সুলতানি আমলে রাষ্ট্রের প্রকৃতি:
‘রাষ্ট্র’ প্রাথমিকভাবে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দেশ বা জাতির সামাজিক ও সাস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলির বিকাশের উপযোগী ক্ষেত্র হিসেবে রাষ্ট্রের স্থান সর্বাগ্রে। স্বভাবতই মধ্যকালীন ভারতবর্ষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারার উত্থানপতনের গতিপ্রকৃতি জানার জন্য ভারতে সুলতানি শাসনের প্রকৃতি বিচার গুরুত্বপূর্ণ। তুর্কি-আফগান শাসকগণ সমকালীন ভারত-রাষ্ট্রকে একটি ‘ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিভাত করার ক্ষীণ চেষ্টা করেছেন। অন্তত, তাঁরা প্রকাশ্যে সুলতানি রাষ্ট্রকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে অভিহিত করেননি। ইসলামের প্রসারের প্রাথমিক পর্বে সে ধরনের চেষ্টা হয়তো তাঁদের পক্ষে আত্মবিনাশের সমার্থক হত। কিন্তু তত্ত্ব এবং তার প্রয়োগের মধ্যে পার্থক্য খুবই স্পষ্ট। এবং এখান থেকেই শুরু হয়েছে একটি জ্বলন্ত বিতর্কের; এবং তা হল সুলতানি রাষ্ট্র ‘ধর্মাশ্রয়ী’ (Theocratic) ছিল, নাকি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ (Secular) ছিল।
ভারতে তুর্কি-আফগান সুলতানদের আমলে রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে স্পষ্ট মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। আর. পি. ত্রিপাঠী. ঈশ্বরীপ্রসাদ, এ, এল, শ্রীবাস্তব প্রমুখ মনে করেন, তুর্কি আফগান যুগে ভারত রাষ্ট্র ছিল ধর্মাশ্রয়ী (Theocratic)। ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, সুলতানদের সীমাহীন ক্ষমতা অবশ্যই ছিল; এক বিচারে প্রশাসনিক ও ধর্মীয় বিচারে সুলতান ছিলেন সর্বেসর্বা (“both Caeser as well as Pope’)। কিন্তু সুলতানেরা শরিয়তের নির্দেশ লঙ্ঘন করতে পারতেন না। শরিয়ত বা ধর্মশাস্ত্রের বিধান ছিল সুলতানি আমলের নীতিনির্ধারণের মাধ্যম। উলেমাদের চিন্তাভাবনাকে মর্যাদা দিতে শাসককুল দায়বদ্ধ ছিলেন। মধ্যযুগে সুলতানদের শাসন বিষয়ে অনুসৃত পথ ও পদ্ধতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল ইসলামধর্মের অনুশাসনগুলিকে বাস্তবায়িত করা। ড. ত্রিপাঠী লিখেছেন : “All the institutions that the Muslims either evolved or adopted were intended to subserve the law.” অন্যদিকে ড. কুরেশী (I. H. Qureshi), মহম্মদ হাবিব, সতীশচন্দ্র প্রমুখ অনেকেই ঠিক বিপরীত মত পোষণ করেন। এঁদের মতে, সুলতানি রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে ‘ধর্মাশ্রয়ী’ বা ‘পুরোহিততান্ত্রিক ছিল না। ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই ভারতের সুলতানি আমলে হয় অনুপস্থিত ছিল, অথবা লঙ্ঘিত হয়েছিল। এই গোষ্ঠীর মতে, সুলতানি রাষ্ট্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ, সামরিক এবং অভিজাততান্ত্রিক।
এই বিতর্কের সমাধানে পৌঁছানোর জন্য ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য এবং ইসলামের ধর্মতত্ত্ব সুলতানি আমলে কতখানি বা কীরূপে প্রযুক্ত ছিল, তা জানা আবশ্যিক। Theocracy’ বা ‘দেবতন্ত্র’ শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ‘Theos’ থেকে। এর অর্থ ঈশ্বর (God)। দেবতান্ত্রিক বা ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র সরাসরি ঈশ্বর কর্তৃক কিংবা তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে যাজকশ্রেণি (Sacerdotal class) দ্বারা শাসিত হয়। একটি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী। এই ধরনের রাষ্ট্রে ধর্মীয় আইনই চূড়ান্ত এবং পুরোহিত বা যাজকশ্রেণি অনিবার্যভাবে সেই অদৃশ্যমান ঈশ্বরের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। অর্থাৎ একটি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল— (ক) সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, (খ) যেখানে মানব-সৃষ্ট আইনের পরিবর্তে ঈশ্বর নির্দিষ্ট বিধান আইন হিসেবে প্রযুক্ত হয় এবং (গ) অদৃশ্যমান ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে পুরোহিতশ্রেণি ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে রাষ্ট্রীয় কাজ সম্পাদন করেন। এই প্রেক্ষাপটে ভারতে সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিচার করা যেতে পারে।
মহানবি হজরত মহম্মদের আবির্ভাবের পর নানা বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে ইসলামীয় রাষ্ট্রের পতা ও বিকাশ ঘটেছে। হজরত মহম্মদ পরিস্থতিগত কারণে মক্কা থেকে মদিনায় পরিযান কালে তাঁর অনুগামীদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার্থে রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এইভাবে তিনি বিশ্বে প্রথম মুসলিম রাষ্ট্রের পত্তন করেন এবং একাধানের আল্লাহর প্রত্যাদিষ্ট বাণী প্রচার ও ‘বিশ্বাসী’দের ইহজাগতিক জীবনের রক্ষকের ভূমিকা পালন করেন। হজরতের তিরোধানের পর ইসলামীয় রাষ্ট্রের পরিচালনভার খলিফার ওপর অর্পিত হয়েছিল। একটি সংগঠিত গোষ্ঠী হিসেবে মুসলমানদের কিছু কর্তব্য ও দায়িত্ব এবং কর্তব্যভিত্তিক যে আইনবিধি রচিত হয়েছে, তা হল ‘শর’ বা ‘শরিয়ত’। খলিফা শরিয়ত-এর ভিত্তিতে মুসলমান জগৎকে পরিচালনা করার জন্য দায়বদ্ধ। ইবন খালদুন-এর ব্যাখ্যা অনুসারে, অনুশাসনিক প্রয়োজনে খিলাফৎ-এর সৃষ্টি, তাই ইসলামীয় আইন অনুসারে খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রতিটি মুসলমানের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। অবশ্য খলিফাকে অন্যান্য ধর্মের মতো প্রধান পুরোহিত আখ্যা দেওয়া যায় না। কারণ ইসলামধর্মে পুরোহিততন্ত্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। যাই হোক্, ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষা ও প্রসারের জন্য আবশ্যিক ইসলামীয় বন্ধনসৃষ্টির ভিত্তি হিসেবে খলিফাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। এখানে মুসলমানদের স্বাধীন ও সার্বভৌম গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা একটি রাজনৈতিক ধারণা ; এবং সেই রাজনৈতিক কাজটি সম্পন্ন করেন খলিফা। এই অর্থে খলিফাতন্ত্র বা খিলাফৎ একটি রাজনৈতিক সংগঠন ; যার উৎস ধর্মীয় অনুশাসন থেকেই।
ড. কুরেশীর (I. H. Quershi) ভাষায়: “The Caliphate is a political institution so far as its functions are concerned: -through its basis and Sanctions are canonical” অর্থাৎ ইসলামীয় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক শক্তি, সংগঠন ও ভিত্তিস্বরূপ ধর্মের অস্তিত্ব অনিবার্য। সার্বভৌম ক্ষমতার একমাত্র অধিকারী ছিলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে প্রথমে পয়গম্বর এবং তাঁর তিরোধানের পর ‘খলিফা’ ইসলামীয় রাষ্ট্রমণ্ডলের সর্বোচ্চ পরিচালক। অন্যান্য শাসকেরা কখনোই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নন, তারা খলিফার নায়েব মাত্র। অর্থাৎ ইসলামীয় তত্ত্ব অনুযায়ী এই রাষ্ট্রের লক্ষ্য হল ‘ঈশ্বরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং খলিফা ‘আল্লার নির্দেশে আল্লার জীবকুলের বিচার ও শাসন করতে’ দায়বদ্ধ। এই বিচারে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র ত্রিবিধ কিন্তু অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য দ্বারা মণ্ডিত— ‘এক প্রত্যাদেশ, এক সার্বভৌম এবং এক জাতি’ (one scripture, one sovereign and one nation)। এই প্রত্যাদেশ হল পবিত্র কোরান, সার্বভৌম হল। ‘ইমাম’ (খলিফা) এবং জাতি হল ‘মিল্লাত’বা ইসলামিক সৌভ্রাতৃত্ব। ইসলামিক রাষ্ট্রের মৌল বৈশিষ্ট্য হল এই তিনটি শর্তের অবিভাজ্যতা। সাধারণভাবে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হল মুসলমানদের নিয়ে গঠিত, মুসলমান দ্বারা পরিচালিত এবং মুসলমানদের সুখ ও মঙ্গলবিধানের জন্য একান্তভাবে দায়বদ্ধ।
ইসলামীয় রাষ্ট্রের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল উলেমাদের অস্তিত্ব। ইবন হুসেন-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী যে শিক্ষিতশ্রেণি শরিয়ত-এর গূঢ় অর্থ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করে তা ব্যাখ্যা ও প্রচার করেন, তিনিই ‘উলেমা’। এঁদের মধ্য থেকে নির্বাচিত একজন রাষ্ট্র-শাসন বিষয়ে শাসককে পরামর্শ দেবার জন্য দায়িত্ব পান। তিনি হলেন ‘শেখ-উল-ইসলাম’। অর্থাৎ ইসলামীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় উলেমাগণ বা তাদের প্রতিনিধি ‘শরা’র ব্যাখ্যা, প্রচার ও পরামর্শদানের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালনের অধিকারী। ইসলামীয় রাষ্ট্রের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল ‘মিল্লাত’। মিল্লাত হল ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনগণের সৌভ্রাতৃত্ব। একটি প্রকৃত ইসলামীয় রাষ্ট্রে ‘মিল্লাত’ সৰ্বমুখী সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তাভোগের অধিকারী। মিল্লাত নয় এমন মানুষকে দু-ভাগে চিহ্নিত করা হয়—(১) ‘আইন-ই-কিতাব’ অর্থাৎ ধর্মশাস্ত্রে যাদের নাম পাওয়া যায়, যেমন ইহুদি ও খ্রিস্টান প্রভৃতি। এরা হল জিম্মি। নির্দিষ্ট শর্তপালনের পরিবর্তে এরা ইসলামীয় রাষ্ট্রের সেবা পেতে সক্ষম। এবং (২) অন্যান্য সবাই যারা পৌত্তলিক। ধর্মশাস্ত্রে এই পৌত্তলিকদের জন্য কোনো অধিকার স্বীকৃত নয়।
ভারতে সুলতানি যুগের অন্যতম তাত্ত্বিক ছিলেন জিয়াউদ্দিন বারাণী। আটজন সুলতানের কাজের সাথে তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহি’ গ্রন্থে তিনি সুলতানদের জীবনী ও কীর্তি বর্ণনা করেছেন। অন্যদিকে ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহি’র সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে রচনা করেছেন ‘ফতোয়া-ই-জাহান্দারী। যেখানে সুলতানের দায়িত্ব, কর্তব্য, ইসলাম ধর্মমতে রাজতন্ত্রের অবস্থান এবং ভারতে সুলতান শাহি রাজতন্ত্রকে কীভাবে ব্যবহার করেছেন, তার বিবরণ দিয়েছেন। ভারতে সুলতানি শাসনকালে রাষ্ট্রের প্রকৃতি অনুধাবনের জন্য বারাণীর অভিমতগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য বারাণীর বক্তব্য বহুক্ষেত্রে প্রয়োগ করার প্রয়াস এবং অন্যদিকে ইসলামের রাজনৈতিক সম্প্রসারণজনিত পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে প্রতিফলিত করার ইচ্ছা বারাণীর বক্তব্যকে সামঞ্জস্যহীন করে তুলেছে।
বারাণীর মতে, ধর্ম ও রাজনীতি পরস্পরের সহায়ক। ধর্মীয় প্রধান ও রাজনৈতিক প্রধান দুই যমজ ভাই। ধর্ম ছাড়া রাজনীতি অর্থহীন ; রাজনীতি ছাড়া ধর্ম অসহায়। মন্দ জগৎকে শুধুমাত্র ধর্মীয় পথে শুদ্ধ করা যায় না। তাই রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন আছে। শাসকের কর্তব্য প্রসঙ্গে বারাণী লিখেছেন যে, শাসক এমনভাবে রাজকার্য পরিচালনা করবেন, যাতে ঈশ্বর প্রদত্ত সকল শক্তি ও সম্পদ অধর্ম ও বিধর্মীদের উৎখাতের কাজে প্রযুক্ত হয়। তাঁর মতে, সুলতান এমনভাবে শাহিকর্তব্য পালন করবেন যাতে কোনো বিধর্মী কোনো বিষয়ে মুসলমানদের ওপর প্রভূত্ব প্রকাশ করতে না পারে। শরিয়তের বিধিবিধানের প্রয়োগ এবং ইসলামীয় বিধানকে সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করাকেও তিনি শাসকের মৌল་ কর্তব্য বলে ঘোষণা করেন।
বারাণীর বক্তব্যের বিচারে দিল্লি-সুলতানির ধর্মাশ্রয়িতা সম্পর্কে ঈশ্বরীপ্রসাদ, শ্রীবাস্তব প্রমুখ ঐতিহাসকের বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। তত্ত্বগতভাবে সুলতানেরা ভারতে বিধর্মী বা শত্রুর রাজত্বের (দার-উল্-হার্ব) অবসান ঘটিয়ে ইসলামের রাজত্ব ও বিশ্বাসীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নৈতিক দায়িত্ব অস্বীকার করেননি। দিল্লির তুর্কি-আফগান সুলতানেরা নিজেদের ইসলামীয় জগতের একটি অংশ বলে মনে করতেন। দু-একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত ছাড়া অধিকাংশ সুলতান ইসলামীয় আদর্শ অনুসরণে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করতেন। দিল্লির সুলতানেরা ইসলামীয় বিধি অনুসারে খলিফাকে নিজেদের ‘প্রভু’ বলে গণ্য করতেন। আলাউদ্দিন খলজি ও মুবারকশাহ খলজি ছাড়া অন্যান্য সুলতানেরা নিজেদের খলিফার সহকারী বলেই গণ্য করতেন। খলিফার কাছ থেকে এঁরা নিজ পদের স্বীকৃতি হিসেবে ‘নাসির ই-আমির-উল-মুমনিন’ (খলিফার সহকারী) বা ‘ইয়ামিন-উল-খলিফা’ (খলিফার দক্ষিণহস্ত) ইত্যাদি উপাধি গ্রহণ করে কৃতার্থ বোধ করেছিলেন। ইলতুৎমিস ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘খলিফার প্রতিনিধি’ হিসেবে স্বীকৃতি-পত্র (মনসুর) লাভ করেন। গিয়াসউদ্দিন বলবন নিজেকে ‘খলিফার সহকারী’ নামে অভিহিত করে গর্ববোধ করেন। মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিজ খাঁ’র পৌত্র হলাকু ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খলিফা মুস্তাসিম বিল্লাহকে হত্যা করে বাগদাদে খলিফাতন্ত্রের অবসান ঘটান।
কিন্তু তার পরেও ভারতের সুলতানেরা খলিফার প্রতি আনুগত্যের বন্ধন ছিন্ন করার সাহস দেখাননি। খলিফার অবর্তমানেও দিল্লির সুলতানেরা নিজেদের ‘খলিফার সহকারী’ বলে অভিহিত করতেন, তাঁদের মুদ্রায় খলিফার নাম উৎকীর্ণ করতেন এবং খলিফার নামে ‘খুৎবা’ পাঠ করতেন। মহম্মদ-বিন-তুঘলক তাঁর রাজত্বের প্রথমদিকে তাঁর মুদ্রা থেকে খলিফার নাম বাদ দেন। সুলতানি শাসনের প্রায় পঁচাত্তর বছর ধরে চলে আসা ব্যবস্থার বাইরে কিন্তু তিনিও বেশিদিন থাকতে পারেননি। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহে বিব্রত মহম্মদের শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছিল যে, খলিফার অদৃশ্য অনুমোদন ছাড়া তাঁর পক্ষে এই রাজনৈতিক দুর্যোগমুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি রাজত্বের শেষদিকে মুদ্রায় খলিফার নাম পুনঃপ্রবর্তন করেন। তখন বাগদাদ থেকে অপসারিত হয়ে আব্বাসীয় খলিফার বংশধরেরা মিশরে বসবাস করছিলেন। মহম্মদ তুঘলক মিশর থেকে আব্বাসীয় খলিফার জনৈক বংশধরের স্বীকৃতি-পত্র আদায়ের মাধ্যমে ‘মিল্লাত-এর কাছে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করেন। এমনকি খলিফার জনৈক আত্মীয় দৌলতাবাদে উপস্থিত হলে সুলতান তাঁকে অভূতপূর্ব সম্মান প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। ফিরোজ তুঘলক একাধিকবার দূত প্রেরণ করে মিশর থেকে খলিফার অনুমোদনপত্র সংগ্রহ করেন। তিনি ‘নায়েব-ই-আমির-উল-মুমনিন’ বা খলিফার নায়েব উপাধি গ্রহণ করে কৃতার্থ হন। খলিফার নামে ‘খুৎবা’ পাঠ করেন এবং মুদ্রা খোদাই করেন। ফিরোজ-এর আমলে সরকারিভাবে ধর্মান্তরিতকরণকে উৎসাহিত করা হত। কেবল হিন্দু নয়, অ-সুন্নি মুসলমানদের প্রতিও তিনি অসহিষ্ণু আচরণ করতেন। অবশ্য ফিরোজ শাহের পর কোনো সুলতান খলিফার অনুমোদন প্রার্থনা করেননি।
সুলতানি শাসনের ধর্মাশ্রয়িতা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর উলেমাশ্রেণির প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের কথা উল্লেখ করা হয়। অভিযোগটি অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। সুলতানি আমলে উলেমাতন্ত্র কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র পায়নি কিংবা উলেমাগণ বংশানুক্রমিকভাবে পদ ভোগ করার অধিকারী ছিলেন না। তথাপি সুলতানি আমলের রাষ্ট্রব্যবস্থায় উলেমারা বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। উলেমারা মূল ইসলামী আইন ‘শরিয়ত’ ব্যাখ্যা করতেন এবং সুলতান তা মান্য করতেন। সুলতানি শাসনের প্রথমদিকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে উলেমাদের প্রচণ্ড প্রভাব লক্ষ্য করা অসম্ভব নয়। আলাউদ্দিন খলজির পূর্ববর্তী প্রায় সব সুলতানই উলেমাদের সম্মতি ছাড়া কোনো কাজ করতে ভীতি বোধ করতেন। আলাউদ্দিন খলজি ও মহম্মদ-বিন্-তুঘলক উলেমাদের এবং উলেমাতন্ত্রের প্রভাব থেকে রাষ্ট্রনীতিকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু এই ব্যতিক্রম ছাড়া সমগ্র সুলতানি আমলে উলেমাদের কর্তৃত্ব ছিল অবাধ। ড. ইউসুফ হুসেন লিখেছেন যে, উলেমারা ছিলেন গোঁড়া ও পরিবর্তন-বিরোধী। এদের শিক্ষা হত মাদ্রাসায়। এদের পাঠ্যসূচির সাথে ধর্মের গভীর যোগ আছে। সুলতানি আমলে বিচার ও প্রশাসকের অধিকাংশ পদে উলেমারা নিয়োজিত হতেন। ফলে সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তাঁদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা সম্ভব হয়েছিল। ড. রোমিলা থাপার লিখেছেন : “ধর্ম ও রাজনীতির মিলনের ফলে রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রে উলেমাদের প্রভাব অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না। ইসলামীয় প্রতিষ্ঠান ও উলেমাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সুলতানের পক্ষে আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সুলতানরা উলেমাদের ভূমিদান করতেন, মসজিদ নির্মাণ করতেন এবং উলেমাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য মাঝে মাঝে হিন্দুদের দেবমূর্তি ও মন্দির ধ্বংস করে অ-মুসলমান-বিরোধী ভাবমূর্তি তুলে ধরতেন।”
ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ, এ. এল. শ্রীবাস্তব, আর, পি. ত্রিপাঠী প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ সুলতানি আমলে উমেলাদের একাধিপত্যের বিষয়ে সহমত পোষণ করেছেন। এঁদের মতে, এই উলেমারা ছিলেন প্রায় ধর্মান্ধ এবং মূলত হিন্দুবিদ্বেষী। ধর্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দেওয়াকে এঁরা মহান ও পুণ্যকর্ম বলে প্রচার করেন। মুসলিম শাসকশ্রেণিকে এই ধর্মযুদ্ধ করার জন্য নিরন্তর প্ররোচিত করতে থাকেন। রাষ্ট্রনীতি হিসেবে উলেমারা অ-মুসলমানদের বিনাশসাধন, মূর্তিপূজার অবসান ঘটানো এবং অবিশ্বাসীদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করাকে মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য বলে প্রচার করেন।
ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ লিখেছেন : “The Muslim State in India as elsewhere was a theocracy. The kingf was Caesar and Pope combined in one. But he is merely to carryout God’s will.” তিনি লিখেছেন : সুলতানি আমলের সামাজিক আইনগুলি ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্রের নির্দেশের ভিত্তিতেই রচিত হয়েছিল। দিল্লির সুলতানেরা উলেমাদের পরামর্শ নিয়ে রাষ্ট্রায় আইনবিধি রচনা করতেন। রাজকীয় অনুশাসনের ভিত্তি ছিল শরিয়তের নির্দেশনামা। উলেমারা শরিয়তের ভিত্তিতে সুলতানকে ১২টি কর্তব্য পালনের যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা একমাত্র মহম্মদ তুঘলক ছাড়া সবাই মান্য করতেন। এমনকি আলাউদ্দিন খলজিও রাষ্ট্রনীতিকে ধর্মের বন্ধনমুক্ত করার যে প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন, তা ছিল প্রয়োজনভিত্তিক। মুসলিম রাষ্ট্রে পৌত্তলিকদের অধিকার প্রসঙ্গে কাজি মুখিসউদ্দিন তাদের (হিন্দুদের) দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক এবং অতিরিক্ত করদানে বাধ্য জাতীয় মনোভাব ব্যক্ত করলে আলাউদ্দিন তার প্রতিবাদ করতে পারেননি। ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, সুলতানি আমলের করব্যবস্থা শরিয়ত অনুসারে প্রযুক্ত ছিল। অ-মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার কাজে রাষ্ট্রযন্ত্রকে সরাসরি ব্যবহার করা হত। মুসলমান রাষ্ট্রে বাস করার মতোই ‘জিম্মি’দের কাছ থেকে ‘জিজিয়া’ কর আদায় করা হত। ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্র ছাড়া নাগরিকদের ক্ষেত্রে এই করবৈষম্য সম্ভব ছিল না। তিনি লিখেছেনঃ “Toleration under Muslim domination in India in the early middle ages was not the rule but the exception.” ড. ত্রিপাঠী (R. P. Tripathy)-র দৃঢ় অভিমত হল যে, “সুলতানি আমলে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের একমাত্র লক্ষ্য ছিল শরিয়তের নির্দেশ বাস্তবায়িত করা। এঁরা নিশ্চিত যে, ‘সুলতানি রাষ্ট্র ছিল ধর্মাশ্রয়ী ও পুরোহিততান্ত্রিক।”
রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ওপর যাজকশ্রেণির বা উলেমাদের এই প্রভাব রাষ্ট্রের সংহতির সহায়ক ছিল না। প্রশাসনের ওপর উলেমাদের প্রভাবের ব্যাপকতা সম্পর্কে দ্বিমত থাকলেও (পরে এ প্রসঙ্গে আলোচনা আছে) এ কথা সত্যি যে, ভারতের সদ্যপ্রতিষ্ঠিত সুলতানি রাষ্ট্রে এই ধর্মতাত্ত্বিকদের যথেষ্ট রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল। পরে এদের প্রভাবের চরিত্র পাল্টেছে; কিন্তু প্রভাবটা কোনো না-কোনো ভাবেই থেকে গেছে। এই গোষ্ঠীর সংকীর্ণ মানসিকতা রাষ্ট্রের সর্বজনীন আদর্শের পরিপন্থী ছিল অবশ্যই। ‘রাজার ধর্ম প্রজার ধর্ম’—এই ধারণা যে ভারতের মতো দেশে অচল, এ কথা তাঁরা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে স্মরণীয় যে, কোরানে বা হাদিসে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার বিধান নেই। মানুষের কাছে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের মাধ্যমে তার মতপরিবর্তনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁরা রাষ্ট্রনেতা বা প্রশাসক ছিলেন না। তাঁদের আচরণে সার্বিক মানবতাবোধ অনুপস্থিত ছিল। উলেমাদের এই ত্রুটি সম্পর্কে ক্রমে সুলতানরাও সচেতন হয়েছিলেন। সুলতানদের বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে উলেমারাও তাঁদের অবস্থান পাল্টেছিলেন।
ইসলামের উদারনৈতিক তাত্ত্বিকদের বিশ্লেষণটিও একসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। এঁরা মুসলমান শাসকের দায়িত্ব ও কর্তব্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে পবিত্র ধর্মগ্রন্থের বিশেষ কিছু আয়াত এবং হজরত মহম্মদ প্রণীত মদিনা চুক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। হজরত প্রাথমিকভাবে আরবদেশের বিবদমান কৌম গোষ্ঠীগুলির মধ্যে শান্তিপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার-সহ বিশ্বাসীদের যে গোষ্ঠী গড়েছিলেন, তা প্রকৃতিগতভাবে ছিল অরাজনৈতিক। বিশিষ্ট পণ্ডিত রফিক জাকারিয়া তাঁর The struggle within Islam: The conflict between Religion and Politics (1988) গ্রন্থে বলেছেন যে, হজরত মহম্মদ একজন শাসনকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার কথা প্রথমে ভাবেননি। তাঁর লক্ষ্য ছিল কোরানের বাণী প্রচার করা এবং মানুষকে বিশ্বাস-এ আস্থাশীল করে তোলা। কিন্তু সেই লক্ষ্যে এগোতে গিয়ে তিনি যে প্রবল বিরোধিতা ও হিংসাত্মক বিরোধিতার সম্মুখীন হন, তাতে তিনিও শেষ পর্যন্ত অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হন। আক্রমণ নয়, আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই তাঁর অস্ত্রধারণ। অস্ত্রের জোরে মানুষকে তার বিশ্বাস থেকে ছুঁড়ে ফেলা নয়, মন পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষকে কোরানের আদর্শে ব্রতী করাই ছিল হজরতের লক্ষ্য। পবিত্র কোরানে ঘোষিত “ধর্মের জন্য কোনো বাড়াবাড়ি নাই, তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম এবং আমার জন্য আমার ধর্ম”—এই সহনশীল আদর্শবাদের প্রকাশ দেখা যায় তাঁর মদিনাচুক্তিতে। এই চুক্তিতে মহানবি অ-মুসলমানদের (জিম্মি) জন্য শর্তাধানে নিজ নিজ ধর্মে স্থিত থাকার অধিকার, জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত না-করা ইত্যাদি শর্তাবলীর সংযোজন করেছেন।
দিল্লি-সুলতানির রাজনৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণের সময় কোরান এবং মহান নবির উদারতান্ত্রিক আদর্শবাদের দিক্টিও নজরে রাখা জরুরি। সুলতানি যুগের বিশিষ্ট তাত্ত্বিক জিয়াউদ্দিন বারাণীও লিখেছেন যে, বাদশাহ তাঁর কাজের মাধ্যমে অন্তরের সৌন্দর্য প্রকাশিত করবেন। দিল্লির সুলতানরা যথেষ্ট বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কোরানের তত্ত্ব এবং ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে সমন্বয় বিধান দ্বারাই যে রাজনৈতিক স্থায়িত্ব নিশ্চিত হতে পারে, এই সত্য উপলব্ধি করতে দিল্লির সুলতানদের অসুবিধা হয়নি।
খলিফার স্বীকৃতিপত্র পাওয়ার জন্য কিংবা প্রশাসনে উলেমাতন্ত্রের ওপর নির্ভরতার কারণে অনেকেই সুলতানি রাষ্ট্রকে ‘ধর্মাশ্রয়ী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন, তার বিরোধী মতের বক্তব্যও বেশ জোরালো এবং তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। ড. মহম্মদ হাবিব, ইফতিকার আলম খান, কে. এম. আসরাফ, ড. মুজিব, সতীশ চন্দ্র প্রমুখ ইতিহাসবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এবং ঘটনাপরম্পরা বিচার করে প্রমাণ করেছেন যে, ভারতে মধ্যযুগের সুলতানি রাষ্ট্র আদৌ ‘ধর্মাশ্রয়ী’ ছিল না। ড. কুরোশীর মতে, ‘শরা’বা শরিয়তের প্রাধান্যবশত অনেকে সুলতানি রাষ্ট্রকে ‘ধর্মাশ্রয়ী’ বলে ভুল করেন। রোমিলা থাপারের মতে, “মধ্যযুগে সুলতানি আমলের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে খাঁটি ইসলামী আখ্যা দেওয়া অসম্ভব।” ড. মহম্মদ হাবিব লিখেছেন: “It was not theocratic state in any sense of the word and that its foundation was non-religious and secular.”
পবিত্র কোরানে বর্ণিত ইসলামীয় ধর্মরাজ্যের সাথে ভারতে প্রতিষ্ঠিত সুলতানি রাষ্ট্রে মিলের থেকে অমিলের পাল্লাটাই বেশি ভারী। কোরান বর্ণিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বতন্ত্র সুলতান শাহির কোনো স্থান নেই। হজরত মহম্মদ এবং চারজন মহান খলিফার শাসনকালের পর মুসলিম রাষ্ট্রব্যবস্থায় “সুলতান” নামক এক নতুন কর্তৃপক্ষের অধিষ্ঠান ঘটে। ‘সুলতান’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘ক্ষমতা’ বা কর্তৃত্ব। ইসলামের আইনে এই ধরনের কোনো কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু ভারতবর্ষে এই ‘সুলতানশাহি’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অধ্যাপক আশরাফ-এর মতে, দিল্লির সুলতানদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার ধারণা কোরানের ভাবনায় অনুপস্থিত এবং একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই ধারণার উদ্ভব ঘটেছে, যা বিশ্ব ইসলামিক আন্দোলনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাঁর মতে, কোরানের রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা মদিনার সুদৃঢ় গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও উপজাতীয় পারিপার্শ্বিকতায় কার্যকরী ছিল। কিন্তু ইসলাম ধর্মের দ্রুত প্রসার ও রাজনৈতিক বৃহত্তর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যবস্থা অপ্রতুল হয়ে পড়ে। এই সময় আরব চিন্তাবিদদের একাংশ অরাজকতা নিরসনের প্রয়োজনে ‘ন্যায়বোধহীন অত্যাচারী রাজতন্ত্র ও কাম্য বলে প্রচার করেন। এইভাবে কোরান-অতিরিক্ত বা বহির্ভূত একটি রাজনৈতিক তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। ভারতের সুলতানি শাসন এই তত্ত্বেরই ফসল।
মদিনার পতনের পর বাগদাদ খলিফার প্রধান কর্মকেন্দ্রে পরিণত হলে কোরানের অনুশাসন ও হজরতের ‘সুন্নাহ’ ভিত্তিক ধর্মরাষ্ট্রের ভাবনায় পরিবর্তন লক্ষণীয়ভাবে এসে পড়ে। পারসিক সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে আরবদের রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। পারসিক রাজতন্ত্রের অধিকাংশ বৈশিষ্ট্য মুসলমানরা গ্রহণ করে। এদের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল ‘রাজার ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতার তত্ত্বা (Divine power of the king)। কিন্তু দৈবশক্তির সাথে শাসকের কোনোরূপ সম্পর্কের কথা কোরানে বলা হয়নি। তবে পারস্যের শাসানীয় বংশের রাজনৈতিক তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারতে তুর্কিরা রাজতন্ত্র সম্পর্কে একটা নতুন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এঁরা দাবি করেন যে, সুলতান তাঁর রাজতান্ত্রিক ক্ষমতা পেয়েছেন ঈশ্বরের কাছ থেকে। ‘সুলতান’ কথাটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘ক্ষমতা’ বা ‘কর্তৃত্ব’। সেই অধিকারটিকে নিরঙ্কুশ করার জন্য এঁরা সুলতানকে ‘আল্লাহ’র ছায়া’ (জিল-উল্-আহ) বলে প্রচার করেন (‘the vicegerent of God and His shadow on the earth’)। এরূপ রাষ্ট্রদর্শন গড়ে ওঠার পেছনে পরিস্থিতিগত প্রয়োজন ছিল যথেষ্ট।
ইসলামের প্রসারের গোড়ার দিকে সুলতান শাসিত রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে বিশ্বের নানা অঞ্চলে ইসলামধর্ম প্রসারিত হবার পর শাসকশ্রেণি অনুভব করেন যে, কোরান- বর্ণিত অনুজ্ঞার সাহায্যে এই বিস্তৃত ও বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে ইসলামের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সম্ভব নয়। ফলে মধ্যযুগে ইসলামের রাষ্ট্রদর্শনে নতুন কথা বলা শুরু হয়। এতে বলা হয় যে, মানুষ সামাজিক জীব এবং সংঘবদ্ধতার মধ্যেই তাঁর পূর্ণ বিকাশ সম্ভব। কিন্তু ব্যক্তি-মানুষের সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা এই সংঘবদ্ধ জীবনে ভাঙন ধরাতে সদা তৎপর ; এবং তা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক কোনো আচরণ নয়। এই বৈপরীত্যের মধ্যে সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণের জন্যেই ইসলামীয় আইনবিধির সৃষ্টি। কিন্তু কিছু মানুষ স্বার্থান্ধতার জন্য এবং কিছু মানুষ অজ্ঞতার জন্য সেই আইনকে অস্বীকার করতে সচেষ্ট। এমতাবস্থায় প্রয়োজন একজন ক্ষমতাবান শাসকের, যিনি শক্তি প্রয়োগ করে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবেন। অল্ গজালী এই শাসককে (সুলতান) ‘রাষ্ট্রদেহের হৃদযন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। সুলতানের একক কর্তৃত্ব, অভিজাতবর্গের ক্ষমতার দত্ত এবং ‘মিল্লাত’ থেকে তাদের বিচ্ছিন্নতা কোরানের অনুশাসন ভেঙে দেয়। পারস্যের সম্ভোগময় জীবনধারা মুসলমানদের আকর্ষণ করে। ভারতবর্ষের অফুরন্ত সম্পদ নবাগত যোদ্ধাদের কাছে সহজেই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। তাই বলা চলে, শরিয়তের ‘রাজ্য’ এবং মধ্যযুগীয় সুলতান রাষ্ট্রের ধারণা সম্পূর্ণ এক নয়।
খলিফাতন্ত্রের প্রতি দিল্লির সুলতানদের আনুগত্য ছিল বাহ্যিক। সুলতানেরা প্রত্যেকেই ছিলেন। ভাগ্যান্বেষী সৈনিক। ব্যক্তিগত প্রতিভা ও উদ্যোগের দ্বারা এঁরা ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এঁদের নিয়োগ বা পদচ্যুতি কিছুই খলিফার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিল না। এঁদের কেউ কেউ খলিয় অনুমোদন গ্রহণ করেছিলেন সত্য কিন্তু তা ধর্মীয় আনুগত্যের জন্য নয়, রাজনৈতিক প্রয়োজনের দাবিতে। এঁরা বুঝতে সক্ষম ছিলেন যে, খলিফার অনুমোদনের তক্কা থাকলে ভারতের অভ্যন্তরে ও বাইরে বৃহত্তর মুসলিম সমাজের নৈতিক সমর্থন পাওয়া সম্ভব হবে। এই সমর্থন দ্বারা ভারতের আদি শক্তিগুলির (রাজপুত/হিন্দু) ওপর একটা মানসিক চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ ধর্মানুগত্য নয়— রাজনৈতিক ভীতি থেকে তাঁরা এ কাজে আগ্রহী হয়েছিলেন। আলাউদ্দিন খলজির মতো সমরনায়ক বা মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের মতো জ্ঞানী সুলতান খলিফার অনুমোদনের প্রত্যাশী ছিলেন না। সুলতানদের অনেকেই নিজ নামে ‘খুত্বা’ পাঠ করতেন, নিজ নামে ‘মুদ্রা’ খোদাই করতেন। সুলতান মুবারক খলজি নিজেই ‘খলিফা’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তাই শরিয়ত-এ খলিফার কর্তৃত্ব ও মর্যাদার সাথে দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের কর্মবীরদের আচরণের মধ্যে সমন্বয়সাধনের চেষ্টা ভাবের ঘরে চুরি’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
ভারতে সুলতানি শাসনব্যবস্থার ওপর ‘উলেমা’ শ্রেণির প্রভাব-সম্পর্কিত ব্যাখ্যা অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট। কোরান ও শরিয়ত-বিশেষজ্ঞ এই গোষ্ঠী প্রকৃত ইসলামিক রাষ্ট্রে যে ধরনের প্রতিপত্তির অধিকারী হতে পারতেন, ভারতের ক্ষেত্রে তা সম্ভব ছিল না। স্বৈরাচারী সুলতানি শাসনে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া (যেমন, ফিরোজ তুঘলক-এর আমল) রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে উলেমাদের কর্তৃত্ব আদৌ স্বীকৃত হত না। কেবল সুলতানের ইচ্ছানুযায়ী ধর্মসংক্রান্ত কিছু পরামর্শ দান এবং বিচারবিভাগের কিছু উচ্চপদ লাভ করেই এঁরা সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হতেন। প্রসঙ্গত, সুলতান ইলতুৎমিসের আমলের একটি ঘটনা স্মরণীয়। একবার উলেমারা দলবদ্ধভাবে সুলতানের কাছে গিয়ে ইসলামীয় আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তাঁরা বলেন যে, হিন্দুরা হয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে, নতুবা মৃত্যুবরণ করবে। প্রত্যুত্তরে সুলতানের মতানুযায়ী উজির উলেমাদের জানিয়ে দেন যে, এই ব্যবস্থা বাস্তবসম্মত নয় এবং রাজনীতিসম্মতও নয়। কারণ ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ঠ ; — যেন ভাতের থালায় লবণ-এর মতো। অনুরূপভাবে আলাউদ্দিন খলজি একদা বেয়ানার কাজি এবং প্রখ্যাত কোরান-বিশেষজ্ঞ মুঘিসউদ্দিনকে রাজস্ব সম্পর্কে ধর্মীয় নির্দেশ ব্যাখ্যা করতে বললে কাজি সভায় বলেছিলেন, “বুঝতে পারছি আমার ইহকাল শেষ হয়েছে। কারণ আমি ইসলামের প্রকৃত ব্যাখ্যা দিলে সুলতান কুপিত হবেন।”
অতঃপর আলাউদ্দিনের অভয় পেয়ে কাজি ধর্মের নির্দেশ ব্যাখ্যা করলে সুলতান জানিয়ে দেন, “আপনার কথা আমি বুঝি না। আমার সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি এবং প্রজাদের অটুট আনুগত্য সুনিশ্চিত করেছি।” অর্থাৎ আলাউদ্দিন বুঝিয়ে দেন যে, সুলতানের ইচ্ছাই আইন। বস্তুত, ভারতে সুলতানি শাসনের সূচনাপর্বে উলেমাকুল প্রশাসনে কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য শরিয়তকে নিজেদের মতো করে সামনে আনতে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু ইলতুৎমিসের আমলেই তাঁরা বুঝতে পারেন যে, সুলতানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে তাঁদের অস্তিত্বের সংকট দেখা দিতে পারে। তাই তাঁরা সুলতানের কার্যকলাপের সমর্থনে ধর্মীয় ও নৈতিক ব্যাখ্যা প্রচার শুরু করেছিলেন। উলেমারা ঈশ্বরের দূত হিসেবে সুলতানকে স্বীকার করে নিয়ে প্রচার করেন যে, সুলতানই আল্লা-নির্দেশিত ‘মান্যব্যক্তি’ (উলুল-অস্র এ-মিন্-কুস)। কোরানের অনুজ্ঞার নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, সুলতানের (ইমাম) আদেশ মান্য করাই আল্লার বিধান বা হজরতের নির্দেশ মান্য করা। সুলতানের নির্দেশ অমান্য করার অর্থ ঈশ্বরের নির্দেশ অমান্য করা। অর্থাৎ উলেমাদের নির্দেশ অনুসারে সুলতান চালিত হতেন না; সুলতানের ইচ্ছানুযায়ী উলেমারা শরিয়তের ব্যাখ্যাকে পরিবর্তন করে নিতেন।
শরিয়তের ছোটোখাটো বহু নির্দেশ রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সুলতানি আমলে ভঙ্গ করা হত। (ক) ইসলামের তত্ত্বানুযায়ী মুসলমানের প্রাণদণ্ড নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলক ছাড়া অন্যান্য সুলতানের আমলে শাস্তি হিসেবে মুসলিমদেরও প্রাণদণ্ড দেওয়া হত। (খ) শরিয়তের বিধানে সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ। কিন্তু সুলতানি আমলে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির স্বার্থে ঋণদান ও সুদ গ্রহণ সরকারিভাবে স্বীকৃত ছিল। (গ) শরিয়তে পৌত্তলিকদের জন্য ইসলামীয় রাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার স্বীকৃত নয়। কিন্তু সুলতানি রাষ্ট্রে হিন্দুরা কমসংখ্যায় হলেও, সরকারি পদে নিযুক্ত হত। রাজস্ববিভাগে হিন্দুদের একাধিপত্য ছিল। (ঘ) ‘জিম্মি’ হিসেবে হিন্দুদের গ্রহণ করলেও ব্রাহ্মণ, স্ত্রীলোক, শিশু ও সহায়সম্বলহীন ব্যক্তিদের ‘জিজিয়া’ কর প্রদান থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছিল। (ঙ) মধ্যযুগে শরিয়ত-এর আইন সুলতানদের ওপর আদৌ বাধ্যতামূলক ছিল না। বারাণী লিখেছেন যে, “সুলতান রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিয়মকানুন (জাওবিং) তৈরি করেন। আলাউদ্দিন খলজি বিয়ানার কাজিকে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন যে, কোনটা আইনসম্মত বা কোন্টা আইনসম্মত নয়, তা তিনি জানেন না, যা তিনি রাষ্ট্রের পক্ষে প্রয়োজনীয় মনে করেন, তাকেই তিনি আইন হিসেবে গ্রহণ করেন।”অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে শরিয়তের বাইরেও আইন প্রণয়ন করা হত। এবং তা যে সব সময় শরিয়তের বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকত তাও নয়। (চ) তুর্কি-আফগান সুলতানেরা ছিলেন স্বৈরাচারী ক্ষমতার অধিকারী। সুলতান ছিলেন সমস্ত ক্ষমতার আধার।
সাম্প্রতিক কিছু গবেষক জোরালো যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, সাধারণভাবে ইসলামীয় রাষ্ট্রতত্ত্বে ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট দুর্বল এবং ব্যক্তিগত স্বৈরাশাসনের সম্ভাবনা সেখানে প্রবল।’ ভারতের সুলতানি রাষ্ট্রও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম ছিল না। এই ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক ধাঁচের পরিষদ বা সংগঠিত যাজকশ্রেণির অনুপস্থিতি সুলতানকে একচ্ছত্র আধিপত্য ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরশাসনের সুযোগ করে দেয়। পার্থিব ও অপার্থিব সমস্ত বিষয়ে সুলতানের ইচ্ছাই ছিল চূড়ান্ত। শরিয়ত বা উলেমা কেউই সুলতানদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। তাই কে. এম. আশরাফ লিখেছেন : “কোরানে রাজনৈতিক আদর্শের যতই উদার ভাষ্য করা হোক না কেন; রাজশক্তির এহেন জ্বলন্ত ও নির্লজ্জ স্বেচ্ছাচারিতার সাথে তাকে খাপ খাওয়ানো যায় না।”
ভারতে সুলতানি রাষ্ট্র ‘ধর্মাশ্রিত’ বা ‘পুরোহিততান্ত্রিক’ ছিল না—এ কথা মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকে যায়—তাহলে সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি কী ছিল? এ প্রসঙ্গে দুটি মত খুবই জোরালো এবং যথেষ্ট যুক্তিসমর্থিত। জিয়াউদ্দিন বারাণীর মতে, সুলতানি আমলে ভারত ছিল পার্থিব বা ধর্মনিরপেক্ষ (জাহান্দারি) রাষ্ট্র। ইসলামের নামে শপথ গ্রহণ করে সুলতান হয়তো প্রকাশ্যে শরিয়তের অনুশাসন ও ইসলামের ঐতিহ্য অস্বীকার করতে পারতেন না; কিন্তু তাঁরা এটাও উপলব্ধি করেছিলেন যে, স্বৈরশাসন বজায় রাখতে হলে ধর্মদর্শনকে রাষ্ট্রদর্শনে পরিণত করা চলবে না। কঠোর ধর্মীয় অনুজ্ঞা নানাভাবে সুলতানের কর্তৃত্ব ও স্থায়িত্বকে বিব্রত করতে সক্ষম। তাই সুলতানেরা এই অপ্রিয় কাজ থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতেন। ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে, শাসকের ব্যক্তিগত উদারতা বা ধর্মান্ধতা দ্বারা রাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হত। মুসলমান শাসকেরা এদেশে ক্ষমতাদখলের প্রাথমিক পর্বে নিজেদের একপ্রকার কর্মবৃত্তির মধ্যে আবদ্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু বেশিদিন এই অবস্থা বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। ক্রমে তাদের ভারতীয় জীবনধারার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছিল। আর্থ-রাজনৈতিক প্রয়োজনেই তাঁরা হিন্দুদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিলেন। ক্ষমতার জন্য বিভিন্ন মুসলিম গোষ্ঠীর সংঘাত অনিবার্যভাবেই শাসকদের হিন্দু সামন্ত ও জমিদারদের ওপর নির্ভরশীল করেছিল। ড. ভট্টাচার্যের ভাষায় : “ব্যবহারিক জীবনে এই সহাবস্থানটাই মুখ্য হয়ে উঠেছিল, ধর্মটা গৌণ। উলেমাদের সপক্ষে রাখার প্রয়োজনে কোনো কোনো সুলতান অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বা ধর্মাধিষ্ঠানের প্রতি কঠোর আচরণ করতেন। কিন্তু তা সীমাবদ্ধ থাকত শহরাঞ্চলের ক্ষুদ্র পরিসরে বা মুসলমানপ্রধান স্থানগুলিতে। কিন্তু বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত রীতিনীতির কোনো ভাঙন দেখা যায়নি। বারাণী সুলতানদের ধর্মনিরপেক্ষতার কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। বলবন একবার বলেছিলেন: “আমার প্রভু ইলতুৎমিস প্রায়শই বলতেন যে, সুলতানের পক্ষে ধর্মবিশ্বাস মেনে কাজ করা সম্ভব নয়। তাঁর পক্ষে এটাই যথেষ্ট যে, তিনি ধর্মবিশ্বাস রক্ষা করতে সক্ষম। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে ন্যায়বিচার করতে পারলেই খুশি থাকব।” জালালউদ্দিন খলজি একবার বলেছিলেন যে, “হিন্দুরা দেবদেবীর মূর্তি যমুনা নদীতে বিসর্জন দেবার জন্য নৃত্যগীত সহযোগে রাজপ্রসাদের পাশ দিয়ে চলে যেত। সুলতানকে অসহায়ভাবে তা সহ্য করতে হত।” ড. সতীশচন্দ্র লিখেছেন যেঃ “জিজিয়ার মাধ্যমে বলপূর্বক হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হত না। এমনকি তরবারির ভয় দেখিয়েও ধর্মান্তরিত করা হয়নি।” নিজামউদ্দিন আউলিয়া লিখেছেন : “হিন্দুরা জানে ইসলাম সত্যকার ধর্ম, তথাপি তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি।” আসলে বাস্তববাদী সুলতানেরা জানতেন যে, জোর করে ঐতিহ্যশালী হিন্দুধর্মকে ধ্বংস করা যাবে না। এবং তাঁদের লক্ষ্যও তা ছিল না। এঁরা ছিলেন ভাগ্যান্বেষী সৈনিক। বিলাসব্যসনের মধ্যে যত বেশি দিন সম্ভব রাজত্ব করাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। তাই ধর্ম বা রাজনীতির খুঁটিনাটি নিয়ে তারা মাথা ঘামাতেন না। তাই দেখা যায়, ইসলামে আত্মহত্যা অপরাধ। সতীদাহ একধরনের আত্মহত্যাই। তথাপি সুলতানি আমলে তা মেনে নেওয়া হয়েছে। সুলতানি আমলে হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার যত ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য জিজিয়ার চাপ বা বলপ্রয়োগ যতটা দায়ী ছিল, তাঁর থেকে অনেক বেশি দায়ী ছিল। হিন্দুদের রাজনৈতিক লাভ, অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির একান্ত আকাঙ্ক্ষা।
সুলতান ইলতুৎমিসের ‘ন্যায়বিচার’ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক নুরুল হাসান তাঁর ‘মধ্যযুগের ভারতে রাষ্ট্র ও ধর্মসংক্রান্ত কিছু সমস্যা’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন যে, মধ্যযুগের ভারতে ন্যায়বিচারের অর্থ ছিল সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করা, অর্থাৎ সমাজের কোনো অংশ যেন অপর অংশের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে তা সুনিশ্চিত করা। ধর্মনির্বিশেষে সকল সামাজিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই এই আদর্শ প্রযুক্ত ছিল। অধ্যাপক হাসানের মতে, ধর্ম অপেক্ষা রাষ্ট্রের প্রয়োজনই সুলতানের কাছে অধিক জরুরি বলে বিবেচিত হত। এটিই ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি প্রয়োজনবোধ দ্বারা চালিত হয়ে এই আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন, আবার মহম্মদ তুঘলকের নিরপেক্ষতার ভিত্তি ছিল আদর্শবোধ। অন্যান্যদের ক্ষেত্রে এটি এসেছিল উদাসীনতা থেকে। আর সিকন্দর লোদীর মতো সংকীর্ণমনা হিন্দুপীড়নকারী সুলতানের দৃষ্টান্ত নিছক ব্যতিক্রম মাত্র।
ভারতে সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে অধিকাংশ আধুনিক ইতিহাসবিদদের মত হল যে, এটি ছিল ‘সামরিক ও অভিজাততান্ত্রিক’ (Military and aristocratic) । ধর্ম, দর্শন বা প্রজাকল্যাণ কোনো কিছুই নির্দিষ্ট রাষ্ট্রদর্শন হিসেবে গৃহীত হয়নি। সবই ছিল আপেক্ষিক। আসলে রাষ্ট্র ছিল সামরিক শক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং অভিজাতগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত একটি সংগঠন। সুলতান অস্ত্রবলে সিংহাসন দখল করতেন এবং অস্ত্রের মাধ্যমেই তা রক্ষা করতেন। সুলতানের ব্যক্তিগত সামরিক দক্ষতার ওপর নির্ভর করত তাঁর স্থায়িত্ব। প্রজাকল্যাণমূলক বা সৃজনধর্মী যা কিছু তাঁরা করতেন, তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সম্রাটের ‘মহানুভব’ ভাবমুর্তি তুলে ধরা। সুলতানি রাষ্ট্র ছিল একপ্রকার পুলিশি রাষ্ট্র (Police State) যার প্রধান কাজ ছিল শক্তির দ্বারা রাজ্যজয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং রাজস্ব আদায়। এই কাজের জন্য সুলতানের একার ক্ষমতা যথেষ্ট ছিল না। তাই সুলতানেরা একটি দক্ষ ও বিশ্বস্ত অভিজাতগোষ্ঠী গড়ে তোলেন। রাষ্ট্রের উচ্চ পদগুলি তুর্কি অভিজাতদের একচেটিয়া ছিল। গ্রামাঞ্চলে হিন্দু অভিজাতগোষ্ঠী আগের মতোই স্ব-স্ব পদে নিয়োজিত ছিলেন। ‘গ্রামীণ হিন্দু অভিজাত ও শহুরে তুর্কি অভিজাতদের মধ্যে অকথিত ক্ষমতার বিভাজন দিল্লি-সুলতানির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।’ ড. মুজিব ‘Gazetter of India’-র দ্বিতীয় খণ্ডে সুলতানি যুগের অভিজাততন্ত্রের প্রাধান্য বিশ্লেষণ করে একটু নতুন কথা বলেছেন। তার মতে, প্রকৃতিগতভাবে দিল্লি-সুলতানি ছিল স্বৈরতান্ত্রিক ও এককেন্দ্রিক। কিন্তু বাস্তবে আঞ্চলিক শাসকেরা ছিলেন প্রায় স্বাধীন। এঁদের মৌলিক আনুগত্যের ওপর সুলতানি রাষ্ট্রের ঐক্য দাঁড়িয়েছিল। তিনি লিখেছেন : “Delhi Suiltanate was in theory a unitary government but it was actually a confederation of semi-independent territorial units…”