মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের যুগে ভারতের একাধিক স্থানে গড়ে ওঠা স্বাধীন রাজ্যগুলির মধ্যে বিশেষ শক্তিশালী ও কর্মবহুল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব সাতবাহন বংশীয় রাজাদের প্রাপ্য। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বিদেশী শক্তির বিরোধিতা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে সাতবাহন রাজাদের ভূমিকা স্মরণীয়। সাতবাহনদের ইতিহাস রচনার জন্য পুরাণ (মৎস্য ও বায়ু), টলেমীর ভূগোল ইত্যাদি সাহিত্যিক উপাদান; নানঘাট, নাসিক, কানহেরী, কার্লে প্রভৃতি স্থানে প্রাপ্ত শিলালেখ, সোপার, জোগালথেম্বি, অকোলাওবেরারে প্রাপ্ত মুদ্রা ইত্যাদির উপর নির্ভর করতে হয়।
সাতবাহনদের আদি বাসস্থান ও বংশপরিচয় সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা যায় না। মুদ্রা ও শিলালেখতে আলোচ্য বংশকে ‘সাতবাহন’ বলে উল্লেখ করা হলেও পুরাণে এই বংশের শাসকদের ‘অন্ধ্র’ ও ‘অন্ধ্রভৃত্য’ নাম অভিহিত করা হয়েছে। ড. ভাণ্ডারকর, এন. কে. শাস্ত্রী প্রমুখের মতে, সাতবাহনরা আদিতে ছিল অন্ধ্রের অধিবাসী। এজন্যেই এদের অন্ধ্র বলা হয়েছে। ‘অন্ধ্রভৃত্য’ সম্পর্কে শাস্ত্রীর ব্যাখ্যা হল সাতবাহনরা বা অন্ধ্ররা ছিল মৌর্যদের ভৃত্য। পরে তারা দাক্ষিণাত্যে স্বাধীন শাসনের সূচনা করে। এজন্যই এদের ‘অস্ত্রভৃত্য’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ড. গোপালাচারির মতে, অন্ধ্র ছিল এদের আদি নাম, সাতবাহন ছিল রাজবংশের নাম এবং সাতকর্ণী ছিল উপাধি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অন্ধ্ৰ বা অল্পভূত্য নামে অভিহিত হলেও সাতবাহন রাজাদের কোন শিলালিপি অল্প অঞ্চলে অর্থাৎ পূর্ব দাক্ষিণাত্যে পাওয়া যায়নি। এগুলি সবই পাওয়া গেছে পশ্চিম দাক্ষিণাত্যের নাসিক, নানঘাট প্রভৃতি অঞ্চলে। আদি সাতবাহন শাসকদের মুদ্রাগুলিরও প্রাপ্তিস্থান মহারাষ্ট্র। তাছাড়া, অন্ধ্রদেশ গৌতমীপুত্রের রাজ্যের অন্তর্গত ছিল না, আবার টলেমী প্রতিষ্ঠানকে সাতবাহনদের রাজধানী বলে উল্লেখ করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানকে ঔরঙ্গাবাদ জেলার গোদাবরী নদীর তীরস্থ পৈঠানের সঙ্গে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সবের ভিত্তিতে ঐতিহাসিকদের ধারণা মহারাষ্ট্রই ছিল সাতবাহনদের আদি বাসস্থান। মোটামুটিভাবে গোপালাচারির এই মতটাই অধিকাংশ পণ্ডিত গ্রহণযোগ্য মনে করেন। সম্ভবত এরা ছিল অম্বুজাতীয় লোক এবং মৌর্যদের অধীনস্থ কর্মচারী। পরে মহারাষ্ট্রে স্বাধীন শাসন প্রবর্তন করে সাতবাহন বংশ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। আবার হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী মনে করেন, প্রথমদিকের সাতবাহন রাজারা পশ্চিম দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে শাসন করলেও পরবর্তীকালে তারা ক্রমশ পূর্বদিকে সরে আসতে বাধ্য হয়। তারপর একসময়ে তাদের রাজ্য অন্ধ্র অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এইভাবেই সাতবাহনদের নামের সঙ্গে ‘অস্ত্র’ শব্দটি যুক্ত হয়ে যায়।
সাতবাহন বংশের রাজারা কবে তাঁদের শাসন শুরু করেছিলেন সে বিষয়ে ঐতিহাসিকগণ একমত নন। পুরাণ প্রদত্ত তথ্যের উপর নির্ভর করে ঐতিহাসিকগণ সাতবাহন শাসনের সূচনাকাল সম্পর্কে প্রধানত দুটি মত উপস্থাপিত করেছেন। স্মিথ, নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী, গোপালাচারী প্রমুখের মতে, ২৪৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ২৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে সাতবাহন রাজত্বের সূচনা হয়। অন্যদিকে আর. জি. ভাণ্ডারকর, হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, দীশেনচন্দ্র সরকার প্রমুখের মতে, খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের দ্বিতীয় ভাগে সাতবাহন রাজাগণ তাঁদের রাজত্ব শুরু করেছিলেন। তাঁদের মতের সমর্থনে তাঁরা পুরাণের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। পুরাণে বলা হয়েছে, এই বংশের প্রথম রাজা সিমুক শেষ কামরাজ সুশর্মনের উচ্ছেদসাধন করেন। এ থেকে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, সুশর্মন ও সিমুক ছিলেন সমসাময়িক। সুশর্মন আনুমানিক ৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। সুতরাং সাতবাহন বংশের শাসন খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের দ্বিতীয় ভাগে শুরু হয়েছিল বলা চলে। এটি স্থায়ী হয়েছিল খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত।
পুরাণ অনুযায়ী সাতবাহন বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সিমুক। নানঘাট শিলালেখতেও সিমুকের নাম পাওয়া যায়। পুরাণ অনুসারে তিনি ২৩ বছর রাজত্ব করেন। তার পরে তাঁর ভাই কৃষ্ণ রাজা হন। নাসিকের একটি গুহালেখতে তাঁর নাম থাকায় মনে হয় তাঁর রাজ্যসীমা নাসিক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মৎস্যপুরাণ অনুযায়ী কৃষ্ণ আঠারো বছর শাসন করেছিলেন। এই বংশের তৃতীয় রাজা ছিলেন প্রথম সাতকর্ণী। পুরাণ অনুযায়ী তিনি ছিলেন কৃষ্ণের পুত্র কিন্তু গোপালাচারীর মতে, তিনি ছিলেন সিমুকের পুত্র। সাতকর্ণীর মহিযী নায়নিকার নানাঘাট লিপি থেকে প্রথম সাতকর্ণীর রাজত্বের মূল্যবান তথ্যাদি পাওয়া যায়। এছাড়া ‘হাতিগুম্ফা লিপি’, ‘মুদ্রা’, ‘পেরিপ্লাস অফ দি ইরিথ্রিয়ান সী’, ‘পুরাণ’ ইত্যাদি থেকে সাতকর্ণী সম্পর্কিত তথ্যাদি জানা যায়। প্রথম সাতকর্ণী খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে রাজত্ব করতেন, হাতিগুম্ফা লিপিতে প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে একথা বলা যায়। তিনিই ক্ষুদ্র সাতবাহন রাজ্যকে বর্ধিত ও শক্তিশালী করে তুলেছিলেন। তাঁর পত্নী নায়নিকা ছিলেন বিখ্যাত অম্ভীয় পরিবারের কন্যা। এই বিবাহসম্পর্ক সাতকর্ণীর ক্ষমতাবৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল সন্দেহ নেই। সাতকর্ণী যেসব অঞ্চল নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন, তার মধ্যে নর্মদা, বিদর্ভ, পশ্চিম মালব, কোঙ্কন, কাথিয়াবাড় ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য। পূর্বে তাঁর রাজ্যসীমা কলিঙ্গ রাজ খারবেলের রাজ্য স্পর্শ করেছিল। তিনি অশ্বমেধযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। প্রথম সাতকর্ণী ‘দক্ষিণাপথপতি’ ও ‘অপ্রতিহত চক্র উপাধি গ্রহণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে মহিষী নায়নিকা দুই নাবালক পুত্রের অভিভাবিকারূপে কিছুদিন শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ঐ সময়ে শক্, পল্লব প্রভৃতি জাতির আক্রমণে সাতবাহন শাসনের অবসান সম্ভাবনা প্রকট হয়ে ওঠে। এমন সময়ে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী সিংহাসনে বসে সাতবাহন শাসনের পুনরুজ্জীবন ঘটান।
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী :
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী ছিলেন সাতবাহন বংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি। তাঁর রাজত্বকালের ইতিহাস রচনার জন্য ঐতিহাসিকগণ প্রধানত তিনটি নাসিক লেখর উপর নির্ভর করেন। প্রথমটি হল তাঁর রাজত্বের অষ্টাদশ বর্ষে রচিত নাসিক লেখ। দ্বিতীয়টি চতুর্বিংশ বছরে মা গৌতমী বলশ্রীর সঙ্গে যুক্তভাবে লিখিত এক লেখ এবং তৃতীয়টি হল গৌতমীপুত্রের মৃত্যুর ১৯ বছর পরে লিখিত নাসিক প্রশস্তি। শেষোক্ত লেখটি তাঁর রাজত্বকাল সম্পর্কে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদিতে পূর্ণ।
গৌতমীপুত্রের রাজত্বকাল নির্ণয়ের প্রধান উপায় হল শকক্ষত্রপ নহপানের সঙ্গে তার যুদ্ধের তারিখ থেকে তার রাজত্বকাল গণনা করা। তিনি নহপানের সমসাময়িক ছিলেন এবং উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ ঘটেছিল ১২৪-২৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। নাসিক প্রশস্তি থেকে জানা যায় যে, গৌতমীপুত্র তার রাজত্বের অষ্টাদশ বর্ষে নহপানকে পরাস্ত করেছিলেন। তাহলে ১২৪ – ১৮ = ১০৬ খ্রিঃ নাগাদ তাঁর রাজত্ব শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। তিনি কতদিন রাজত্ব করেছিলেন এ সম্পর্কে নাসিক প্রশস্তিতে কোন উল্লেখ নেই। তবে যেহেতু ১২৪-২৫ খ্রিঃ তিনি শকক্ষত্রপ নহপানকে পরাজিত করেছিলেন, সেহেতু আশা করা যায় যে, এই সময় পর্যন্ত তিনি ক্ষমতার চূড়ায় অবস্থান করেছিলেন। তাঁর শেষ লেখটি রাজত্বকালের চতুর্বিংশ বছরে রচিত হয়েছিল। তাহলে ১০৬ + ২৪ = ১৩০ খ্রিঃ পর্যন্ত তিনি অবশ্যই রাজত্ব করেছিলেন। তবে ড. ব্রতীন মুখোপাধ্যায় মনে করেন যে, খ্রিষ্টীয় শতকের শেষদিকে তিনি জীবিত ছিলেন। তাঁর মতে, নহপান খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের শেষদিকে রাজত্ব করতেন এবং গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী ছিলেন তাঁর সমসাময়িক।
প্রথম সাতকর্ণী ও গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর রাজত্বকালের মধ্যবর্তীকালে, সাতবাহন-শক্তির দুর্বলতার সময়ে, শকক্ষত্রপ নহপান সাতবাহন রাজ্যের বৃহৎ অংশ দখল করে নিয়েছিলেন। গৌতমীপুত্র সেই নহপানকে পরাজিত করেই সাম্রাজ্যের হৃত অংশ পুনরুদ্ধার করেন। তাঁর রাজত্বের অষ্টাদশ বর্ষের ‘নাসিক লেখ’ থেকে জানা যায় যে, নাসিক, পুনা প্রভৃতি মহারাষ্ট্রের যেসব অংশ শকদের অধীনে চলে গিয়েছিল, তিনি তা পুনরুদ্ধার করেন। শক যুদ্ধে জয়লাভের পর গৌতমীপুত্র গোবর্ধন জেলার বেনাকটক থেকে ভূমিদান করেন। তাছাড়া যোগালথম্বিতে নহপানের যে অসংখ্য মুদ্রা পাওয়া গেছে, দেখা গেছে তার দুই-তৃতীয়াংশই গৌতমীপুত্র কর্তৃক ‘পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, গৌতমীপুত্ৰ নহপানকে পরাস্ত করেছিলেন। এইভাবে লুপ্ত বংশগৌরব তিনি ফিরিয়ে আনেন। এজন্যই নাসিক-প্রশস্তিতে তাঁকে ‘সাতবাহন-কুল-যশঃ প্রতিষ্ঠাপনকর’ আখ্যায় ভূষিত করা হয়েছে। এছাড়া তাঁর শাসনভুক্ত অঞ্চলগুলির এক বিস্তৃত তালিকাও নাসিক প্রশস্তিতে উল্লেখিত হয়েছে। তালিকাভুক্ত অঞ্চলগুলি হল আসিফ (গোদাবরী তীরস্থ অঞ্চল), মূলক (পৈথানের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল), সুরথ (দক্ষিণ কাথিয়াবাড়), কুকুর (উত্তর কাথিয়াবাড়), অনুপ (নর্মদা তীরস্থ মহীস্মতী), বিদর্ভ (বেরার), আকর (পূর্ব মালব), অবন্তী (পশ্চিম মালব)। নাসিক প্রশস্তিতে আরো বলা হয়েছে যে, বিন্ধ্য থেকে মালয় পর্বত পর্যন্ত এবং পূর্বঘাট পর্বতমালা থেকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডের উপর তাঁর আধিপত্য ছিল। উপরোক্ত বর্ণনা বিন্ধ্য পর্বতের পরবর্তী সমগ্র ভূভাগের উপরেই গৌতমীপুত্রের সার্বভৌম অধিকার স্থাপনের ইঙ্গিত বহন করে বলে ডি. সি. সরকার মনে করেন। নাসিক-প্রশস্তিতে প্রদত্ত গৌতমীপুত্র অধিকৃত স্থানগুলির নামের তালিকায় অন্ধ্র ও দক্ষিণ কোশলের নাম অনুপস্থিত। অথচ সাতবাহনগণ ঐ দুই অঞ্চলে যে কোন এক সময়ে রাজত্ব করেছিল তা লেখ, মুদ্রা, হিউ-এন-সাঙ-এর বিবরণ ইত্যাদি থেকে জানা যায়। নাসিক-প্রশস্তিতে বলা হয়েছে যে, গৌতমীপুত্রের যুদ্ধের ঘোড়াগুলি তিনটি সমুদ্রের জল পান করেছিল (তি-সমুদ্র-তোয় পীত-বাহন)। এখানে তিনটি সমুদ্র বলতে আরবসাগর, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরকেই বোঝানো হয়েছে। এই বর্ণনায় কিছুটা অতিশয়োক্তি থাকলেও এ থেকে অন্ধ্রসহ বিন্ধ্য-পরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে মনে করা যেতে পারে। তাছাড়া, ড. গোপালাচারীর মতে, গৌতমীপুত্রের অধিকারভুক্ত স্থানগুলির মধ্যে মহেন্দ্র ও চকুরের উল্লেখ প্রমাণ করে যে, অন্ধ্র ও কলিঙ্গ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল।
গৌতমীপুত্র তাঁর রাজত্বের শেষদিকে, শকদের কাদমক শাখার রুদ্রদামনের হাতে পরাজিত হয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। কারণ ১৫০ খ্রিষ্টাব্দের জুনাগড় লেখতে রুদ্রদামনের অধিকারভুক্ত স্থান হিসেবে আকর, অবন্তী, অনুপ, সুরাষ্ট্র, কুকুর প্রভৃতির নাম রয়েছে। ঠিক ঐ নামগুলিই নাসিক-প্রশস্তিতেও ছিল। এ থেকে মনে হয় যে, রুদ্রদামন সাতবাহন সাম্রাজ্য থেকে ঐ স্থানগুলি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। ঐ লেখতেই তিনি এই দাবিও করেছেন যে দক্ষিণাপথপতি সাতকর্ণীকে তিনি দুবার পরাস্ত করেছিলেন। কিন্তু এই সাতকর্ণী কে ছিলেন, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই এঁকে গৌতমীপুত্রের সাথে অভিন্ন মনে করলেও ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে, পরাজিত সাতবাহন নৃপতি ছিলেন বশিষ্ঠপুত্র এবং সাতবাহন সাম্রাজ্যের এই বিপর্যয় ঘটার আগেই গৌতমীপুত্রের রাজ্যকাল শেষ হয়ে গিয়েছিল। (বিশদ আলোচনা ‘শক-সাতবাহন সংঘর্ষ”-এ দ্রষ্টব্য)। এই মত মেনে নিলে বলা যায়, যে শকদের তিনি প্রথমে পরাজিত করেছিলেন, পরিশেষে তাদের কাছেই পরাজয় বরণের মত অমর্যাদাকর ঘটনা তাঁর জীবনে ঘটেনি এবং রাজত্বের শেষ পর্যন্ত তাঁর মহান কৃতিত্ব অম্লান ছিল।
শুধুমাত্র সমরবিজয়ী সেনাপতি হিসেবে নয়, প্রশাসক ও সংস্কারক রূপেও গৌতমীপুত্র দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন। নাসিক প্রশস্তির বিবরণ থেকে সংস্কারক রূপে তাঁর কৃতিত্ব জানা যায়। যোদ্ধা হিসেবে তিনি বড় ছিলেন, কিন্তু শান্তির কাজে তিনি ছিলেন আরও বড়। প্রজাদের মঙ্গলের জন্য তিনি নিরন্তর কাজ করতেন। তিনি মানবতাবাদ ও শাস্ত্রীয় আইন ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয়সাধন করেছিলেন। নাসিক প্রশস্তিতে বলা হয়েছে যে, তিনি ক্ষত্রিয়দের দর্প খর্ব করেন, ব্রাহ্মণ ও নিম্নশ্রেণীকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেন। তিনি ছিলেন বর্ণ সংমিশ্রণের বিরোধী। তবে ড. গোপালাচারীর মতে, ঐ সময়ে দাক্ষিণাত্যে বহু বর্ণশঙ্কর জাতির উদ্ভব ঘটেছিল। তাই বলা যায়, বর্ণ-প্রথাকে যথাযথ রাখা সম্পূর্ণ সম্ভব হয়নি। তাছাড়া এই সময়ে জীবিকা বা পেশার ভিত্তিতেও নানা উপজাতি গঠিত হয়েছিল। গৌতমীপূত্র ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধদের প্রতি উদার মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন। কার্লে, নাসিক প্রভৃতি স্থানের বিহারবাসীদের তিনি ভূমি ও গুহাদান করেছিলেন। রাজস্ব-ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করে তিনি দরিদ্রশ্রেণীর উপর করভার লাঘব করেছিলেন। অনেকে মনে করেন যে, গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী ও কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য একই ব্যক্তি। সম্ভবত এরূপ ধারণার কারণ এই যে তিনি ‘বর-বরণ-বিক্রমাচারি বিক্রম’ উপাধি নিয়েছিলেন। কিন্তু এই ধারণা ভ্রান্ত বলেই মনে হয়, কারণ গৌতমীপুত্র বিক্রমাদিত্য উপাধি নেননি, বা বিক্রম-সম্বৎ-ও প্রবর্তন করেননি।
পরবর্তী শাসকগণ :
গৌতমীপুত্রের পর তার পুত্র বশিষ্ঠীপুত্র পুলুমায়ি সাতবাহন সিংহাসনে বসেন। নাসিক, কার্লে, অমরাবতী প্রভৃতি স্থানে প্রাপ্ত একাধিক লেখ থেকে পুলুমায়ির রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা যায়। পুরাণে বলা হয়েছে তিনি ২৯ বছর রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ২৪-তম রাজ্যবর্ষের পরবর্তী সময়ের কোন লেখ পাওয়া না যাওয়ায় পণ্ডিতগণ মনে করেন যে, তিনি ২৪ বৎসরই রাজত্ব করেন (১৩০-১৫৪ খ্রিষ্টাব্দ)। রুদ্রদামনের জুনাগড় লেখর (১৫০ খ্রিষ্টাব্দ) প্রদত্ত শক অধিকারভুক্ত অঞ্চলগুলির তালিকা থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাতবাহন সাম্রাজ্যের উত্তরাংশের উপর আর পুলুমায়ির কোন কর্তৃত্ব ছিল না। তবে তাঁর সময়ে পূর্ব দাক্ষিণাত্যে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটেছিল। তিনি অন্ধ্রদেশ সাতবাহন সাম্রাজ্যভুক্ত করতে সক্ষম হন। লেখ ও মুদ্রার প্রাপ্তিস্থানের ভিত্তিতে বোঝা যায় যে, কৃষ্ণা নদীর মোহনা সংলগ্ন অঞ্চল ও বেলারী জেলা তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। গোদাবরী নদীর তীরে পৈথানে তিনি রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।
পুলুমায়ির পর সিংহাসনে বসেন যথাক্রমে শিবশ্রী ও শিবস্কন্দ সাতকর্ণী। এই বংশের শেষ শক্তিশালী রাজা ছিলেন যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণী। নাসিক, কানহেরি ও কৃয়া জেলার চীন্ন গঞ্জামে তাঁর লেখগুলি পাওয়া গেছে। লেখর উল্লেখিত রাজ্যবর্ষের ভিত্তিতে বলা যায় তিনি ২৭ বছর বা তার বেশি সময় রাজত্ব করেন। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর মতে, তিনি ১৬৫ থেকে ১৯৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে, ঐ তারিখ হল ১৭৪ থেকে ২০৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। লেখগুলির প্রাপ্তিস্থান থেকে প্রমাণিত হয় যে, মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্র তাঁর শাসনভুক্ত ছিল। শকনেতা রুদ্রদামনের মৃত্যুর সুযোগে যজ্ঞশ্রী শকদের পরাজিত করে মালব উত্তর-কোঙ্কন প্রভৃতি পুনরুদ্ধার করেন। সোপারায় প্রাপ্ত তাঁর মুদ্রাগুলিতে শক্-মুদ্রার সুস্পষ্ট প্রভাব এর প্রমাণ। তাঁর আমলে সমুদ্রযাত্রা ও ব্যবসাবাণিজ্য বিস্তৃতি লাভ করেছিল। তিনিই ছিলেন শেষ সাতবাহন রাজা, যিনি একই সাথে পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চল শাসন করেছিলেন। তাঁর পরেই সাতবাহন বংশের শাসন কর্তৃত্ব শিথিল হতে থাকে এবং পতনের দিকে অগ্রসর হয়। যজ্ঞশ্রীর রাজত্বের শেষ দিকেই অবক্ষয়ের ছাপ স্পষ্ট হতে থাকে। সম্ভবত জনৈক মাধরিপুত স্বামি সকসেন তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত হয়েছিলেন। পরবর্তী সাতবাহন শাসকদের মধ্যে বিজয়, চন্দ্রশ্রী ও পুলমায়ির নাম উল্লেখযোগ্য। বিজয় মাত্র ছয় বছর শাসন করেছিলেন। পূর্ব-দাক্ষিণাত্য ও কানাড়া অঞ্চলে এঁদের শাসন জারী ছিল বলে মনে করা হয়। তাঁর পুত্র চন্দ্রশ্রী দশ বছর শাসন চালান। ড. গোপালাচারীর মতে, মধ্যপ্রদেশের কিছু ভূখণ্ডে তাঁর শাসন কর্তৃত্ব সীমিত ছিল। কলিঙ্গতে তাঁর ভূমিদান সম্পর্কিত একটি লেখ পাওয়া গেছে। মূল সাতবাহন শাখার শেষ প্রতিনিধি ছিলেন চতুর্থ পুলমায়ি। আকোলায় তাঁর কিছু মুদ্রা পাওয়া গেছে। বেলারি জেলার আদোনিতে প্রাপ্ত তাঁর একটি লেখ থেকে (অষ্টম বছরে) জনৈক ব্যক্তিকে পুষ্করিণী খননের অনুমতি দানের কথা জানা যায়। সম্ভবত তখন সামন্তপ্রভূদের আঞ্চলিক কর্তৃত্ব যথেষ্ট সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তী সাতবাহন শাসক ছিলেন সিমবক সদ্। সম্ভবতঃ সাতবাহনদের অধীন সামত্ত অন্ধ্ৰ বা ইক্ষাকুগণ তাঁকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করেছিল। মুদ্রার সাক্ষ্য থেকে সাতবাহন বংশের বিদর্ভ শাখার তিনজন রাজার নাম পাওয়া যায়। রুদ্র সাতকর্ণী, কর্ণ ও কুম্ভ নামক এই তিন জন রাজা সম্ভবত ও মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণভাগে শাসন করতেন।
নাগার্জুনিকোণ্ডতে প্রাপ্ত ইক্ষাকু বংশের বিভিন্ন লেখ এবং আকোলা অঞ্চলে প্রাপ্ত সাতবাহনদের মুদ্রা থেকে অনুমান করা হয় যে, শেষ লগ্নে সাতবাহনদের স্বাধীন এলাকা পাঁচটি ক্ষুদ্র অংশে খণ্ডিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন শাসকের অধীনে চলে গিয়েছিল। উত্তরাঞ্চলে সাতবাহনদের একটি শাখা কোনক্রমে টিকে ছিল। দক্ষিণ-পূর্বে উত্থান ঘটেছিল পল্লব বংশের। দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল চুটুদের শাসন। পূর্ব প্রান্তে ইক্ষাকুদের শাসন কায়েম হয়েছিল।
সাতবাহন বংশের শাসনব্যবস্থা :
সাতবাহন বংশের শাসনব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে প্রধান উপাদান হল গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী এবং বশিষ্ঠীপুত্র পুলমায়ির বিভিন্ন সরকারী নির্দেশনামা এবং কিছু বৌদ্ধ দলিল। সাধারণভাবে সাতবাহন রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল জটিলতাবর্জিত। মৌর্য শাসনব্যবস্থার মত জটিলতা কিংবা কেন্দ্র ও প্রদেশের শাসন ক্ষমতার সীমারেখা সংক্রান্ত বিরোধ এখানে প্রায় ছিলই না। ড. গোপালাচারীর মতে, সাতবাহন রাজারা যুদ্ধ দ্বারা রাজ্য জয় ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও, তাঁরা ইন্দো-গ্রীক বা কুষাণ রাজাদের মত সাম্রাজ্যিক অভিধা (সম্রাট, একরাট ইত্যাদি) ধারণ করেন নি। সামান্য ‘রাজন’ উপাধি নিয়েই তাঁরা রাজ্য শাসন করতেন। সাতবাহন রাজারা সাধারণভাবে মাতৃপরিচয় দ্বারা চিহ্নিত হতেন। তবে রাজতন্ত্র ছিল বংশানুক্রমিক এবং পিতৃতান্ত্রিক। শাসনব্যবস্থার ভিত্তি ছিল ধর্মশাস্ত্রের বিধান এবং সামাজিক ঐতিহ্য। সাতবাহন রাজারা ‘দৈবস্বত্ত্ব’ দাবি করেন নি। সিংহাসনের অধিকারকে কেন্দ্র করে সাতবাহন আমলে কোন উত্তরাধিকার সংঘর্ষ বা ভ্রাতৃবিরোধ ঘটে নি। ড. গোপালাচারী সাতবাহন যুগের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ‘পুলিশি রাষ্ট্র’ (Police state) নামে অভিহিত করেও স্বীকার করেছেন যে, মৌর্যদের মত ‘অনিয়ন্ত্রিত স্বৈরাচার’ কিংবা ‘প্রবল কেন্দ্রীকরণ’ সাতবাহন রাষ্ট্রব্যবস্থায় ছিল না। আইনত সাতবাহন রাজারা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হলেও, দেশাচার বা ধর্মশাস্ত্রের বিধানকে মান্যতা দিয়েই তাঁরা শাসন পরিচালনা করতেন। সম্ভবতঃ প্রাদেশিক শাসকদের ওপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিষয়ে তাঁদের কিছুটা দ্বিধা ছিল। তাই প্রাদেশিক শাসকদের স্বশাসনের কিছু অধিকার সাতবাহন রাজারা মেনে নিতেন। ড. রামশরণ শর্মার মতে, দাক্ষিণাত্যের উপজাতি সম্প্রদায় তখনও ব্রাহ্মণ্য হিন্দুদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে রাজী ছিল না। তাই সীমান্ত রাজ্যগুলিতে সামরিক শাসকের নেতৃত্বে কঠোর ও সুনিয়ন্ত্রিত শাসন জারি করা হত। ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর মতে, মহাসেনাপতি ছাড়াও মহাভোজ, মহারথিক প্রমুখ কর্মচারীও সামরিক কর্তৃত্ব ভোগ করতেন। এই বিচারে ড. গোপালাচারী সাতবাহন শাসনকে ‘পুলিশ’ ব্যবস্থা বলেছেন।
রাজা স্বয়ং শাসন পরিচালনার পাশাপাশি যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে সেনাবাহিনীকে উৎসাহিত করতেন। শান্তির সময় তিনি রাজধানীতে অবস্থান করে শাসন পরিচালনায় নেতৃত্ব দিতেন। রাজপুত্রদের ‘কুমার’ আখ্যা দেওয়া হত। তবে কেন্দ্রীয় শাসনে কুমারদের কোন ভূমিকা ছিল না। অবশ্য প্রদেশের শাসক হিসেবে তাঁরা দায়িত্ব পালন করতেন। সাধারণভাবে রাজার জ্যেষ্ঠপুত্রই পরবর্তী শাসক পদে নিযুক্ত হতেন। তবে মৃত্যুকালে জ্যেষ্ঠপুত্র নাবালক হলে, রাণীমাতা স্বয়ং তার অভিভাবক হিসেবে রাজ্য চালনা করতেন।
সাতবাহন শাসনব্যবস্থার সাথে নানা স্তরের ও শ্রেণীর কর্মীবৃন্দ যুক্ত ছিলেন। শাসন পরিচালনায় সামন্ত শ্রেণীর বিশেষ ভূমিকা ও কর্তৃত্ব ছিল। ক্ষমতাশালী সামন্তরা ‘রাজা’ উপাধি নিতেন এবং নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন করতেন। কোলাপুর ও উত্তর কানাড়া অঞ্চলে এমন আধা-স্বাধীন সামন্তদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ‘মহারথী’ এবং ‘মহাভোজ’ নামক দু’শ্রেণীর কর্মচারীর অস্তিত্ব ছিল। ড. গোপালাচারীর মতে, রথিক এবং ভোজগণ সাতবাহনদের মিত্র হিসেবে রাজ্যজয়ে সাহায্য করেছিল। তারাই পুরস্কার হিসেবে এই দুটি অভিধা পেয়েছিল। বংশানুক্রমিক অধিকার হিসেবে এই অভিধা স্বীকৃত ছিল। তাই বিশেষ অঞ্চলে সীমিত কয়েকটি পরিবারের মধ্যে এই অভিধা সীমিত ছিল। পশ্চিম দাক্ষিণাত্যে মহাভোজদের কিছু লেখ পাওয়া গেছে। সেগুলি বিশ্লেষণ করে ড. গোপালাচারী মন্তব্য করেছেন যে, মহারথীদের অস্তিত্ব সাতবাহন বংশের শাসনের সূচনা থেকেই ছিল। পরবর্তীকালে সাতবাহন সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের কাজে ভোজগণের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘মহাভোজ’ উপাধি প্রদত্ত হয়েছে। এদের পদমর্যাদা মহারথিকদের ওপরে ছিল বলেই অনুমান। প্রাদেশিক সাধারণ শাসকদের সাথেও মহারথীদের কিছু অধিকারগত পার্থক্য ছিল। সাধারণ প্রাদেশিক শাসকরা রাজার অনুমতিক্রমে ভূমিদান করার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু মহারথী তাঁদের নিজ নিজ নামে আর্থিক দাবী পরিহার সহ গ্রাম দান করার অধিকারী ছিলেন। পুলমায়ির রাজত্বের শেষ দিকে মহারথীরা স্বনামে মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন বলে জানা যায়। ড. গোপালচারীর মতে, রাজবংশের সাথে মহারথীদের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল।
সাতবাহন সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধির কারণে ‘মহাসেনাপতি’ ও ‘মহাতালবর’ নামক দুটি পদের সৃষ্টি হয়। এঁরাও সামন্তশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বাশিষ্ঠীপুত্র পুলমায়ির আমলে উৎকীর্ণ নাসিক লেখতে ‘মহাসেনাপতি’ পদের উল্লেখ সর্বপ্রথম পাওয়া যায়। মহাসেনাপতি সম্ভবত সীমান্ত অঞ্চলের শাসন দায়িত্ব পেতেন। নীলকণ্ঠ শাস্ত্রীর মতে, দূরবর্তী প্রদেশগুলিতে উপজাতি সম্প্রদায়ের স্বাধীনতা স্পৃহা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সামরিক ক্ষমতাসহ এদের নিয়োগ করা হত। এছাড়া কেন্দ্রের বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বেও এঁদের নিয়োগ করা হত। নথিপত্র রক্ষণাবেক্ষণের কাজও এঁরা করতেন। রাজপরিবারের সাথে এঁদের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের দৃষ্টান্ত আছে। সম্ভবত রাজবংশের প্রতি এদের অনুগত রাখার লক্ষ্যে এই উদারতা দেখানো হয়েছিল। কেউ কেউ স্বনামে মুদ্রা প্রবর্তনের অধিকারী ছিলেন। যদিও সাতবাহনদের দূর্বলতার সুযোগে এঁদের কেউ কেউ স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠা করতে দ্বিধা করেন নি। অন্ধ্রপ্রদেশের প্রচলিত একটি পদবী ছিল ‘তালবর’। সাতবাহন শাসকরা তাঁদের স্থানীয় কর্মচারীদের জন্য এই পদবি ব্যবহার করেছিলেন। কৃয়া জেলার অধীন আল্লরু নামক স্থানে প্রাপ্ত একটি লেখতে ‘মহাতালবর’ উপাধিযুক্ত কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এরাও সামন্ত শ্রেণীভুক্ত ছিলেন।
সাতবাহন শাসকরা বিকেন্দ্রীভূত শাসন কায়েম করেছিলেন। তবে বিকেন্দ্রীকৃত শাসন কাঠামোর স্বরূপ সম্পর্কে ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী ও ড. গোপালাচারীর মধ্যে মতভেদ আছে। ড. রায়চৌধুরীর মতে, সমগ্র সাতবাহন সাম্রাজ্য ‘আহর’ অথবা ‘জনপদ’ নামক শাসন বিভাগে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি আহর বা জনপদে সামরিক ও বেসামরিক, দুই শ্রেণীর কর্মচারী নিযুক্ত থাকতেন। সামরিক শাসক ‘মহাসেনাপতি’, ‘মহাভোজ’, ‘মহারথী’ ইত্যাদি নামে অভিহিত হতেন। এমনকি এদের মধ্যে ‘রাজন’ উপাধিযুক্ত শাসকও ছিলেন। বেসামরিক শাসককে বলা হত ‘অমাত্য’। অন্যদিকে ড. গোপালাচারীর মতে, আহর অথবা জনপদ নয়; সাতবাহন রাজ্য জনপদ এবং আহর নামক এককে বিভক্ত ছিল। তাছাড়া, গোটা সাম্রাজ্য এভাবে বিভক্ত ছিল না। যে অংশগুলি সামন্তদের অধীন ছিল, সেগুলি বাদ দিয়ে অবশিষ্ট অংশকে ‘জনপদ’ ও ‘আহরে’ বিভক্ত করা হয়। একটি জনপদের অধীনে একাধিক আহরের অস্তিত্ব ছিল। তাছাড়া স্থানীয় শাসকরা একই অঞ্চলে সমান্তরাল শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন না। গোপালাচারীর মতে, সাতবাহনদের জেলা শাসনব্যবস্থা মৌর্যদের অনুরূপ ছিল। অমাত্য পদ বংশানুক্রমিক ছিল না। এমনকি এই পদের দায়িত্ব বদলি যোগ ছিল। শাসন কাঠামোর সর্বনিম্ন একক ছিল ‘গ্রাম’। গ্রাম শাসনের প্রধান ছিলেন ‘গ্রামিক’। সম্ভবত, মৌর্য যুগের গ্রাম শাসন কাঠামো সাতবাহনদের আমলেও অপরিবর্তিত ছিল।
রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল ভূমিরাজস্ব, জরিমানার অর্থ, লবণ উৎপাদনের অধিকার সংক্রান্ত কর ইত্যাদি। সরকারী কর্মী ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা নগদ অর্থের বদলে জমি ভোগ করতেন। কর প্রদানের ক্ষেত্রেও নগদ অর্থের পরিবর্তে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহার করা হত। সার্বিকভাবে কৃষকদের অবস্থা ভাল ছিল না বলেই অনুমিত হয়। জমিতে কৃষকের ভোগ-দখলের অধিকারের নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু নথিতে নির্দিষ্ট জমি যেমন উদ্যান, কৃষিক্ষেত্র ইত্যাদিতে সরকারী কর্মী বা লবণ উৎপাদকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা ছিল। সম্ভবত, অবশিষ্ট ক্ষেত্রে জমিতে কৃষকের অধিকার সুনিশ্চিত ছিল না।
শক-সাতবাহন সংঘর্ষ :
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পরবর্তী ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস কিছুটা অস্পষ্ট। গুপ্ত বংশের নেতৃত্বে পুনরায় সাম্রাজ্য গঠিত হবার আগে পর্যন্ত অর্থাৎ মধ্যবর্তী সময়ে ভারতে কোন কেন্দ্ৰীয় শক্তি ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি, অনেক রাজবংশ, বহু রাজ্য প্রভৃতির জটিলতায় এই দীর্ঘ সময় ছিল আচ্ছন্ন। এই সময়ে একদিকে দক্ষিণ-ভারত ও উপকূল অঞ্চল যেমন তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তুলতে উৎসাহী ছিল তেমনি অন্যদিকে উত্তর-ভারতে একের পর এক প্রবেশ করেছিল ইন্দোগ্রীক, শক, পার্থিয়, কুষাণ প্রভৃতি বিদেশী জাতিগুলি। এরা প্রত্যেকেই ভারতীয় রাজ্য গঠনে প্রয়াসী হয়েছিল। ফলে ভারতীয় রাজবংশগুলির সাথে এদের সংঘর্ষের সূচনা হয়। এই রকমই এক দীর্ঘকালীন সংঘর্ষ চলেছিল শক ও সাতবাহনদের মধ্যে।
দীর্ঘকালীন শক-সাতবাহন দ্বন্দ্বের বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে এই দ্বন্দ্বের অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধান প্রাসঙ্গিক। সমকালীন বাণিজ্যিক অর্থনীতি বহুলাংশে আলোচ্য সংঘর্ষকে প্রভাবিত করেছিল। অপরাস্ত বা উত্তর কোঙ্কনে অবস্থিত বন্দরগুলি বহির্বাণিজ্যের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে মালবের অর্থনৈতিক গুরুত্বও ছিল যথেষ্ট। পূর্ব-মালবে ছিল হীরার খনি (আকর)। তাই অপরান্ত ও মালবের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়েছিল শক ও সাতবাহন উভয় শক্তিই। নহপান, গৌতমীপুত্র, রুদ্রদামন প্রমুখ উভয় বংশেরই শক্তিশালী শাসকগণ তাই উক্ত অঞলগুলিকে নিজ নিজ কর্তৃত্বাধীনে আনার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন।
সিমুক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সাতবাহন রাজ্যকে বৃহদায়তন দান করেন প্রথম সাতকর্ণী। সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে নর্মদার উত্তর তীরে পূর্ব মালবে তাঁর আগমন ঘটে। ঐ অঞ্চলে শক আক্রমণের আশঙ্কা থাকলেও তাঁর সময়ে শকদের সাথে কোনরকম সংঘর্ষ হয়েছিল বলে জানা যায় না। এই সংঘর্ষ শুরু হয়, প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় সাতকর্ণীর রাজত্বকালে। ‘পেরিপ্লাস’ থেকে জানা যায় পশ্চিম উপকূলের কল্যাণ বন্দর দ্বিতীয় সাতকর্ণীর রাজত্বের প্রথমদিকে তাঁর অধিকারভুক্ত থাকলেও দীর্ঘকাল তিনি সেই অধিকার রক্ষা করতে পারেননি। অন্যদিকে শকরাজ নহপানের বিভিন্ন লেখ ও মুদ্রা থেকে জানা যায় যে, নহপানের সময়ে মহারাষ্ট্রের উত্তরাংশ, কোঙ্কন, মালব ও কাথিয়াবাড় অঞ্চলে শক শাসন বিস্তৃত ছিল। সুতরাং নহপান বা তাঁর পূর্ববর্তী কোন শাসক সাতবাহনদের কাছ থেকে ঐসব অঞ্চল দখল করে নিয়েছিলেন বলা চলে। এরই পরিণতিস্বরূপ প্রথম সাতকর্ণী ও গৌতমীপুত্রের মধ্যবর্তী দীর্ঘ সময় ধরে সাতবাহনগণ পশ্চিম উপকূল থেকে ক্রমশ পূর্ব উপকূলের দিকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিল।
১০৬ খ্রিস্টাব্দে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী সাতবাহন সিংহাসনে বসলে শক সাতবাহন দ্বন্দ্ব জোরালো হয়ে ওঠে। পূর্ববর্তী শাসকদের দুর্বলতা কাটিয়ে তিনি শক অগ্রগতিকে রুদ্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। শকরাজ নহপান ছিলেন তাঁর সমসাময়িক। গৌতমীপুত্র সম্ভবত তাঁর রাজত্বের অষ্টাদশ বর্ষে নহপানকে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করেছিলেন। এর প্রমাণ হিসেবে তাঁর রাজত্বের অষ্টাদশ বর্ষের নাসিক লেখর উল্লেখ করা যেতে পারে। লেখ থেকে জানা যায় যে, উক্ত দানপাত্রটি প্রচারিত হয়েছিল গোবর্ধন (নাসিক) জেলার বেনাকটক-এর একটি সামরিক ছাউনি থেকে, যেখানে বিজয়ী সাতবাহনরাজ নিজে উপস্থিত ছিলেন। নাসিক ও পুনা অঞ্চল ইতিপূর্বে শাসন করতেন নহপানের জামাতা উষভদাত। আলোচ্য দানপত্রে তার অধীনস্থ কিছু জমি সাতবাহনরাজ গৌতমীপুত্র কর্তৃক অন্যদের দানের উল্লেখ রয়েছে। এই ঘটনাকে নিঃসন্দেহে শকদের বিরুদ্ধে গৌতমীপুত্রের জয়ের প্রমাণ বলা চলে। তাছাড়া জোগালথেম্বিতে প্রাপ্ত মুদ্রাও শক-সাতবাহন যুদ্ধের ফলাফল ইঙ্গিত করে। এখানে এমন অজস্র মুদ্রা পাওয়া গেছে, যেগুলি আগে ছিল নহপানের, পরে গৌতমীপুত্র সেগুলিকে পুনর্মুদ্রিত করেন। আবার নাসিক প্রশস্তিতে তাঁকে ‘শক-যবন-পহ্লব-নিশূদন’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ গৌতমীপুত্র এদের ধ্বংস করেছিলেন বলে বলা হয়েছে। এ থেকেও মনে হয় তিনি শকদের পরাজিত করেন।
শকদের বিরুদ্ধে গৌতমীপুত্রের এই সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সাধারণভাবে মনে করা হয় রাজত্বের শেষদিকে শকদের কার্দমক শাখার রুদ্রদামনের হাতে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। কারণ ১৫০ খ্রিস্টাব্দের জুনাগড় লেখতে রুদ্রদামনের অধিকারভুক্ত স্থান হিসেবে আকর, অবন্তী, অনুপ, সুরাষ্ট্র, কুকুর প্রভৃতির নাম রয়েছে। ঠিক ঐ নামগুলিই নাসিক প্রশস্তিতেও ছিল। এ থেকে মনে হয় যে, রুদ্রদামন সাতবাহন সাম্রাজ্য থেকে ঐ স্থানগুলি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। টলেমীর গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, প্রতিষ্ঠান ছিল পুলুমায়ির রাজধানী এবং উজ্জয়িনী ছিল চেস্টনের (রুদ্রদামনের পিতামহ ও পূর্ববর্তী যুগ্ম শাসক) রাজধানী। এ থেকেও বোঝা যায় যে, মালবে সাতবাহনদের পরিবর্তে কাদমক শকগণের অধিকার বিস্তৃত হয়েছিল। ‘জুনাগড় লেখ’তে রুদ্রদামন এই দাবিও করেছেন যে, তিনি দক্ষিণাপথপতি সাতকর্ণীকে দুবার পরাস্ত করেছিলেন। এই বিপর্যয় এড়ানোর জন্য এমনকি গৌতমীপুত্র নিজপুত্র বশিষ্ঠপুত্রের সাথে রুদ্রদামনের কন্যার বিবাহও দিয়েছিলেন বলে ‘কানহেরি লেখ’ থেকে অনুমান করা যায়। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য কতদূর সফল হয়েছিল তা সন্দেহের বিষয়। কারণ ‘জুনাগড় লেখ’ থেকে জানা যায়, রুদ্রদামন সাতকর্ণীকে দুবার পরাজিত করলেও আত্মীয় বলে তার রাজ্যগ্রাস করেননি।
‘জুনাগড় লেখ’তে উল্লিখিত পরাজিত সাতবাহন রাজ সাতকর্ণী যে গৌতমীপুত্রই ছিলেন, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। ড. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এ বিষয়ে ভিন্ন তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কানহেরি লেখ’ অনুযায়ী রুদ্রদামনের কন্যার সাথে বশিষ্ঠপুত্র সাতকর্ণীর বিবাহ হয়েছিল। এই বশিষ্ঠপুত্র ছিলেন পুলুমায়ির পরবর্তী শাসক। সুতরাং রুদ্রদামন কর্তৃক পরাজিত সাতবাহন নৃপতি ছিলেন তাঁর আত্মীয় অর্থাৎ জামাতা বশিষ্ঠপুত্র। ইনি কখনই গৌতমীপুত্র নন, কারণ গৌতমীপুত্রের রাজত্বকাল ১৩০ খ্রিস্টাব্দের আগেই সমাপ্ত হয়েছিল। যাইহোক্, পরাজিত সাতবাহন নৃপতি যিনিই হোন না কেন, শকরাজ রুদ্রদামনের হাতে সাতবাহন শক্তি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল -তাতে কোন সন্দেহ নেই।
রুদ্রদামনের মৃত্যুর পর শকদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। রুদ্রদামনের বংশধরদের দুর্বলতা ও অযোগ্যতাই এর জন্য প্রধানত দায়ী ছিল। সাতবাহনরাজ যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণীর রাজত্বকালে -শক-সাতবাহন সংঘর্ষ পুনরায় শুরু হয়, এবং এক্ষেত্রে যজ্ঞত্রী শকদের পরাজিত করতে সক্ষম হন। তিনি শকদের পরাজিত করে অপরান্ত পুনরুদ্ধার করেন। অপরান্তের রাজধানী সোপারায় প্রাপ্ত রৌপ্য মুদ্রাগুলি এর প্রমাণ বহন করে। অপরাস্ত ছাড়াও যজ্ঞশ্রী পশ্চিম ভারতের অংশবিশেষ এবং নর্মদা উপত্যকা থেকে শকদের বিতাড়িত করেন।
রুদ্রদামনের পরে শকশক্তি যেমন দুর্বল হয়ে পড়ে, যজ্ঞশ্রীর পরে সাতবাহন বংশও তেমনি দুর্বল হতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই উভয়ের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও ক্ষীণ হতে শুরু করে। কালক্রমে গুপ্তবংশের উত্থানের ফলে শক শাসনের অবসান ঘটে এবং সাতবাহন রাজ্যও একাধিক আঞ্চলিক রাজা কর্তৃক খণ্ডখণ্ড ভাবে অধিকৃত হয় এবং ভারত-ইতিহাসে শুরু হয় নতুন অধ্যায়।