বিজয়নগর রাজ্যের নায়ঙ্কারা (নায়ক) প্রথা:
বিজয়নগর রাজ্যের সামরিক ব্যবস্থা ও ভূমিদান রীতির সাথে বিশেষভাবে জড়িত ছিল ‘নায়ক’ বা ‘নায়ঙ্কারা’ প্রথা। ষোড়শ শতকে পোর্তুগীজদের প্রতিবেদনে বিজয়নগরের ‘নায়ক’ উপাধিধারীদের ‘ক্যাপ্টেন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা দক্ষিণ আমেকিরান উপনিবেশে প্রচলিত পদ্ধতির সাথে নায়কব্যবস্থাকে মিলিয়ে ফেলেছেন। সংস্কৃত সাহিত্যে ‘নায়ক’ অর্থে নেতা বা বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। কিন্তু বিজয়নগরের ‘নায়ক’ প্রথা কিছুটা স্বতন্ত্র। নায়কদের অধিকার, কর্তব্য ও নায়ক প্রথার প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। অধ্যাপক অনিরুদ্ধ রায়ের মতে, ১ বিজয়নগরে নায়করা স্থানীয় নেতৃবর্গের থেকে স্বাধীন। ফলে নতুন নতুন মানুষ সহজেই এই রাজনৈতিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে। যেমনভাবে তেলেগু যোদ্ধারা তামিলদের মধ্যে মিলে গিয়েছিল। বিজয়নগরের বিভিন্ন শিলালেখতে ‘অমরয়ঙ্কর শব্দটি পাওয়া যায়। এখানে ‘অমর’ অর্থে সৈন্যাধ্যক্ষ, ‘’নায়ক’ অর্থে নেতা এবং ‘কর’ বলতে সরকারি কাজকে বোঝানো হয়েছে। এই ব্যাখ্যার ভিত্তিতে ‘নায়ক’ বা ‘নায়ঙ্কর’ প্রথার বৈশিষ্ট্যগুলি অনুধাবন করা যায়।
পণ্ডিত নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে লিখেছিলেন যে, ১৫৬৫ সাল পর্যন্ত নায়করা বিজয় নগর রাজার ইচ্ছার ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। পরে তাঁরা আধা-স্বাধীন হয়ে যান। ১৯৫৫ সালে তিনি বলেন যে, নায়করা মূলত ছিল সামন্ত এবং তাঁরা রাজাকে সামরিক সাহায্যদানের শর্তে ভূমির অধিকার ভোগ করতেন। কিন্তু ১৯৬৪ সালে পণ্ডিত শাস্ত্রী তাঁর পূর্ব অভিমত থেকে সরে আসেন এবং বলেন যে, বিজয়নগর একটি ‘যোদ্ধারাজ্য’ বা ‘War-state’ এবং এই সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক সংগঠন তার সামরিক প্রয়োজন অনুসারেই গড়ে উঠেছে। তাঁর মতে, বিজয়নগর সাম্রাজ্য ছিল অসংখ্য সামরিক নেতার মিলিত প্রয়াসের ফল। মহালিঙ্গম (T. V. Mahalingam)-এর বক্তব্যেও! এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন যে, বিজয়নগরের অভ্যন্তরীণ সংগঠনের প্রধান ভিত্তি ছিল ‘নায়ঙ্করা’ ব্যবস্থা। এই প্রথানুযায়ী রাজা নায়কদের হাতে ভূমিরাজাস্বের অধিকার অর্পণ করতেন। নায়করা একাধারে ছিলেন সামরিক নেতা ও স্থানীয় প্রশাসক। এ ছাড়া তাঁরা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের আদায়ীকৃত রাজস্বের একাংশেও কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা দিতেন। তামিল দেশে পনেরো শতকের শেষভাগ ও ষোলো শতকের গোড়ায় ‘নায়ষ্করা’ ব্যবস্থার ব্যাপকতা দেখা যায়। তামিল এলাকার অধিকাংশ নায়ক ছিলেন বাহিরাগত তেলেও যোদ্ধা। এই যোদ্ধারা এবং তাদের কৃষকরা তামিল সমভূমি অঞ্চলের সমৃদ্ধ অবস্থা দেখে আকৃষ্ট হয়। তামিল কৃষকরা এই এলাকাকে উর্বর করে তুলেছিল। তেলেগু যোদ্ধারা এইসব এলাকা দখল করলেও সমভূমির উত্তরদিকের তামিল নেতাদের উৎখাত করেনি এবং বহুক্ষেত্রে তাদের জমির ওপর অধিকারও মেনে নিয়েছিল।
সমকালীন স্থানীয় লেখমালা এবং বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ থেকে বিজয়নগরে দুর্গ ও দুর্গাধিপতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি পাওয়া যায়। সমকালীন তেলেগু কবিতায় দেখানো হেেয়ছে যে, বিজয়নগরের শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণদেব রায়ও দুর্গ, ব্রাহ্মণ সামরিক নেতা ও বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রশক্তি বৃদ্ধির কথা বলেছেন। চোলদের আমলে প্রচলিত ব্যবস্থারই সম্প্রসারিত ও পরিবর্তিত প্রথা হিসেবে সামরিক নেতৃত্বের কাজে ব্রাহ্মণদের উত্থান ঘটে। চোলযুগে নাত্তারের মাধ্যমে ব্রাহ্মণদের জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হত। বিজয়নগরের আমলে ব্রাহ্মণরা সম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর প্রচেষ্টা করেন। এঁদের সরাসরি দুর্গের অধ্যক্ষ (দুর্গাধিপতি) নিয়োগ করে সামরিক নেতৃত্বের অংশীদারে পরিণত করা হয়। স্থানীয় ব্রাহ্মণদের পাশাপাশি মহারাষ্ট্র অঞ্চল থেকেও বহু ব্রাহ্মণ এসে সামরিক নেতৃত্বের কাজে লিপ্ত হন।
বিজয়নগরের এই রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা সে দেশের কৃষি-সম্পর্কের ওপরেও প্রভাব ফেলে। প্রধানত, জমির ওপর নিয়ন্ত্রণের চরিত্র থেকেই সাধারণ কৃষক, রাজা ও সামরিক নায়কদের ক্ষমতার ভিত্তি ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বা কর্তৃত্বের সম্পর্ক বিকশিত হয়। ভেঙ্কটরামনাইয়া (Venkataramanaya) প্রমুখ কেউ কেউ মনে করেন যে, বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা দক্ষিণ ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতির লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। এই প্রসঙ্গে তাঁরা পূর্ব মারিয়াদে বা প্রাচীন রীতি অনুসরণ করার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। মুসলমান অগ্রগতির মুখে হিন্দুধর্মের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য দক্ষিণ ভারতে প্রাচীন রীতিনীতিকে কঠোরভাবে আঁকড়ে থাকার প্রবণতা ছিল বলে এঁরা মনে করেন। পণ্ডিত নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী এই আদর্শবাদের অস্তিস্ব স্বীকার করে নিয়েও বিজয়নগরের আমলে পরিবর্তনের দিকটি উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, চোল আমলে জনপ্রিয় ‘সভা’, ‘উর’ বা নাডু’ ইত্যাদির অস্তিত্ব বিজয়নগরের আমলে শিথিল হতে থাকে এবং কালক্রমে প্রায় বিলোপ ঘটে। পণ্ডিত কৃষ্ণস্বামীর মতে, বিজয়নগর রাষ্ট্রের সামরিক সংস্থা ও সামন্ততান্ত্রিক পদ্ধতি থেকে উদ্ভূত অবহেলার ফলে পূর্বেকার স্থানীয় সংগঠনগুলি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। এই পুরোনো প্রথাগুলির স্থান নিয়েছিল নায়ঙ্করা ও আইগার প্রথা। তাঁর মতে, বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীনে আসার পর তামিল দেশে ‘আইগার’ প্রথার আবির্ভাব ঘটে। এই প্রথার মাধ্যমে গ্রামীণ কর্মচারীদের জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হত। অধ্যাপক অনিরুদ্ধ রায়ের মতে, নাত্তার নামক গ্রামীণ কর্মচারী পদের বিলোপ এবং নায়ক পদের উত্থান একান্তই স্থানীয় পরিবর্তন হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই নতুন নেতা হিসেবে সম্পূর্ণ অচেনা ব্যক্তির উত্থানও ঘটে। এইভাবে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের আমলে প্রচলিত দক্ষিণ ভারতীয় রীতি এবং গোষ্ঠী, নেতা ও গ্রামের মধ্যে সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে। এর পরিণামে ভূমিব্যবস্থারও আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়।
নায়স্করা প্রথার উদ্ভবের সাথে সাথে বিজয়নগর রাজ্যের রাষ্ট্রনৈতিক চরিত্র এবং সামন্ততন্ত্রের সাথে এই প্রথার সামঞ্জস্যের বিষয়টি ঐতিহাসিক বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এসেছে। অধ্যাপক রায়-এর মতে, বিজয়নগরের ‘নায়ক’ প্রথাকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে একীভূত করা সঠিক নয়। কেবল সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে জমি ভোগ করার অধিকার থাকলে নায়ঙ্করা প্রথাকে সামন্ততান্ত্রিক প্রথার কাছাকাছি বলা যেত। কিন্তু বিজয়নগরের ‘নায়ক’ এমন একজন যোদ্ধা যে, রাজ্যের সামরিক ব্যবস্থার অন্যতম অঙ্গ এবং যে সবসময় তার নিজের অধিকারে একজন জমিদারস্থানীয়। পণ্ডিত নীলকণ্ঠ শাস্ত্রীও মনে করেন যে, ‘নায়ক’ ব্যবস্থা তথাকথিত ‘সামন্ততান্ত্রিক’ ব্যবস্থার সমতুল্য ছিল না; পরন্তু বিজয়নগর রাজ্য ছিল আমলাতান্ত্রিক এবং বহুলাংশে কেন্দ্রীকরণ প্রবণতাসম্পন্ন। পর্যটক নুনিজ প্রায় ২০০ জন নায়কের সন্ধান পেয়েছেন এবং তিনি এমন কোনো ইঙ্গিত দেননি যে, বিজয়নগর বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল।
বার্টন স্টাইন (Burton Stein) ‘কেম্ব্রিজ ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে (১৯৮২ খ্রিঃ) প্রকাশিত প্রবন্ধে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রিক চরিত্র ও ভূমিব্যবস্থা সম্পর্কে নতুন মূল্যায়ন করেছেন। তাঁর মতে, মধ্যযুগীয় দক্ষিণ ভারতের রাজনীতি অনুসারে বিজয়নগর রাজ্যও ছিল একাধিক অংশের সমন্বয় বা Segamentary State. বিজয়নগরকে একটি বৃহত্তর এলাকা বা Macro-region হিসেবে চিহ্নিত করলেও, বিজয়নগরের রাজা কার্যত একটি ছোট্ট এলাকা বা Micro-region-কে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। রাজ্যের অবশিষ্ট অংশের আঞ্চলিক শাসকরা (নায়ক) রাজার প্রতি আনুগত্য দেখালেও প্রায় স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করতেন। এই খণ্ডিত অংশগুলি (micro-regions) সম্মিলিতভাবে বিজয়নগরের সামগ্রিক রাজ্য (Macro-region) সৃষ্টি করেছিলেন। স্টাইনের মতে, বিজয়নগর সাম্রাজ্য বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাডু ও কর্ণাটকের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। এই সকল এলাকায় ‘পূর্ব-মরিয়াদে’বা প্রাচীন পদ্ধতি অনুসরণ করা হত। স্বভাবতই বিজয়নগরের পক্ষে রাজ্যের সর্বত্র একই ধরনের প্রশাসন বলবৎ করা সম্ভব ছিল না। স্টাইনের মতে, বিজয়নগরের শাসনব্যবস্থায় যে রূপান্তর (shift) এসেছিল, তা হল বিকেন্দ্রীকরণ প্রবণতার বিকাশ। স্থানীয় সামরিক নেতা বা নায়কেরা ছিলেন আঞ্চলিক সর্বেসর্বা। তিনি স্থানীয় রাজস্ব আদায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। নায়ক দুর্গ নির্মাণ করে নিজের ক্ষমতা ও অধিকার সুরক্ষিত রাখতেন এবং সামরিক শক্তির সংরক্ষক হিসেবে রাজাকে তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য করতেন।
নায়কদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি প্রসঙ্গে বিজয়নগরের ভূমিব্যবস্থা লক্ষণীয়। বিজয়নগরের যুগে তিন ধরনের এলাকা ছিল – ‘অমরা’, ‘ভণ্ডারভড়া’ এবং ‘মান্য’। সবথেকে ছোটো এলাকা ছিল ভণ্ডারভড়া বা সরকারি গ্রাম। এর আয়ের কিছু অংশ দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করা হত। কিছু আয় মঠ, মন্দির ইত্যাদিকে দান করা হত। মান্য ছিল নিষ্কর গ্রাম যা দেবস্থান বা ব্রাহ্মণদের দান করা হত। অবশিষ্ট সকল অঞ্চল ছিল ‘অমরা’র অন্তর্ভুক্ত। এই সকল গ্রাম বিজয়নগরের রাজারা ‘অমরা নায়ক’দের অর্পণ করেছিলেন। ফলে নায়কদের হাতে অর্থ ও শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। স্টাইনের মতে, অমরা নায়করা এইভাবে বিজয়নগর অর্থনীতির সিংহভাগ দখল করেছিলেন এবং কার্যত তাঁরাই ছিলেন রাজার সম্পদ সংগ্রহের প্রধান মাধ্যম। সামরিক ও আর্থিক ক্ষমতার অধিকারী এই সকল নায়কের কর্তৃত্ব অস্বীকার করা রাজার পক্ষে অসম্ভব ছিল। স্টাইনের মতে, নায়কদের হাতে জমির কেন্দ্রীকরণ ঘটলেও, বিজয়নগরের ব্যবস্থাকে ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের সমতুল্য বলা চলে না। বিজয়নগরের পঁচাত্তর শতাংশ জমি বিভিন্ন নায়কদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই ব্যবস্থা জাপানের সামন্ততন্ত্রের কিছুটা কাছাকাছি। তবে এক্ষেত্রেও স্পষ্ট প্রভেদ লক্ষণীয়। নায়কদের মতোই জাপানের সামন্তরা (দাইমিও) সামরিক নেতা ছিলেন ; কিন্তু তাঁদের ওপরে ও নীচে অনেকগুলি আর্থসামাজিক স্তরবিন্যাস ছিল। অন্যদিকে বিজয়নগরে নায়করা প্রত্যক্ষভাবে জমি নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং এখানে কোনো স্বীকৃত মধ্যবর্তীর অস্তিত্ব ছিল না। এই বিচারে বিজয়নগরকে একটি ‘যুদ্ধরাষ্ট্র’ (war-state) বলা সংগত, সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়।