নব্যপ্রস্তরযুগে মেহেরগড় সংস্কৃতি:
ভারতে নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির ক্ষেত্রগুলি থেকে প্রাপ্ত উপাদান বিশ্লেষণ করে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান যে, এই পর্যায়ে এক মিশ্রসংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। উন্নত, সূক্ষ্ম, মসৃণ পাথরের হাতিয়ার ত ছিলই, সেইসঙ্গে শুরু হয়েছিল ধাতুর ব্যবহার। নব্যাশ্মীয় যুগের পরিণত পর্যায়ে মানুষ সর্বপ্রথম তামার ব্যবহার রপ্ত করে। অবশ্য পাথরের হাতিয়ার উন্নতকরণের প্রক্রিয়াও অব্যাহত ছিল। এ কারণে প্রত্নতাত্ত্বিকরা নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির চূড়ান্ত পর্যায়ে পাথর ও ধাতুর এক মিশ্র সংস্কৃতির অস্তিত্ব লক্ষ্য করেছেন, তাই অব্যবহিত প্রাক্-হরপ্পা পর্বে ভারতে ‘তাম্র-প্রস্তর সংস্কৃতির’ আবির্ভাব ঘটেছিল বলে মনে করা হয়। ভারত উপমহাদেশে কৃষির উন্মেষ, বিকাশ ও ব্যাপ্তির ধারা এলাকা বা সময়কালের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ আলাদা করে নির্দিষ্ট করার কাজ কঠিন এবং সম্ভবত অযৌক্তিকও। একটি ধারার সাথে আর একটি ধারার মিশে যাওয়ার মুহূর্ত, গভীরতা বা সময়কাল যথেষ্ট পরিষ্কার নয়। মোটামুটিভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে কৃষির উন্মেষ ও গ্রাম-সমাজ গড়ে ওঠার বৃত্তটি বালুচিস্তান থেকে একদিকে হরিয়ানা ও অন্যদিকে গুজরাট পর্যন্ত বিস্তৃত।
নব্যপ্রস্তরযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে কৃষি-জীবন সূচনার অতি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীন ক্ষেত্রটি হল মেহেরগড়। পাকিস্তানের অন্তর্গত বালুচিস্তানের বিখ্যাত বোলান গিরিপথের সন্নিকটে এবং ভৌগোলিকভাবে সিন্ধু অববাহিকার অন্তর্গত কাচ্চি সমভূমিতে মেহেরগড়ের অবস্থান। ফরাসী প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্রাঁসোয়া জারিজ ১৯৮০-এর দশকে এই প্রত্নক্ষেত্র উৎখননে কৃতিত্ব দেখান। প্রায় ১৫০ কিলোমিটার বিস্মৃত প্রত্নক্ষেত্রটির সাতটি পর্যায় সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। প্রথম তিনটি পর্যায় নব্যপ্রস্তরযুগের অন্তর্ভূক্ত। পরবর্তী পর্যায়গুলিতে তাম্র-প্রস্তর সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া যায়। মেহেরগড় বসতির প্রথম পর্যায়ের ফলে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০-৫০০০ অব্দ। ইতিপূর্বে সম্ভবত বোলান নদীর উঁচুপারে একদল ভ্রাম্যমান পশুচারণকারীর আস্তানা ছিল। ক্রমে ঐ এলাকায় স্থায়ী বসতি গড়ে ওঠে। এখানে রোদে শুকানো মাটির ইটের তৈরী ঘরবাড়ি এবং ব্যবহৃত জিনিসের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। বাড়িগুলি একাধিক কক্ষে বিভক্ত ছিল। আগুন রাখার নির্দিষ্ট স্থান ছিল। কিছু বৃহদাকার কক্ষ দেখা যায়। সম্ভবত এগুলি শয্যাগার হিসেবে ব্যবহৃত হত। খুঁজে পাওয়া শস্যদানা থেকে চাষবাসের অস্তিত্ব বোঝা যায়। বুনো যবের পাশাপাশি এই পর্বে মানুষ যব চাষ শুরু করেছিল। কয়েক ধরনের গমও চাষ হত, তবে বুনোগমের অস্তিত্ব দেখা যায়নি। কৃষির প্রয়োজনে সম্ভবত বুনো পশুকে পোষ মানিয়ে গৃহপালিত করার প্রয়াস শুরু হয়েছিল। গৃহপালিত জন্তুর মধ্যে ছিল ছাগল, ভেড়া এবং কুঁজবিশিষ্ট গোরু। মহিষের হাড়ও পাওয়া গেছে। তবে সেগুলি গৃহপালিত কিনা সন্দেহ আছে। সম্ভবত কুকুরও পোষ মানানো অবস্থায় এসেছিল।
প্রথম পর্যায়ের শেষদিকে কিছু মৃৎপাত্রের টুকরো পাওয়া যায়। তবে এই পর্যায়ে মৃৎপাত্রের ব্যবহার যে ছিল না, তা প্রমাণিত। অর্থাৎ এটি ছিল অ-মৃৎশিল্পকাল বা প্রাক্-মৃৎশিল্প পর্ব। শান দেওয়া পাথরের হাতিয়ার পাওয়া গেছে। এছাড়া আছে জাঁতা, হামানদিস্তা, পেশাই করার বড় পাথর ইত্যাদি এবং কিছু হাড়ের হাতিয়ার। প্রথম পর্যায়ে প্রাপ্ত কবরগুলি থেকে নানারকমের পুঁতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল একটি তামার পুঁতি। সম্ভবত এই তামা, লাপিস লাজুলি ও টার্কোয়েম পাথর ইরান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে আনা হত, যা খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ সহস্রাব্দে ভারতে দূরপাল্লার বাণিজ্যের অস্তিত্ব নিদর্শন করে।
মেহেরগড় সভ্যতার দ্বিতীয় পর্যায় (আনুঃ খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০-৪০০০ অব্দ) সরাসরি প্রথম পর্যায় থেকে উদ্ভুত। কারণ বহু গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন সত্ত্বেও ধারাবাহিকতার নানা প্রমাণ পাওয়া যায়। বাড়িঘর মোটামুটি একইরকম ছিল। গৃহপালিত পশুর তালিকাতেও বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। অবশ্য রোদে শুকানো মাটির ইটে তৈরী বাড়িগুলির কয়েকটির আয়তনের বিশালতা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সম্ভবত এগুলি শস্যাগার ছিল। এটি কৃষি উৎপাদনে উন্নতি এবং উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সম্ভাবনাটিকে জোরালো করে। তবে মেহেরগড় দ্বিতীয় পর্যায়ের দুটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হল (১) কার্পাস চাষ এবং (২) কুমোরের চাকের উদ্ভাবন। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রচুর কার্পাসের বীজ পোড়া অবস্থায় পাওয়া গেছে। এটিই কার্পাস চাষের প্রাচীনতম নিদর্শন। কাপড় তৈরী বা তৈল নিষ্কাসনের জন্য কার্পাস চাষ করা হত। এইসময় ছোট ছোট বাঁধ দিয়ে জল ধরে বরখা এবং তাকে চাষের কাজে লাগানোর শিক্ষা মানুষের করায়ত্ব হয়েছিল। নানারকমের গম, বার্লি, কার্পাস ইত্যাদি উৎপাদনে এই জল সেচ ব্যবস্থা সহায়ক হয়েছিল। ভারত-উপমহাদেশে কাস্তে তৈরীর প্রাচীনতম নিদর্শন এই পর্যায়ে পাওয়া যায়। বিটুমেনের সাহায্যে পাথরের ছোট ‘ব্লেড’ ত্যারছাভাবে একটা হাতলের সাথে লাগানো প্রত্নখণ্ডটিকে প্রাচীনতম কাস্তের নিদর্শন বলে মনে করা হয়। মেহেরগড়ের দ্বিতীয় পর্যায়ে মৃৎপাত্র নির্মাণ সূচিত হয়। রঙ্গীন, বার্নিশ করা নানারকমের মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথমদিকেও কুমোরের চাকার ব্যবহার ছিল না। বিটুমেনের ওপর কাদা-মাটির প্রলেপ দেওয়া কিছু ঝুড়ি পাওয়া গেছে। এগুলি মৃৎপাত্রের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হত। এই পর্বের শেষদিকে (আনুমানিক খ্রিঃ পূঃ ৪০০০ অব্দ) চাকা ঘুরিয়ে মৃৎপাত্র নির্মাণের প্রযুক্তির প্রচলন ঘটে। ইতিমধ্যে পশ্চিম এশিয়ায় কুমোরের চাকার প্রচলন ঘটেছিল। সম্ভবত সেখান থেকে এই প্রযুক্তি ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছিল। অলংকারশিল্পেও উন্নতি ঘটেছিল। পাথর, ঝিনুকের পুঁতির পাশাপাশি তামার পুঁতি পাওয়া গেছে। সম্ভবত এই পর্যায়ে পুঁতি গলানোর কাজ শুরু হয়েছিল।
মেহেরগড়ের তৃতীয় পর্যায় আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০০ থেকে ৩৮০০ খ্রিস্টাব্দে নির্দিষ্ট করা হয়। এই পর্বে কৃষি উৎপাদনে বৈচিত্র্য এবং কারিগরি শিল্পে অগ্রগতির বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। যবের পাশাপাশি অন্তত চারপ্রকার গম চাষ করা হত। কুমোরের চাকা ব্যবহার করে মৃৎপাত্র তৈরীতেও বৈচিত্র্য দেখা যায়। চাকে বানানো পাত্রে হলুদ আর লাল রং দিয়ে গাত্র অলংকরণ এবং কালো জ্যামিতিক নক্শা দ্বারা সেগুলিকে আকর্ষণীয় করার প্রয়াস দেখা যায়। রং করার আগে পাত্রগুলিকে আগুনে পুড়িয়ে নেওয়ার ফলে সেগুলির ব্যবহারযোগ্যতা বেড়েছিল। এইভাবে গম উৎপাদন, বহুল ব্যবহার এবং অলংকরণ মৃৎপাত্র শিল্পকে তৃতীয় পর্যায়ে নতুন মাত্র দিয়েছিল। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নতির ছাপও স্পষ্ট। এই পর্বে চৌদ্দটিরও বেশী পোড়ানো মাটির মুচিতে পড়ে থাকা তামার অবশেষ থেকে বোঝা যায় যে তামা গলানোর কাজে সেকালের মানুষ অনেকটাই রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এই পর্যায়ে হস্তশিল্পের বৈচিত্র্য ও বিকাশের প্রেক্ষিতে ইরফান হাবিব মনে করেন যে, সমাজে শ্রেণী বিভাজনের সূচনা তখনই হয়েছিল এবং উৎপাদিত পণ্য বিনিময় প্রথায় বিক্রি করে জীবনযাপন করত।
মেহেরগড়ের চতুর্থ থেকে সপ্তম পর্যায়ে বিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট। জনবসতি এখন আর বিক্ষিপ্ত নয়। মেহেরগড়ের দক্ষিণদিকে ঘনবসতির প্রমাণ পাওয়া যায়। চতুর্থ পর্যায়ের সময়কাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এই সময়ের বৈশিষ্ট্য হল মৃৎপাত্রে দ্বিমাত্রিক ও বহুমাত্রিক রং-এর ব্যবহার, বৃহদাকার মাটির পাত্র। সম্ভবত শয্য মজুত রাখার জন্য নির্মিত হয়েছিল। বিশেষ আকর্ষণের বস্তু হল পোড়ামাটির একটি স্ত্রীমূর্তি। এর সঙ্গে মধ্যএশিয়ায় প্রাপ্ত স্ত্রীমূর্তির সাদৃশ্য লক্ষণীয়। পরবর্তী তিনটি পর্যায়ের সময়কাল আনুমানিক চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি বা শেষ ভাগ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের পর পর্যন্ত। এই পর্বে সিলমোহরের প্রচলন দেখা যায়, যা ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপকতা এবং প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব নির্দেশ করে। সপ্তম পর্যায়ে বৃহদাকার স্থাপত্য ও ধূসর রঙের মৃৎপাত্রের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।