ইতিহাস নিজেই একধরনের সাহিত্য। কিন্তু ইতিহাসের ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য সাহিত্যসূত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন গ্রীক ও রোমক সভ্যতার পুনরুদ্ধারের কাজে গ্রীক্-রোমক পণ্ডিতদের লেখা ইতিহাসমূলক রচনাবলী ভীষণভাবে সাহায্য করেছে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস যে, প্রাচীন ভারতে বিপুল সংখ্যায় এবং বিচিত্র বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক সাহিত্য রচিত হলেও, যথার্থ ইতিহাসমূলক সাহিত্যের অভাব স্পষ্ট। ইতিহাসের একক এবং নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যমালার সীমাবদ্ধতাগুলিকে নানা দিক্ক্ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়।
(১) ঘটনাবলীর উল্লেখের ক্ষেত্রে প্রায়শই সন-তারিখের উল্লেখ নেই। কালানুক্রমিক সাহিত্য রচনার চেষ্টা তখন করা হয়নি।
(২) প্রাচীন সাহিত্যকারদের অধিকাংশই ছিলেন উচ্চবর্ণের মানুষ এবং মূলতঃ ব্রাহ্মণ বর্ণভূক্ত। স্বভাবতই তাঁদের রচনায় সমাজের নিম্নবর্ণভূক্ত শ্রেণীর মানুষদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি। কঠোর বর্ণভেদভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় উচ্চবর্ণের রচনায় নিম্নবর্ণভূক্তদের ইচ্ছাকৃতভাবে অযোগ্য বা অসামাজিক রূপে তুলে ধরার প্রয়াস থাকা স্বাভাবিক।
(৩) অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য যেমন, চতুর্বেদ, মহাকাব্যদ্বয়, পুরাণ, জাতককাহিনী, স্মৃতিশাস্ত্র ইত্যাদি দীর্ঘ সময় ধরে লেখা হয়েছে কিংবা বহু পূর্বের ঘটনাবলী পরবর্তীকালের সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। ফলে রচনাকারদের দৃষ্টিভঙ্গীগত প্রভেদ সাহিত্যের বিষয়বস্তুর সংকলনে বৈচিত্র্য বা বৈপরীত্য যেমন এনেছে, তেমনি প্রক্ষিপ্তকরণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। লেখক জনশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে সাহিত্য রচনা করার ফলে প্রকৃত ঘটনার সাথে কল্পনার সংযোজন সাহিত্যের ইতিহাসমূল্য ক্ষুণ্ণ করেছে।
(৪) জীবনী সাহিত্যরচনার ক্ষেত্রে রাজকীয় গুণকীর্তনের প্রবণতা স্পষ্ট। বেশীরভাগ জীবনীসাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজন্যগণ। স্বভাবতই লেখক প্রতাপশালী পৃষ্ঠপোষকের ত্রুটি বা দুর্বলতার দিকগুলি এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে অকারণ প্রশংসা দ্বারা রাজকীয় মর্যাদা বৃদ্ধির প্রয়াস করেছেন। ফলে কল্পনার তীব্র আলোকে বাস্তব অন্ধকারে থেকে গেছে।
(৫) বিদেশীয় বিবরণগুলির ক্ষেত্রে লেখকদের ভাষা জ্ঞান এবং কৃষ্টিগত প্রভেদ তাঁদের রচনাগুলিকে ত্রুটিপূর্ণ করেছে। ভারতীয় ভাষার অজ্ঞতা এবং ভারতীয় রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠানকে পশ্চিমী কৃষ্টির প্রেক্ষিতে বিচার করার ফলে বিদেশী লেখকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকৃত সত্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অবশ্য সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজে সাহিত্যের সাহায্য গ্রহণ করতে হয়। সচেতনভাবে সঞ্চয়ন করলে সাহিত্যের অমূল্য ভাণ্ডার থেকে ইতিহাসের বহু মণিমুক্তা সংগ্রহ করা সম্ভব বলেই পণ্ডিতদের বিশ্বাস।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজে দেশীয় সাহিত্য :
দেশীয় সাহিত্যের ভাণ্ডার যথেষ্ট বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং ব্যাপক। বৈদিকযুগ (আনুমানিক ১৫০০-৬০০ খ্রিষ্টপূর্ব) সম্পর্কে জানার প্রধান সূত্র হল বৈদিক সাহিত্য। চতুর্বেদের মধ্যে ঋগ্বেদ প্রাচীনতম। কেবল আদি বৈদিক সাহিত্য নয়, ইন্দো-ইউরোপীয় সংস্কৃতির এটিই প্রাচীনতম সাহিত্য। ঋগ্বেদের রচনা আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০-৯০০ অব্দের মধ্যবর্তীকালে সম্পন্ন হয়েছে। আদি বৈদিক পর্বে (খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০-১০০০ অব্দ) ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির তথ্যাদি এই গ্রন্থে পাওয়া সম্ভব। তবে বৈদিক সাহিত্য মূলত ধর্মীয়। তাই এতে সরাসরি রাজনৈতিক পরিস্থিতির আভাস অনুপস্থিত। তবে সচেতন পাঠক ঋগ্বেদের নানা বক্তব্য থেকে সমকালীন ধর্ম-বিশ্বাস, সমাজব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্বন্ধে ধারণা পেতে পারেন। ঋগ্বেদের আর্থ-সামাজিক পরিমণ্ডলে মূলত পশুপালন এবং সামান্য কৃষিকাজ সমন্বিত সহজ-সরল গ্রাম্যজীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। অবশিষ্ট তিনটি বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ এবং অথর্ব বেদ পরবর্তীকালের রচনা। এদের পাশাপাশি ব্রাহ্মণসাহিত্য, আরণ্যক এবং উপনিষদও বৈদিক সংহিতার অংশবিশেষ এবং এগুলি সবই পরবর্তী বৈদিক যুগের (আনুমানিক ১০০০-৬০০ খ্রিষ্টপূর্ব) পরিস্থিতির আভাস দেয়। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের মূখ্য আলোচ্য বিষয় হল যাগযজ্ঞ, ধর্মীয় বিধি-বিধান, যাদুবিদ্যা, রোগমুক্তির উপায় ইত্যাদি। যাগযজ্ঞের কঠোর অনুষ্ঠানবিধির মাধ্যমে এই সময় বৈশ্যদের সাথে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের দূরত্ব বাড়ানো হয় এবং শূদ্রদের যজ্ঞের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে বর্ণব্যবস্থার কঠোরতা কার্যকরী করার ব্যবস্থা করা হয়। আবার উপনিষদের ভাষ্যে যাগযজ্ঞের অসারতা তুলে ধরে কর্মফল ও জন্মান্তরবাদের ইঙ্গিত দেওয়া হয়। অর্থাৎ সামাজিক বিশ্বাস ও সম্পর্কের রূপান্তর অনুধাবনের জন্য পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যগুলির ইঙ্গিত গুরুত্বপূর্ণ।
আর্থিক, সামাজিক এবং কিছুটা রাজনৈতিক সূত্র হিসেবে ধর্মশাস্ত্রগুলি গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মশাস্ত্রের প্রধান দুটি অংশ হল ধর্মসূত্র এবং স্মৃতিশাস্ত্র। এছাড়াও ধর্মসূত্র ও স্মৃতির ওপর লেখা বহু টীকা, নিবন্ধ ইত্যাদি ধর্মশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। ধর্মসূত্রের সময়কাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-২০০ অব্দ। এগুলি গদ্যাকারে রচিত। আপস্তম্ব, বৌধায়ন, গৌতম ধর্মসূত্র প্রাচীনতম। এগুলিতে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে। বর্ণব্যবস্থাকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে রাজার হাতে। এছাড়া বিবাহ ব্যবস্থা, স্ত্রী জাতির কর্তব্য, অন্ত্যজশ্রেণীর অবস্থান, সম্পত্তির অধিকার, শিক্ষা, কৃষি, কারিগরি শিল্প, বাণিজ্য, কারিগর-বণিক সংগঠন (শ্রেণী/সংঘ) ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ধর্মসূত্রে বিদ্যমান। গিল্ড বা শ্রেণী জাতীয় কারিগরি ও বণিক সংগঠনগুলির গঠনতন্ত্র, কার্যাবলী, মুদ্রার ব্যবহার, সুদপ্রথা ইত্যাদির জরুরী তথ্য লাভের জন্য ধর্মসূত্রের সাক্ষ্য গ্রহণ খুবই জরুরী।
খ্রিষ্টীয় শতকের গোড়ার দিকে ধর্মসূত্রের স্থান নেয় স্মৃতিশাস্ত্রসমূহ। এদের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিষ্টীয় নবম শতক, যদিও অধিকাংশ স্মৃতিগ্রন্থের মূল অংশের রচনা খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের মধ্যেই সম্পূর্ণ হয়েছিল। স্মৃতির ভাষ্য পদ্যছন্দে লেখা। মনুস্মৃতি, নারদস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, পরাশর স্মৃতি ইত্যাদি প্রধান প্রধান স্মৃতিসাহিত্যে তিনটি বিভাগে, ব্যবহার কাণ্ড, আচার কাণ্ড এবং প্রায়শ্চিত্তকাণ্ড, আলোচনাগুলিকে বিন্যস্ত করা হয়েছে। ব্যবহারকাণ্ডে স্থান পেয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক, বণিক, ব্যবসায়ী, কারিগর ইত্যাদির কর্তব্যকর্ম, সংঘ গঠন ব্যবস্থা ইত্যাদি। আচার ও প্রায়শ্চিত্ত কাণ্ডের আলোচ্যবিষয় বর্ণব্যবস্থা, বর্ণসম্পর্ক, বর্ণ ও জাতির পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ক নীতি-নির্দেশিকা বা বিধি-বিধান। মনুস্মৃতিকে এই ধরনের প্রথম রচনা মনে করা হয়। জার্মান পণ্ডিত ম্যুলার-এর মতে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মধ্যেই এর রচনা সম্পূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু ড. রামশরণ শর্মার মতে, মনুস্মৃতিতে এমন কিছু সামাজিক প্রথার আলোচনা আছে যেগুলিকে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকের আগে স্থাপন করা যায় না। এই গ্রন্থে বিবাহব্যবস্থা, স্ত্রী-ধন, বর্ণসংকর শ্রেণীর উৎপত্তি ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে। গুপ্তযুগে প্রধান প্রধান স্মৃতিগুলি হল, যেমন- নারদ, যাজ্ঞবন্ধ্য, বৃহস্পতি, কাত্যায়নস্মৃতি ইত্যাদি রচিত হয়েছে। গুপ্ত পরবর্তীকালে রচিত হয় ‘পরাশরস্মৃতি। সবগুলিতেই বর্ণব্যবস্থার কঠোরতা, ব্রাহ্মণ শ্রেণীর সামাজিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, সামাজিক অপরাধের জন্য প্রায়শ্চিত্ত ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ক আলোচনা গুরুত্ব পেয়েছে। তৎকালীন সমাজে নারীর পরিবর্তনশীল অবস্থান জানার জন্য স্মৃতিশাস্ত্রগুলির সাহায্য জরুরী।
সপ্তম শতক ও পরবর্তী এক দশককাল ধরে বহু ধর্মশাস্ত্রের ওপর টিকাভাষ্য রচিত হয়েছে। এখানে ভাষ্যকাররা প্রাচীনকালের নিয়মাবলীর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিগুলি ব্যাখ্যা করেছেন। সম্পত্তির অধিকার সংক্রান্ত আলোচনার জন্য টীকাভাষ্যগুলির অভিমত ইতিহাসের সূত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির ওপর বিজ্ঞানেশ্বর ও জীমূতবাহনের টীকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মনুস্মৃতির ওপর নবম শতকে লিখিত মেধাতিথির টীকাভাষ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম ও দ্বিতীয় শতকের মধ্যে রচিত ‘গৃহয়সূত্র’ গুলিও ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। নোভিল, বৌধায়ন, পরাশর প্রমুখের ‘গৃহয়সূত্র’ থেকে সামাজিক রীতিনীতি অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ, পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। লক্ষণীয় যে, ধর্মশাস্ত্র এবং তাদের টীকাভাষ্যে একই তথ্যের ভিন্নতর ব্যাখ্যা উঠে এসেছে। দেশ, কাল ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতেই টীকাকারদের ভিন্ন ভিন্ন মত পরিবেশিত হয়েছে। এই মতভেদের নিরিখে সামাজিক সংগঠন, রীতিনীতির পরিবর্তনগুলি অনুধাবন করে প্রাচীনকালের সামাজিক ইতিহাস পুনর্গঠন সম্ভব হয়।
ধর্মশাস্ত্রের গোষ্ঠীভূক্ত কিন্তু অনেকটা স্বতন্ত্রধারায় রচিত গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’। ধর্মশাস্ত্রে প্রাধান্য পেয়েছে সমাজ, সামাজিক বিন্যাস, বর্ণব্যবস্থা ইত্যাদি। কিন্তু অর্থশাস্ত্রের প্রধান উপজীব্য হল রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা, রাজার কর্তব্য- কর্ম এবং অর্থনীতি। ভারতীয় ট্র্যাডিশন অনুসারে মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর মন্ত্রী চাণক্য (বিষুগুপ্ত বা কৌটিল্য নামেও খ্যাত) অর্থশাস্ত্রের রচনাকার। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে এটি রচিত হয়েছিল। অন্যদিকে কেউ কেউ মনে করেন যে, কৌটিল্যের মতামতকে ভিত্তি করে পরবর্তীকালে অর্থশাস্ত্র সংকলিত হয়েছে। রচনাকালের বিতর্ক থাকলেও, নিঃসন্দেহে মৌর্যযুগে ভারতের রাজনীতি, অর্থব্যবস্থা, সমাজ ইত্যাদির নানা তথ্য অর্থশাস্ত্র থেকে পাওয়া সম্ভব। এই গ্রন্থে অর্থ বিষয়ক রীতিনীতি বিশদে আলোচিত হয়েছে। কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প, সেচব্যবস্থা, মুদ্রা ইত্যাদি অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের বিবরণ এই গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়। অর্থশাস্ত্রের ভাষ্য অনুযায়ী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সকলপ্রকার রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপের চূড়ান্ত রূপকার হলেন রাজা স্বয়ং। কর্মচারী নিয়োগ, দণ্ড দান ইত্যাদি কাজেও রাজার দায়বদ্ধতার কথা অর্থশাস্ত্রে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখিত আছে। এমনকি ধর্মশাস্ত্রের বক্তব্যের উল্টোপথে গিয়ে অর্থশাস্ত্রে বিচার ও দণ্ডদানের ক্ষেত্রে ব্রাষ্মণদের বিশেষ অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে প্রাচীন ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এই তথ্যাবলী বিশেষভাবে সহায়ক হয়।
প্রাচীন ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির আধার হিসেবে দুটি সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারত ও রামায়ণ বিশেষ মর্যাদা পায়। মহাকাব্য দুটি মূলত ক্ষত্রিয় বীরগাথা। অনেকের মতে, চারণকবিদের গানে ও সুরে এই বীরগাথা দীর্ঘকাল ধরে প্রচারিত হয়েছে। তাই অনেকে ব্যাসদেব ও বাল্মীকিকে যথাক্রমে মহাভারত ও রামায়ণের প্রণেতা হিসেবে গ্রহণ না করে সংকলক বলেই মনে করেন। মহাভারতে শ্লোকের সংখ্যা প্রথমে ছিল ৮৮০০টি। গুপ্তযুগের সূচনাকালে শ্লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে এক লক্ষ হয়ে যায়। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টীয় ৪০০ অব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ দীর্ঘ আটশতক ধরে এর শ্লোকগুলি সংকলিত হয়েছে। ফলে বিশুদ্ধ বীরগাথার চরিত্র পরিহার করে এখানে সমকালীন সমাজ, ধর্ম ইত্যাদি নানা বিষয় স্থান করে নিয়েছে। মহাভারতের মূল উপজীব্য কুরু-পাণ্ডবের বিরোধ ও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সময়কাল আনুমানিক ১০০০ অব্দ ধরা হয়। ফলে বৈদিকযুগের পরবর্তী পর্বের সামাজিক প্রথাগুলির আভাস এখানে পাওয়া সম্ভব। মহাভারতের ‘শান্তিপর্বে রাজতন্ত্রবিষয়ক উপদেশ, কর ধার্য ব্যবস্থা, বর্ণ-জাতির আলোচনা ইত্যাদি আছে, যা ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। রামায়ণের রচনা পরে শুরু হয়ে আগে সমাপ্ত হয়েছে। এর রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টীয় ২০০ অব্দ পর্যন্ত প্রসারিত। রামায়ণের মুখ্য চরিত্র রাজা রামচন্দ্র। মহাভারতের মত এর বিষয়বস্তু বিচিত্র নয়। ড. শর্মার মতে, প্রাচীন ভারতের পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার চিত্র এই মহাকাব্য থেকে জানা যায়, রামায়ণ থেকে প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারী ও শূদ্রের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
মহাকাব্যদ্বয়ের পাশাপাশি প্রাচীন ভারতের তথ্যসূত্র হিসেবে পুরাণসমূহের নাম উচ্চারিত হয়। পুরাণের বক্তব্যের ঐতিহাসিকতা পশ্চিমী ঐতিহাসিকেরা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছেন। ভারতীয় ঐতিহাসিকেরাও পুরাণের তথ্য সম্পর্কে নিঃশংসয় নয়। সাম্প্রতিক ইতিহাসচর্চায় সাবধানতার সাথে পুরাণের বক্তব্যকে ইতিহাসের সূত্র হিসেবে গ্রহণ করার স্বপক্ষে মত দেওয়া হচ্ছে। সামাজিক ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে পুরাণকে গ্রহণ করা যেতে পারে। পুরাণের রচনাকাল সম্পর্কে মতভেদ আছে। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে প্রধান প্রধান পুরাণগুলি, যেমন—বিষ্ণুপুরাণ, বায়ুপুরাণ, ভাগবত্ পুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ, মৎস্যপুরাণ ইত্যাদি, গুপ্ত শাসনকালে চতুর্থ-পঞ্চম শতকে রচিত বা সংকলিত হয়েছিল। আবার কিছু পুরাণ, যেমন— বৃহদ্ধর্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ইত্যাদি, পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক পর্যন্ত রচিত হয়েছে। আবার পুরাণের মূল বিষয়বস্তুর সাথে সংযোজন বা প্রক্ষিপ্তকরণ প্রক্রিয়া পরবর্তী তিন বা চার শতকব্যাপী অব্যাহত ছিল। পুরাণে বর্ণিত বংশানুচরিত থেকে প্রাচীন রাজবংশগুলির ধারণা পাওয়া যায়। সাতবাহন বংশের রাজনৈতিক ইতিহাস পুনরুদ্ধারের জন্য পুরাণের সাহায্য গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য লেখমালা বা অন্য কোন তথ্য দ্বারা সেগুলিকে যাচাই করে নেওয়া আবশ্যিক। ভারতের ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের বহু তথ্য পুরাণ গ্রন্থে পাওয়া যায়। তবে হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী মনে করেন যে, পুরাণে ভারত উপমহাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বর্ণনায় রচনাকারের কল্পনা বহু ক্ষেত্রে বাস্তবকে আড়াল করেছে। তাই তথ্য সংগ্রহে সাবধানতা অবলম্বন জরুরী। আদি-মধ্যকালীন ভারতের ধর্মভাবনার গতি-প্রকৃতি নির্ধারণের কাজেও পুরাণের কাহিনী সহায়ক হয়। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে পঞ্চোপাসনার বিকাশ সম্পর্কে পুরাণের তথ্য গুরুত্বপূর্ণ।
বৌদ্ধ ও জৈনসাহিত্যগুলিও স্বাধীন ভারত ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। বৈদিক সাহিত্যের তুলনায় বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে পার্থিব বিষয়ের ওপর বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বৌদ্ধ সাহিত্যে সমাজ-সচেতনতা স্পষ্ট। উল্লেখ্য যে-কোন বৌদ্ধ গ্রন্থই বুদ্ধের সমসাময়িক নয়, জৈন গ্রন্থগুলি আরও পরে রচিত। কিন্তু পরবর্তীকালের রচনা হলেও, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ শতকের পরিস্থিতি এগুলিতে স্থান পেয়েছে। বৌদ্ধগ্রন্থ ‘অঙ্গুত্তরনিকায়’ ও ‘জৈন ভগবতী সূত্র থেকে আমরা খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের রাজনৈতিক চিত্র এবং ষোড়শ মহাজনপদের অস্তিত্ব জানতে পারি। এদের বক্তব্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও মহাজনদের সংখ্যা, রাজনৈতিক প্রকৃতি এবং পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থের সাক্ষ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘দীর্ঘনিকায়’ এবং ‘অঙ্গুত্তরনিকায়’ গ্রন্থে মগধের রাজনৈতিক উত্থানের বিশ্বস্ত বিবরণ পাওয়া যায়। ভদ্রবাহু রচিত ‘জৈনকল্পসূত্র থেকে জৈনধর্মের প্রাথমিক পর্যায়ের নানা উপাদান পাওয়া যায়। কল্পসূত্র, ভগবতীসূত্র ইত্যাদি। জৈনগ্রন্থ থেকে প্রাচীন বর্ণব্যবস্থা, নগরের বিকাশ ও অর্থনৈতিক কার্যাবলী, গ্রামীণ জনবসতি, সমুদ্র বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। জৈন সাহিত্যের ভিত্তিতে জগদীশচন্দ্র জৈন রচিত গ্রন্থ থেকে তৎকালীন জনজীবনের আভাস পাওয়া যায়। প্রধানত ধর্মগ্রন্থ হলেও ‘জাতকের কাহিনী’ বা জৈন ‘আচারসূত্র’ থেকে লোকজীবনের ছবি আহরণ করা সম্ভব।
প্রাচীন ভারতে সংস্কৃত ভাষায় ব্যাকরণ, জ্যোতিষশাস্ত্র এমন কিছু সাহিত্য রচিত হয়েছে, যা থেকে আদি পর্বে ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সম্ভব। এমনই উল্লেখযোগ্য দু’টি গ্রন্থ হল পাণিনি রচিত ‘অষ্টাধ্যয়ী’ নামক ব্যাকরণ এবং তার ওপর লেখা পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’ নামক টীকাসমগ্র। গ্রন্থ দুটি যথাক্রমে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম এবং দ্বিতীয় শতকে প্রণীত হয়েছিল। পাণিনির গ্রন্থ থেকে উত্তর ভারতের ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কেও জানা যায়। অন্যদিকে পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’ থেকে মোর্য্যোত্তর যুগের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব। সমাজ সচেতন লেখক পতঞ্জলি ব্যাকট্রীয় গ্রীকদের ভারত আক্রমণের সংবাদ যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করেছেন।
জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থগুলি আদি কালে ভারতের বিজ্ঞানচেতনার পাশাপাশি আর্থিক অবস্থা সম্পর্কেও আভাস দেয়। আর্যভট্টের ‘আর্যভটীয়’ কিংবা ব্রহ্মগুপ্তের ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’ মহাকাশ সম্পর্কে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সচেতনার প্রমাণ দেয়। জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল বরাহমিহিরের ‘বৃহৎসংহিতা’। এই গ্রন্থ থেকে উত্তর ভারতের কৃষিসংক্রান্ত নানা তথ্য সংগ্রহ করা যায়। কৃষিবিষয়ক বহু তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায় ‘কৃষিপরাশর’ এবং ‘কাশ্যপ কৃষিসুক্তি’ গ্রন্থ দু’টি থেকে। প্রথমটি আনুমানিক একাদশ শতকের রচনা এবং দ্বিতীয়টি আরো পরবর্তীকালের। তবে গ্রন্থ দু’টি থেকে মূলতঃ উত্তরভারতের বিভিন্ন কৃষিজ উৎপাদন ও প্রযুক্তির সূত্র পাওয়া যায়। এমনকি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস সম্পর্কেও ‘কৃষিপরাশর’ গ্রন্থে আলোচনা আছে। ‘বৃক্ষায়ুর্বেদ’ নামক গ্রন্থ থেকে বৃক্ষবিদ্যা সম্পর্কিত প্রাচীন ধ্যান-ধারণার আভাস পাওয়া যায়। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে অমরসিংহ রচিত ‘নামলিঙ্গানুশাসন’ বা ‘অমরকোষ গ্রন্থ থেকেও ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করা যায়। নানা শব্দ ও প্রতিশব্দ সম্বলিত এই গ্রন্থের আলোচনা থেকে তৎকালীন সমাজ ও অর্থনীতির ধারণা পাওয়া যায়। পরবর্তী গুপ্তযুগে রচিত বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ গ্রন্থে নগরজীবনের বৈচিত্র্য ও জটিলতা আলোচিত হয়েছে। শহরাঞ্চলে ধনীব্যক্তিদের অলস ও বিলাসী জীবন এবং গ্রামীণ মানুষের কায়িক শ্রমনির্ভরতার বিশ্বস্ত বর্ণনা কামসূত্রে পাওয়া যায়। স্থাপত্যবিদ্যা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ হল রাজা সোমেশ্বর প্রণীত ‘মানসোল্লাস’। এতে গৃহসুবিধাযুক্ত বৃহদাকার গৃহ নির্মাণের উল্লেখ আছে।
ষষ্ঠ শতকের পরবর্তীকালে রচিত এমন কিছু জীবনীগ্রন্থ পাওয়া যায়, যেগুলি ইতিহাসের সূত্র হিসেবে সহায়ক। গুপ্ত ও গুপ্ত পরবর্তীযুগের ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এগুলি গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে পথিকৃৎ হিসেবে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে লেখা অশ্ব ঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ গ্রন্থের কথা মনে আসে। তবে এই কাব্যটিতে লোককাহিনীর উপস্থাপনা প্রাধান্য পেয়েছে। তাই বুদ্ধের প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ হিসেবে এর কাহিনী বিশ্বাসযোগ্য নয়। এমনই একটি জীবনীগ্রন্থ বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’। এর মূল অংশটি গদ্যে রচিত। কিছু অংশে কাব্যিক উপস্থাপনা আছে। এখানে হর্ষবর্ধনের বংশচরিত এবং শাসক হিসেবে হর্ষবর্ধনের কৃতিত্ব তুলে ধরা হয়েছে। তবে ‘হর্ষচরিত’ নিরপেক্ষ রচনা নয় বলেই অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং ধর্মীয় আনুগত্যের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে বাণভট্ট এই গ্রন্থে ঐতিহাসিকের নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গী অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কাশ্মিরী পণ্ডিত বিল্হন একাদশ শতকে রচনা করেন ‘বিক্রমাঙ্কদেব চরিত’। চালুক্যরাজ ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যর সভাকবি বিল্হন এই গ্রন্থে তাঁর পৃষ্ঠপোষকের গুণকীর্তন করেছেন। কিন্তু কবির বহু বর্ণনা বাস্তবসম্মত নয়। বাক্পতিরাজ তাঁর ‘গৌড়বহ’ কাব্যে কনৌজ রাজ যশোবর্মণের গৌরবগাথা তুলে ধরেছেন। তবে উপস্থাপন পদ্ধতি এতটাই যান্ত্রিক যে তাদের ঐতিহাসিকতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। জীবনীকাব্যের মধ্যে ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ সন্ধ্যাকর নন্দী’র ‘রামচরিত’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। কৈবর্ত বিদ্রোহের বহু তথ্য এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। তবে এর ঐতিহাসিক মূল্য সম্পর্কেও সংশয় আছে। এখানে কবি তাঁর পৃষ্ঠপোষক তথা পালবংশীয় রাজা রামপালের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত লেখক তাঁর বক্তব্যে নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে পারেন নি। তবে গ্রন্থটি দ্ব্যর্থবোধক। এক অর্থে এটি রাজা রামপালের কাহিনী, অন্য অর্থে এটি অযোধ্যাপতি রামচন্দ্রের কাহিনী বলে গ্রহণ করা চলে। বিশিষ্ট জৈন আচার্য জয়সিংহ পালি ভাষায় রচনা করেন ‘কুমারপাল চরিত। চালুক্যরাজ কুমারপালের এই জীবনী গ্রন্থেও অতিরঞ্জন স্পষ্ট। এমনই আর একটি রচনা হল পদ্মগুপ্ত বিরচিত ‘নবশশাঙ্কচরিত’। একাদশ শতকে প্রণীত এই গ্রন্থে গুর্জরবংশীয় সিন্ধুরাজের, যাঁর পরিচিতি নবশশাঙ্ক নামে, জীবনী বর্ণিত হয়েছে। বলাবাহুল্য এই সকল জীবনীগ্রন্থের বিষয়বস্তুর অনেকটাই অতিরঞ্জিত, আলংকারিক এবং পৃষ্ঠপোষকের প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ মাত্র। তাই এখান থেকে তথ্য গ্রহণে বিশেষ সতর্কতা আবশ্যিক।
প্রাচীন ভারতবর্ষে বিপুল লিখিত সাহিত্যসম্ভারের মধ্যে যথার্থ ইতিহাসের মর্যাদা দেওয়া হয় কলহন বিরচিত ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থটিকে। এটি দ্বাদশ শতকে রচিত হয়। এখানে লেখক প্রাচীনকাল থেকে তাঁর সময়কাল পর্যন্ত কাশ্মীর রাজ্যের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস লেখার চেষ্টা করেছেন। প্রাক্-সপ্তম শতকের ক্ষেত্রে তিনি মূলতঃ কল্পকাহিনীর ওপর নির্ভর করেছেন। তবে অষ্টম শতক ও তার পরবর্তীকালের ইতিহাস রচনার কাজে তিনি যথেষ্ট তথ্যানুসন্ধান করে অগ্রসর হয়েছেন। কাশ্মীরের রাজবংশ ও শাসকদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি যে, ব্যক্তিগত অনুরাগ বা বিদ্বেষ বর্জন করেছেন (রাগদ্বেষ বিবর্জিতম) তা ইতিহাসমহলে স্বীকৃত। তথাকথিত জীবনীগ্রন্থের সহজাত সীমাবদ্ধতা থেকে রাজতরঙ্গিনী অনেকাংশে মুক্ত।
গুজরাটের চালুক্য রাজাদের প্রশংসা করে সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় কিছু গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। রাজা এবং রাজবংশ ছাড়াও রাজমন্ত্রী তেজঃপাল ও বাস্তুপালের জীবনীও লেখা হয়েছিল। মন্ত্রীদের জীবনচরিতে প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। গুজরাটের বিদগ্ধ জৈন পণ্ডিত হেমচন্দ্র লিখিত ‘দ্রব্যশাস্ত্র’ মহাকাব্যে চালুক্য রাজাদের ইতিহাস ও ব্যাকরণ লেখার সমান্তরাল প্রয়াস দেখা যায়।
প্রাচীন ভারতবর্ষে বহু সৃজনশীল কাব্য, নাটক, আখ্যান ইত্যাদি রচিত হয়েছে। এগুলি থেকেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের পুনর্গঠন করা সম্ভব। মৌযোত্তর যুগের বিখ্যাত নাট্যকার ভাস-এর রচনা থেকে সমকালীন সমাজের চিত্র পাওয়া যায়। গুপ্তযুগের মহাকবি কালিদাস তাঁর কাব্য-নাটকে সমকালীন সমাজব্যবস্থার ছবি তুলে ধরেছেন। তাঁর বিখ্যাত রচনাবলীর অন্যতম মেঘদূত, রঘুবংশ, অভিজ্ঞান শকুন্তলা ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে অধ্যাপক ভগবতশরণ উপাধ্যায় গুপ্তযুগের সমকালে ভারতীয়দের সামাজিক জীবনধারা, আর্থিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল বিষয়ক বহু তথ্য আহরণ করেছেন, যা ইতিহাস পুনর্গঠনের সহায়ক হতে পারে। একইভাবে শুদ্রকরচিত ‘মৃচ্ছকটিক’, বিশাখদত্ত’র ‘মুদ্রারাক্ষস’, দণ্ডিনের ‘দশকুমার চরিত’, ভারবির ‘কিরাতাৰ্জ্জুনীয়ম্’ গুরুত্বপূর্ণ। মৃচ্ছকটিক ও মুদ্রারাক্ষস নাটক থেকে গুপ্তকালীন উত্তর ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান জানা যায়। ‘দশকুমারচরিত’ দক্ষিণভারত ও দাক্ষিণাত্যের সামাজিক অবস্থার আভাস দেয়।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজে বিদেশীয় সাহিত্য :
দেশীয় সাহিত্যের তুলনায় বিদেশীয় ভারত সম্পর্কিত রচনাগুলি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনে অধিক উপযোগী। এই জাতীয় অধিকাংশ রচনাকার ভারত ভ্রমণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন; কিংবা দ্বিতীয় কোন সূত্র থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মতামত ব্যক্ত করেছেন। বিদেশীয় রচনাগুলির সঠিককাল নির্ণয় সম্ভব হওয়ায় সেগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বেশী। ভারতে না-এসেও ভারত সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা হল গ্রীক্ ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের ‘ইস্তোরিয়া’ (হিস্ট্রি)। তাঁর রচনা থেকে জানা যায় যে, ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পারসিকদের শাসনাধীন ছিল এবং গ্রীকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহু ভারতীয় পারসিক সম্রাটের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের আর এক গ্রীক লেখক টিসিয়াস ভারত সম্পর্কে একটি বিবরণ দিয়েছেন। তবে তাঁর বিবরণীতে বহু বিচিত্র এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য ঘটনা স্থান পেয়েছে।