয়ার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপনের পরিকল্পনা দানা বাঁধে। ইল খাঁ-দের ক্ষমতা তখন অন্তর্হিত, তৈমুরের তখনও জন্ম হয়নি। এমতাবস্থায় মহম্মদের রাজনৈতিক উচ্চাশা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় ছিল না। খোরাসান বিজয়ের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির মধ্যে সুলতানের এই ইচ্ছার প্রমাণ পাওয়া যায়। অধ্যাপক নিজামী একেই উচ্চ সাম্রাজ্যবাদ’ বলে অভিহিত করেছেন। বারাণীর বিবরণ থেকেও মহম্মদ তুঘলকের বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদী অভীপ্সার আভাস পাওয়া যায়। বারাণী লিখেছেন : “সুলতানের তুলনাবিহীন ব্যক্তিত্বের মধ্যে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা এত গভীরভাবে প্রোথিত যে, বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ বাসভূমি (তখন মনে করা হত বাকি তিন-চতুর্থাংশ জল এবং বাসযোগ্য নয়) যদি তাঁর ক্রীতদাসদের অধীনে থাকত ; পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণে প্রসারিত ভূখণ্ডের সমস্ত মানুষ যদি তাঁকে কর প্রদান করত এবং তাঁর নিয়ন্ত্রণে স্থাপিত হত………এবং তার পরেও যদি সুলতান কারও কাছে জানতে পারতেন যে, কোনো দ্বীপের সামান্যতম অংশ কিংবা কোনো দেশের একটা ঘরের সমপরিমাণ ভূখণ্ড তাঁর অধীনস্থ হয়নি, তাহলে সেই স্থানটি দখল না করা পর্যন্ত তাঁর নদী-সদৃশ হৃদয় এবং তাঁর বিশ্বজয়ের উদ্দীপনা শান্ত হত না।” সাম্রাজ্যবাদী মনস্কতার দিক থেকে মহম্মদ তুঘলক গ্রিকবীর আলেকজান্ডারকে অতিক্রম করেছিলেন বলে বারাণী উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, আলেকজান্ডারের মর্যাদায় উন্নীত হয়েও সুলতান সন্তুষ্ট হতেন না। তিনি ডেভিডের পুত্র সলোমনের মতো মানুষ ও অদৃশ্য জিন—উভয়ের ওপর কর্তৃত্ব করতে ইচ্ছুক ছিলেন। নবি এবং সুলতানি, ধর্মপ্রচারক এবং শাসকের দ্বৈত-ক্ষমতা ভোগ করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা সুলতান মহম্মদকে ব্যথিত করত। তিনি বহির্বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক যোগস্থাপনের পক্ষপাতী ছিলেন। এই কারণে ১৩৪০ ‘৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বহু জিনিসের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক তুলে দেন। চিন, মিশর, ইরাক, ইরান, সিরিয়া প্রভৃতি দেশের সাথে দ্রুত বিনিময় এবং উপঢৌকন বিনিময়ের মাধ্যমে সুলতান মহম্মদ-বিন্ তুঘলক ভারতবর্ষের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিকতার প্রবেশ ঘটান। ড. নিজামী এটিকে ‘ভারতের রাজনীতির এক নতুন অধ্যায়’ বলে অভিহিত করেছেন।
সুলতানের কর্তৃত্ব ও সাম্রাজ্যের সংহতির পরিপন্থী উপাদান হিসেবে মুসলিম অভিজাতশ্রেণির স্বাধীনতাবোধ ও কর্তৃত্ববোধের বিপদ সম্পর্কে সুলতান মহম্মদ তুঘলক সচেতন ছিলেন। তাই বংশানুক্রমিক অভিজাতবর্গের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ঔদ্ধত্যকে দমন করার জন্য তিনি যোগ্যতার ভিত্তিতে উচ্চরাজপদে কর্মী নিয়োগ শুরু করেন। এইভাবে বংশকৌলীন্যহীন একদল নতুন অভিজাত তৈরি করে তিনি অভিজাত বংশগুলির আমলাতান্ত্রিক একাধিপত্য বিনষ্ট করেন। এ প্রসঙ্গে ড. ত্রিপাঠী (R.P.Tripathy) লিখেছেন: “পুরাতন, উন্নাসিক এবং সংশোধনের অতীত অভিজাতদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি সুবিধাহীন ও নিম্নশ্রেণির মানুষের মধ্য থেকে এক নতুন আমলাতন্ত্র সৃষ্টি করেন” (“To get rid of the high browed nobility which was old and incorrigible he began to gradually raise a new class of official from among the lower and non privileged class.”)। মহম্মদের এই নীতির ফলে ধর্মান্তরিত মুসলমান এবং অনুগত হিন্দুদের মধ্য থেকে বহু যোগ্য ব্যক্তি উচ্চরাজপদে নিযুক্ত হবার সুযোগ পায়। ড. নিজামীর মতে, মহম্মদ তুঘলক তাঁর গভীর জ্ঞান ও রাষ্ট্রপ্রজ্ঞা দ্বারা উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারত-সাম্রাজ্যকে স্থায়িত্ব ও বিস্তৃতি দিতে গেলে সমস্ত শ্রেণির মুসলমানকে যেমন প্রশাসনের সাথে যুক্ত করতে হবে, তেমনি যোগ্যতাসম্পন্ন হিন্দুদেরও সরকারের দায়িত্বশীল পদে নিযুক্ত করতে হবে। তাঁর মতে, বারাণী ছিলেন প্রাচীনপন্থী এবং গোঁড়া। তাই মহম্মদ তুঘলকের দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থতা তিনি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কায়েমি স্বাৰ্থবোধে অন্ধ প্রাচীন অভিজাতদের সম্পর্কে সুলতানের কঠোর মনোভাব ছিল বাস্তব অভিজ্ঞতার ফল। গুরুসাম্প, বাহাউদ্দিন প্রমুখের বিদ্রোহ সুলতানকে কঠোর হাতে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে এবং বিকল্প হিসেবে যোগ্যতার ভিত্তিতে নতুন আমলাতন্ত্র গড়ে তুলতে বাধ্য করেছিল।
ফিরোজ শাহ তুঘলকের সিংহাসন প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে আবার নতুনতর বৈশিষ্ট্য সংযোজিত হয়। ফিরোজের সিংহাসনে আরোহণ সমর্থন করেছিলেন অভিজাতরা তার অনুমোদন দিয়েছিলেন মৌলবিরা। ফলে সুলতানিতে আবার নির্বাচন প্রথা ফিরে আসে। অস্ত্রের শক্তি নয়, অভিজাত ও ধর্মগুরুদের অনুমোদনই রাজা নির্বাচনের মাপকাঠি—এই সত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যক্তিগত আচরণে বিনম্র ও ভদ্র ফিরোজ ধর্মকে সামনে রেখে জনহিতকর কতর্ব্যকেই রাজকীয় দায়বদ্ধতা বলে গ্রহণ করেছিলেন।