খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে গোষ্ঠী আধিপত্য বা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনধারার পরিবর্তে রাজ্য ও গণরাজ্য স্থাপনার কাজ শুরু হয়। আঞ্চলিক রাজ্য প্রতিষ্ঠার এই অভিযান চতুর্থ শতকের শেষ নাগাদ একটা পরিণত রূপ পায়। এই সময় মৌর্য বংশের নেতৃত্বে সাম্রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়া একটা স্পষ্ট আকার নেয়। রাজ্য স্থাপন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি আরো দু’টি যুগান্তকারী ঘটনা ভারতের অভ্যন্তরীণ রূপান্তরের সাথে এই পূর্বে যুক্ত ছিল। এগুলি হল— হরপ্পার নগর সভ্যতা বিলোপের প্রায় পাঁচশো বছর পর নতুন নগরের উত্থান এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সমান্তরালে বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি প্রতিবাদী ধর্মমতের উত্থান ও বিকাশ।
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতীয় রাজনৈতিক জীবনের কেন্দ্রে ছিল ষোলটি মহাজন পদ। ‘জনপদ’ বলতে বোঝায় যেখানে জনগণের পদ (পা) অর্থাৎ অবস্থান ঘটেছে। তাই ‘মহাজনপদ’ শব্দটির ব্যবহার থেকে অনুমিত হয় যে, জনতার অবস্থান বিশিষ্ট এই অঞ্চলগুলি এককভাবে সাধারণ জনপদের থেকে আয়তনে বড় ছিল। এই জনবসতি অধ্যুষিত অঞ্চলটি নিশ্চয় কোনো নেতার (রাজন) নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হত এবং আর্থিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রাজন-নিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনধারা অনুসৃত হত।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের রাজনৈতিক অবস্থা জানার জন্য হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী বৌদ্ধগ্রন্ধ ‘অঙ্গুত্তর নিকায়’ এবং জৈনগ্রন্থ ‘জৈনভগবতীসূত্রের’র ওপর বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। পুরাণ গ্রন্থের সাহায্যও নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এখানে প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যগুলির উল্লেখ না থাকায় পুরাণের বিবরণ সার্বিক নয়। ‘অঙ্গুত্তর নিকায়’ গ্রন্থের পাশাপাশি ‘মহাবস্তু’ গ্রন্থ থেকেও কিছু উপাদান পাওয়া সম্ভব। বৌদ্ধ ও জৈন উভয় গ্রন্থেই খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতে ষোলটি মহাজনপদ এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সময়ে ভারতে কেন্দ্রীভূত রাজতন্ত্র বা ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ষোলটি ছোট ছোট রাষ্ট্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিল। এদের বলা হয়েছে ‘ষোড়শ মহাজনপদ। মগধ-এর নেতৃত্বে বৃহৎ সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার পূর্ব পর্যন্ত সময়কে তাই ‘ষোড়শ’ মহাজনপদের যুগ’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়। তবে বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থে ষোলটি মহাজনপদের উল্লেখ থাকলেও নামের মধ্যে কিছু প্রভেদ আছে। ‘অঙ্গুত্তর নিকায়’-তে যে ষোলটি মহাজনপদের উল্লেখ আছে, সেগুলি হল – কাশী, কোশল, অঙ্গ, মগধ, বজ্জি বা বৃদ্ধি, মগ্ন, চেদি, বৎস, কুরু, পাঞ্চাল, মৎস, শূরসেন, অস্মক, অবন্তী, গান্ধার, কম্বোজ। মহাবস্তুতে সিবি ও দশার্ণ নামে দুটি মহাজনপদের উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু সেখানে গান্ধার ও কম্বোজের নাম অনুপস্থিত। আবার ভগবতীসূত্রেও ষোলটি মহাজনপদের নামের উল্লেখ রয়েছে কিন্তু ছয়টি মহাজনপদ ছাড়া অন্যান্য নামগুলির সাথে ‘অঙ্গুত্তর নিকায়ে উল্লেখিত নামগুলির মিল নেই। যে ছয়টি নাম উভয় গ্রন্থেই পাওয়া যায় সেগুলি হল অঙ্গ, মগধ, বৎস, বজ্জি, কাশী ও কোশল। বিভিন্ন গ্রন্থে প্রাপ্ত ষোড়শ মহাজনপদের নামগুলির মধ্যে সাদৃশ্য থাক না থাক, আলোচ্য সময়ে ভারতবর্ষ একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল, এতে কোনই সন্দেহের অবকাশ নেই।
মহাজনপদগুলির মধ্যে, অন্তত প্রথমদিকে কাশী অধিক শক্তিশালী ছিল বলে মনে করা হয়। বরুণা ও অসি নদীর মধ্যস্থলে রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। জাতক গ্রন্থগুলি অনুযায়ী কাশীর আয়তন ছিল তিনশো লীগ। এর রাজধানী বারাণসী সমসাময়িক অন্যান্য রাজ্যের রাজধানী অপেক্ষা সমৃদ্ধশালী ছিল। বিনয় পিটকে কাশীকে একটি মহান ও সমৃদ্ধ রাজ্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কাশীর রাজারা সমগ্র ভারতে আধিপত্য বিস্তারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন, ভদ্দসাল ও ধোনশাখ জাতক থেকে তা জানা যায়। কাশীরাজ মনোজ কর্তৃক কোশল, অঙ্গ ও মগধ জয়ের বিবরণ পাওয়া যায় জাতক থেকে। মনোজ ছাড়াও কাশীর অন্য কয়েকজন রাজা পার্শ্ববর্তী কোশল রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। কাশীর এরূপ ক্ষমতাবৃদ্ধিতে পার্শ্ববর্তী রাজাগণ ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। এমনকি সাতজন রাজা একযোগে রাজধানী বারাণসী অবরোধ করেন বলেও জানা যায়।
কাশীর প্রতিবেশী রাজ্য কোশল বর্তমান উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। গুমতি, সদানীরা ও সর্পিকা নদী এবং নেপাল পাহাড় রাজ্যটিকে বেষ্টন করে রেখেছিল। অযোধ্যা, সাকেত ও শ্রাবস্তী নগর তিনটি কৌশল রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। এছাড়া সেতব্যা, কীটাগিরি প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি শহরও এর অন্তর্গত ছিল। শ্রাবন্তী ছিল এই রাজ্যের রাজধানী, যার বর্তমান নাম মাহেথমাহেথ। প্রথমদিকে কোশল রাজ্যটির শক্তি কম থাকলেও ক্রমশ এটি শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। কাশী রাজ্যটি এর অন্তর্গত হয়। খ্রিঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ভাগে কপিলাবস্তুও কোশলের অধীনতা স্বীকার করে। কোশলে রাজত্বকারী রাজবংশের নাম ছিল ইক্ষ্বকুবংশ। কোশলরাজ প্রসেনজিৎ গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক ছিলেন।
অঙ্গ রাজ্যের অবস্থান ছিল মগধের পূর্বে। চম্পানদী মগধ ও অঙ্গ রাজ্যের মধ্যে সীমারেখা রচনা করেছিল। সম্ভবত বিহারের ভাগলপুর ও মুখে জেলা নিয়ে অঙ্গ রাজ্য গঠিত ছিল। এই রাজ্যের উত্তরে প্রবাহিত ছিল গঙ্গা নদী। গঙ্গা ও চম্পার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত চম্পানগরী ছিল অঙ্গের রাজধানী। মৎস পুরাণ, বায়ু পুরাণ ও মহাভারত অনুযায়ী চম্পার পূর্বনাম ছিল মালিনী। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ অনুযায়ী অঙ্গ ছিল একটি সমৃদ্ধিশালী রাজ্য। এর রাজধানী চম্পাও সমৃদ্ধ বাণিজ্যনগরী হিসেবে খ্যাত ছিল। চম্পা বন্দর থেকে বণিকরা সুবর্ণভূমির উদ্দেশ্যে বাণিজ্যযাত্রা করত। অনেকে অনুমান করেন যে, চম্পা নগরীর নাম থেকেই আনাম ও কোচিন-চীনের হিন্দু উপনিবেশের নাম রাখা হয়েছিল চম্পা। দীর্ঘনিকায়তেও বলা হয়েছে যে, ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি নগরীর মধ্যে একটি হল চম্পা। ভারতের আধিপত্য দখলের জন্য অঙ্গ ও মগধের মধ্যে দীর্ঘ সংগ্রাম চলেছিল। অঙ্গরাজ ব্রহ্মদত্তের সময়ে এই রাজ্য মগধের রাজাকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। পরিশেষে মগধে হর্ষঙ্ক বংশের উত্থান হলে অঙ্গ রাজ্য মগধের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
মগধ বলতে বর্তমান দক্ষিণ বিহারের পাটনা ও গয়া জেলাকে বোঝাত। এই রাজ্যের উত্তরদিক দিয়ে গঙ্গা, পশ্চিমদিক দিয়ে শোন ও পূর্বদিক দিয়ে চম্পা নদী প্রবাহিত ছিল। মগধের সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় অথর্ববেদে। প্রথমে গঙ্গার নিকটবর্তী গিরিব্রজ বা রাজগৃহ ছিল মগধের রাজধানী। পরবর্তীকালে গঙ্গা ও শোন নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত পাটলীপুত্রে এর রাজধানী স্থানান্তরিত হয়। এই রাজ্যের হর্ষকবংশীয় রাজা বিম্বিসার ছিলেন গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক। মগধের অধিকাংশ রাজাই ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী। তাই শেষ পর্যন্ত এই সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গড়ে উঠে মগধকে কেন্দ্র করেই।
গঙ্গানদীর উত্তরভাগ থেকে নেপাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বজ্জি বা বৃজি রাজ্য। রিস ডেভিস ও কানিংহামের মতে, বৃজি রাজ্য ছিল আটটি উপজাতীয় গোষ্ঠীর এক যুক্তরাজ্য। এদের মধ্যে লিচ্ছবী, বিদেহ, জ্ঞাতৃক এবং বৃজি বা বজ্জি ছিল প্রধান। অপর চারটি উপজাতির নাম সঠিকভাবে জানা যায় না। এদের মধ্যে বিদেহদের রাজধানী ছিল নেপাল সীমান্তের মিথিলা, বিদেহ রাজবংশের অবসানের পরেই সম্ভবত বৃজি রাষ্ট্রসংঘ স্থাপিত হয়েছিল। জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর ছিলেন জ্ঞাতৃক কুলজাত। জ্ঞাতৃকগণ কুন্ডপুর ও কোল্লগ অঞ্চলে বসবাস করত। লিচ্ছবীগণের রাজধানী ছিল বৈশালী। একে মজঃফরপুর জেলার বেসার-এর সাথে সনাক্ত করা হয়। বৈশালী শুধু লিচ্ছবীগণের নয়, সম্ভবত সমগ্র বৃদ্ধি রাষ্ট্রসংঘেরই রাজধানী ছিল। বৃজি রাজ্যের আটটি উপজাতির মধ্যে লিচ্ছবীগণ ভারতের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থানের অধিকারী। একদা অনেক ঐতিহাসিক লিচ্ছবীদের বিদেশী বলে মনে করতেন। ভিনসেন্ট স্মিথ ও সতীশচন্দ্রের মতে, লিচ্ছবীগণ ছিল যথাক্রমে তিব্বত ও পারস্যের অধিবাসী। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা ক্ষত্রিয়ই ছিল। কারণ মহাপরিনির্বাণ সুত্ত অনুযায়ী বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর লিচ্ছবীগণ মল্লদের কাছে দূত পাঠিয়ে জানায় যে, বুদ্ধদেবের মতোই তারাও ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত। মগধরাজ অজাতশত্রুর সময়ে লিচ্ছবীগণ অন্যান্য গণরাজ্যেকে সংগঠিত করে অজাতশত্রুর বিরুদ্ধে এক দীর্ঘকালীন ও ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল বলে অনুমান করা হয়।
মল্লরাজ্যটি বুজির উত্তরদিকে অবস্থিত ছিল। রাজ্যটি দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। একটি অংশের রাজধানী ছল কুশীনারা বা কুশীনগর, অপর অংশের রাজধানী ছিল পাবা। এই কুশীনগরেই গৌতমবুদ্ধ দেহরক্ষা করেন। ঐতিহাসিক কানিংহাম এবং উইলসনের মতে, গোরক্ষপুরের পূর্বে ছোট গণ্ডক নদীর তীরবর্তী কাশিয়াই প্রাচীন কুশীনগর। কানিংহামের মতে, কাশিয়ার সামান্য দূরে অবস্থিত প্যাভারাত্তনা গ্রামই ছিল প্রাচীন পান নগরী। মল্লরাজ্য প্রথমে রাজতন্ত্রের অধীনে ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে সেখানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। মনু মল্লদের ব্রাত্যক্ষত্রিয় বলে অভিহিত করেছেন। মল্লদের সাথে লিচ্ছবীদের সম্পর্ক ছিল কখনও শত্রুতার কখনও মিত্রতার। শেষ পর্যন্ত এই রাজ্যটি মগধের অন্তর্গত হয়ে যায়।
যমুনা নদীর নিকটবর্তী স্থানে বর্তমান বুন্দেলখণ্ডের নিকট অবস্থান ছিল চেদী রাজ্যের। আবার অনেকে মনে করেন, নেপালের পর্বতে চেদীগণের অপর একটি বসতি ছিল। চেদীর রাজধানী ছিল শোথথিবতী বা শক্তিমতী। চেদীগণ ছিল ভারতের প্রাচীন উপজাতিদের মধ্যে একটি। পরবর্তীকালের চেদীগণের একটি শাখা কলিঙ্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। হাতিগুম্ফালিপি থেকে এ তথ্য জানা যায়। মৎস, ও পালী রাজ্যের সাথে চেদী রাজ্যের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
গঙ্গানদীর দক্ষিণে এলাহাবাদের নিকটস্থ অঞ্চলে বৎস রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। বৎস রাজ্যের আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই সচ্ছল। এই সচ্ছলতার মূলে ছিল এখানকার উন্নত কার্পাস শিল্প। বৎস রাজ্যের রাজধানী ছিল কৌশাম্বী, একে যমুনা নদীর তীরবর্তী কোসলগ্রামের সঙ্গে সনাক্ত করা হয়। কথাসরিৎসাগরে এই রাজ্যের রাজা উদয়নের দিগ্বিজয়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। উদয়ন, গৌতমবুদ্ধ, বিম্বিসার ও অজাতশত্রুর সমসাময়িক ছিলেন। উদয়নকে নায়ক করে কয়েকটি সংস্কৃত নাটকও রচিত হয়েছে। যথা—ভাসের স্বপ্নবাসবদত্তা, হর্ষের রত্নাবলী ও প্রিয়দর্শিকা ইত্যাদি। উদয়ন প্রথম জীবনে বৌদ্ধধর্মের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন।
দিল্লী ও তার চতুষ্পার্শ্বস্থ অঞ্চল নিয়ে কুরু রাজ্যটি গঠিত ছিল। এর রাজধানী ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ। হস্তিনাপুর ছিল এ রাজ্যের অপর উল্লেখযোগ্য শহর। আলোচ্য সময়ের রাজনীতিতে কুরু রাজ্যের বিশেষ কোন গুরুত্ব ছিল না। পালিগ্রন্থে বলা হয়েছে যে, কুরু রাজবংশের সদস্যগণ ছিল যুধিষ্ঠিরের বংশোদ্ভূত। জাতকে ধনঞ্জয় কৌরব্য, সুতসোমা প্রভৃতি রাজাদের নাম পাওয়া যায়। রাজ্যটি প্রথমদিকে ছিল রাজতান্ত্রিক, কিন্তু পরবর্তীকালে এখানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
পাঞ্চাল রাজ্যটি ছিল কুরুর প্রতিবেশী রাজ্য। বুন্দেলখণ্ড ও মধ্য দোয়াবের কিয়দংশ নিয়ে গঠিত ছিল পাণ্ডুাল রাজ্য। জাতক, মহাভারত প্রভৃতি থেকে জানা যায় যে, ভাগীরথী নদী উত্তর পাঞ্চাল ও দক্ষিণ পাঞ্চাল এই দুই ভাগে রাজ্যটিকে বিভক্ত করেছিল। উত্তরাংশের রাজধানী ছিল অহিচ্ছত্র। একে বেরিলি জেলার রামনগরের সাথে সনাক্ত করা হয়েছে। দক্ষিণাংশের রাজধানী ছিল কাম্পিল্য বা কম্পিল। এটি বর্তমানে ফরাক্কাবাদ জেলায় অবস্থিত। পরবর্তীকালের বিখ্যাত নগরী কান্যকুব্জ পাঞ্চালের রাজ্যসীমার মধ্যে অবস্থিত ছিল। কুরু ও পাঞ্চাল রাজ্যের মধ্যে প্রায়শই যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত বলে জানা যায়। কুরু রাজ্যের মতই পাঞ্চাল রাজ্যটিতে প্রথমে রাজতন্ত্র বলবৎ থাকলেও পরবর্তীকালের এখানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
চম্বল ও সরস্বতী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে মৎস্য রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। বর্তমান রাজপুতানার জয়পুর এবং তৎসংলগ্ন আলোয়ার ও ভরতপুরের অংশবিশেষ এই রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। মৎস্য রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন রাজা বিরাট। তাঁর নামানুসারে মৎস্য রাজ্যের রাজধানীর নাম দেওয়া হয় বিরাটনগর। জয়পুরের নিকটবর্তী বৈরাটই ছিল বিরাটনগর। চেদীরাজ সহজ কর্তৃক প্রথমে মৎস্য রাজ্য অধিগৃহীত হয়েছিল। পরিশেষে এটি মগধের অন্তর্ভুক্ত হয়। সম্রাট অশোকের বহু শিলালিপি এই রাজ্যে পাওয়া গেছে।
যমুনা নদীর তীরে শূরসেন রাজ্য অবস্থিত ছিল। এই রাজ্যের রাজধানী ছিল মথুরা। বৈদিক সাহিত্যে শূরসেনের উল্লেখ না থাকলেও গ্রীক লেখকগণের রচনায় সৌরসেনয়, মেথোরা প্রভৃতির উল্লেখ থেকে বোঝা যায় যে, তাঁরা শূরসেন রাজ্যটির অস্তিত্ব জানতেন। এখানে যদুবংশ শাসন করত বলে মহাভারতে বলা হয়েছে। বুদ্ধের শিষ্যদের মধ্যে শূরসেন-রাজ অবস্তীপুত্র ছিলেন অন্যতম। সম্ভবত অবন্তীপুত্র থেকে অবত্তী রাজ্যের সাথে এঁদের বিবাহ সম্পর্ক বিষয়ে ধারণা করা হয়। মথুরা ছিল প্রাচীন ভারতের বিশিষ্ট ধর্মকেন্দ্র। মেগাস্থিনিস মথুরাকে কৃষ্ণ উপাসনার কেন্দ্র বলে উল্লেখ করেছেন।
অস্মক রাজ্যটি ঠিক কোথায় অবস্থিত ছিল, সে বিষয়ে পণ্ডিতদের কিছু মতভেদ আছে। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর মতে, গোদাবরী তীরস্থ অঞ্চলে অস্মক রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। অর্থশাস্ত্রের টীকাকার ভট্টস্বামীনের মতে, মহারাষ্ট্রে অস্মক রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। গ্রীক লেখকগণ উত্তর-পশ্চিম ভারতের যে আস্সাকেনয় রাজ্যটির উল্লেখ করেছেন অনেকে তাকেই অস্মক রাজ্য বলে সনাক্ত করেছেন। কিন্তু ড. রায়চৌধুরীর মতে, এই মত সঠিক নয়। কারণ ‘অস্সাকেনয়’ শব্দটি অশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত অন্যদিকে অস্মক বলতে বোঝায় প্রস্তরময় স্থান। সুতরাং উচ্চারণগত সাযুজ্য থেকে উভয়কে একই স্থান বলে সনাক্ত করা যায় না। পাণিনির উল্লেখিত অস্মকের অবস্থান ছিল দাক্ষিণাত্যে। এই সনাক্তিকরণই সঠিক মনে করা যায়। অস্মক রাজ্যটির রাজধানী ছিল পোটান বা পোটালি। সম্ভবত এটি মহারাষ্ট্রের বোধন। বায়ুপুরাণ অনুযায়ী অস্মকের রাজারা ছিলেন ইক্ষ্বাকুবংশীয়।
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে যে চারটি বৃহৎ রাজ্য ছিল, অবন্তী ছিল তার মধ্যে অন্যতম। পশ্চিম ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হিসেবে অবন্তীর নাম করা যায়। বর্তমান মালব, নিমার ও মধ্যেপ্রদেশের কিছু অংশ নিয়ে মালব রাজ্য গঠিত ছিল। এই রাজ্যের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত বেত্রবর্তী নদী অবন্তীকে দুইভাগে ভাগ করেছিল। বেত্রবতীর উত্তর ভাগ উত্তর অবর্ত্তী ও দক্ষিণভাগ দক্ষিণ অবন্তী নামে পরিচিত ছিল। উত্তর অবন্তীর রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী, দক্ষিণ অবন্তীর মাহিশ্বতী। এই মাহিম্মতী বা মান্ধাতা নর্মদা নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। বুন্দের সময়ে এখানকার রাজা ছিলেন প্রদ্যোৎ। তিনি চণ্ডপ্রদ্যোৎ মহাসেন নামেও খ্যাত ছিলেন। বৎস, কোসল ও মগধের সঙ্গে সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলেও শেষ পর্যন্ত অবত্তী রাজ্য মগধ কর্তৃক অধিগৃহীত হয়।
গান্ধার ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য মহাজনপদ। পাঞ্জাবের যে অংশ সিন্ধুনদের পশ্চিমতীরে অবস্থিত, সেই অঞ্চলেই গান্ধার রাজ্য অবস্থিত ছিল। বর্তমান পেশোয়ার ও রাওয়ালপিণ্ডি জেলা গান্ধারের অন্তর্গত ছিল। মহাভারতেও ধৃতরাষ্ট্র পত্নী গান্ধারীর পিত্রালয় গান্ধারের উল্লেখ আছে। গান্ধার রাজ্যের রাজধানী তক্ষশীলা প্রাচীন ভারতের একটি বিখ্যাত শিক্ষাস্থল ও বাণিজ্যকেন্দ্র রূপে প্রসিদ্ধ ছিল। গান্ধাররাজ পুককুশাতী মগধরাজ বিম্বিসারের সমকালীন ছিলেন ও তিনি মগধে দূত প্রেরণ করেছিলেন। সম্ভবত অবন্তীরাজ প্রদ্যোৎ তাঁর কাছে পরাজিত হন। কিন্তু খ্রিঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকের শেষভাগে গান্ধার রাজ্য পারস্য সম্রাট কর্তৃক অধিগৃহীত হয়। কারণ দারায়ুসের বেহিস্তান লেখতে গান্ধারগণকে ‘পারস্যের প্রজা বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
কম্বোজ রাজ্য গান্ধার রাজ্যের নিকটবর্তী ছিল বলে অনুমান করা হয়। বর্তমান পাকিস্তানের হাজারা জেলা কম্বোজের অন্তর্গত ছিল। কম্বোজের রাজধানী ছিল রাজপুর। পরবর্তী-বৈদিক যুগে কম্বোজ ব্রাহ্মণ্য ধর্মশিক্ষার কেন্দ্রস্থল ছিল। প্রথমে রাজতন্ত্রের প্রচলন থাকলেও পরবর্তীকালে এখানে বিভিন্ন বৃত্তিধারীদের গঠিত সংঘের মিলিত শাসন প্রবর্তিত হয়েছিল।