হর্ষবর্ধনের পূর্বপুরুষ:
হূন শাসিত অঞ্চল এবং মগধের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে পুষ্যভৃতি রাজ্য গড়ে উঠেছিল। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, জনৈক পুষ্যভূতি থানেশ্বর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তিনি ছিলেন শিবের উপাসক। কিন্তু হর্ষচরিত গ্রন্থে হর্ষের পূর্ববর্তী চারজন ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, যথা- নরবর্ধন, রাজ্যবর্ধন, আদিত্যবর্ধন এবং প্রভাকরবর্ধন। সম্ভবত প্রথম তিনজন শাসক স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ করতেন না। কারণ এঁরা ‘মহারাজ’ উপাধি গ্রহণ করে সন্তুষ্ট ছিলেন। অনুমিত হয়, এঁরা হন বা পরবর্তী গুপ্ত অথবা মৌখরীবংশীয় শাসকদের অধীনস্থ সামন্ত ছিলেন। প্রভাকরবর্ধন ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। তাই মনে করা যেতে পারে যে, তিনিই পুষ্যভৃতি বংশের প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম শাসক ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে পুষ্যভূতি বংশের রাজ্যসীমা ও প্রতিপত্তি অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রথম পর্বের শাসকদের রাজত্বকাল আনুমানিক ৫২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রসারিত ছিল।
প্রভাকরবর্ধন পুষ্যভূতি বংশের শক্তি সুদৃঢ় করেন। হুন, সিন্ধুদেশ, মালব, লাট, গুর্জর প্রভৃতি শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজের শক্তি ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার কাজে তিনি কৃতিত্ব দেখান। প্রভাকরবর্ধনের সাহসিকতা ও বীরত্বের প্রশংসা করে ‘হর্ষচরিত’ গ্রন্থে বাণভট্ট লিখেছেন, “হুন হরিণের কাছে ছিলেন সিংহের মতো, সিন্ধু অঞ্চলের রাজার কাছে তপ্ত জ্বরের মতো, গুর্জরদের নিদ্রায় বিঘ্নসৃষ্টিকারী, গান্ধারের রাজার কাছে ভীষণ ব্যাধি প্লেগের মতো, নীতিজ্ঞানহীন লাটদের কাছে দস্যুর মতো এবং মালবের গৌরব লতিকার কাছে ধারালো কুঠারের মতো” (“a lion to the Huns deer, a burning fever to the king of Indus land, a troubler to the sleep of Gurjara. a billions plague to that scant elephant, the Lord of Gandhara, a lotter to the lawlessness of the Latas, an axe to the creeper of Malwa’s Glory.”)। এই বক্তব্যে হয়তো অতিরঞ্জন আছে। তবে একথা সত্য যে, একাধিক আঞ্চলিক শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর বীরত্বব্যঞ্জক অবস্থান পুষ্যভূতি বংশের মর্যাদার দ্যোতক ছিল। ভারতের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে হুনদের পুনরাক্রমণের বিবরণ হিউয়েন সাঙ-এর রচনাতেও পাওয়া যায়। হর্ষচরিত গ্রন্থের প্রেক্ষিতে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন যে, মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে প্রভাকরবর্ধন তাঁর পুত্র রাজ্যবর্ধনের নেতৃত্বে উত্তরাপথে হুনদের বিরুদ্ধে একটি অভিযান পাঠিয়েছিলেন। তবে এই অভিযানের ফলাফল সম্পর্কে বিশেষ উল্লেখ সমকালীন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। সম্ভবত উভয়পক্ষে কোনো সংঘর্ষ আদৌ হয়নি। কারণ অভিযানের মাঝপথেই পিতার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে রাজ্যবর্ধন রাজধানীতে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি রাজ্যে ফিরেই পিতার মৃত্যুসংবাদ এবং মাতা যশোমতীর আত্মহত্যার মর্মান্তিক সংবাদ পান।
প্রভাকরবর্ধনের দুই পুত্র ও এক কন্যা। পুত্ররা হলেন রাজ্যবর্ধন ও হর্ষবর্ধন এবং কন্যা রাজ্যশ্রী। মৌখরীবংশীয় অবস্তীবর্মনের পুত্র গ্রহবর্মনের সাথে রাজ্যশ্রীর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। এই সূত্রেও পুষ্যভূতিদের সাথে মৌখরীবংশের আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল। যাইহোক, প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যুর পর থানেশ্বরের সিংহাসনে বসেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজ্যবর্ধন। ঠিক সেই মুহূর্তে কনৌজ থেকে দুঃসংবাদ আসে যে, মালবরাজ দেবগুপ্ত মৌখরীরাজ গ্রহবর্মনকে হত্যা করেছেন এবং রাজ্যশ্রীকে কারারুদ্ধ করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যবর্ধন ভান্ডির নেতৃত্বে দশ হাজার অশ্বারোহী যোদ্ধাসহ মালবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। মালব রাজকে পরাজিত ও হত্যা করে রাজ্যবর্ধন প্রতিশোধ নেন। এর পর তিনি সম্ভবত ভগিনী রাজ্যশ্রীকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু মাঝপথে শশাঙ্কের সাথে তাঁর সংঘর্ষ হয় এবং শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেন। ‘হর্ষচরিত’ গ্রন্থের মতে, শশাঙ্ক বিশ্বাসাতকতা দ্বারা রাজ্যবর্ধনকে হত্যা করেছিলেন। দেবগুপ্তের হত্যাসংবাদে ভীত হয়ে শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠান এবং আমন্ত্রণ জানান। রাজ্যবর্ধন ‘মিত্রতা চুক্তি’ স্বাক্ষরের জন্য অপ্রস্তুত অবস্থায় উপস্থিত হলে শশাঙ্ক আকস্মিক আক্রমণ দ্বারা তাঁকে হত্যা করেন। অবশ্য হর্ষচরিতের এই বক্তব্য সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।
হর্ষবর্ধনের সিংহাসনারোহণ :
রাজ্যবর্ধনের আকস্মিক মৃত্যুর পর থানেশ্বরের সিংহাসনে বসেন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা হর্ষবর্ধন। ইতিমধ্যে অপুত্রক অবস্থায় গ্রহবর্মনের মৃত্যুর ফলে কনৌজের সিংহাসনও শূন্য হয়ে গিয়েছিল। হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ মতে, কনৌজের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা এড়াতে রাজ-অমাত্য ভান্ডির (পো-নি) নেতৃত্বে কনৌজের অভিজাত ব্যক্তিবর্গ হর্ষবর্ধনকে কনৌজের শাসনদায়িত্ব গ্রহণের আবেদন জানান। হর্ষবর্ধন প্রাথমিকভাবে এ বিষয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। তাই কিছুকাল নিজ ভগিনীর পক্ষে শাসন পরিচালনা করেন। অল্পকালের মধ্যেই থানেশ্বর ও কনৌজ রাজ্যকে সমন্বিত করে হর্ষ শাসনভার নেন। এই ঘটনাটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তিনি ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে একটি নতুন সম্বৎ চালু করেন, যা হর্ষসম্বৎ নামে খ্যাত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, হিউয়েন সাঙ তাঁর বিবরণে হর্ষবর্ধন ও তাঁর পূর্বসুরিদের কনৌজের রাজা বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু হর্ষচরিত-এর বিবরণ থেকে প্রমাণিত হয় যে, অপুত্রক অবস্থায় গ্রহবর্মনের মৃত্যু, ভগিনীর আত্মগোপন এবং উদ্ভূত বিশৃঙ্খলার প্রেক্ষিতে কনৌজবাসীর আবেদনে সাড়া দিয়ে তিনি কনৌজের সিংহাসনে বসেন। সম্ভবত হিউয়েন সাঙ যখন হর্ষবর্ধনের সান্নিধ্যে আসেন তখন তিনি কনৌজের রাজা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তাই অসাবধানতাবশত তাঁর পূর্বসূরিদেরও কনৌজের রাজা বলে উল্লেখ করে গেছেন।
কনৌজের সিংহাসনে হর্ষবর্ধনের আরোহণ এতটা সহজভাবে হয়েছিল কিনা, সঠিক বলা যায় না। নালন্দা সিল, নেপালের কিছু লেখ এবং আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থের বক্তব্য এ বিষয়ে সংশয় সৃষ্টি করেছে। গ্রহবর্মন-রাজ্যশ্রীর কোনো পুত্রসন্তান ছিল না ঠিকই, কিন্তু নালন্দা সিলে গ্রহবর্মনের ভাই ও উত্তরসূরি হিসেবে একটি নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে নামটির কেবল আদ্যক্ষর ‘সু’ বর্ণটি এখনো অবশিষ্ট আছে। পরবর্তীকালে রচিত আর্যমঞ্জুশ্রী মূলকল্প নামক বৌদ্ধগ্রন্থে আভাস দেওয়া হয়েছে যে, ‘গ্রহ-সুভ্র’র পরবর্তীকালে মৌখরীরা তাদের রাজ্য ও কর্তৃত্ব হারিয়েছিলেন। নেপালের লেখ থেকেও ভোগবর্মন নামক একজন রাজকুমারের নাম জানা যায়। তাই মনে করা যেতে পারে যে, কনৌজের সিংহাসনপ্রাপ্তি হর্ষবর্ধনের ক্ষেত্রে খুব মসৃণ হয়নি। হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ এবং নালন্দা ও নেপালে প্রাপ্ত শিলালিপির বক্তব্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য আধুনিক ঐতিহাসিকরা ফ্যাং-চি নামক চীনা গ্রন্থের ভিত্তিতে মনে করেন যে, প্রথমদিকে হর্ষবর্ধন কনৌজের সিংহাসনের অন্যান্য দাবিদারদের ঠেকিয়ে রাখার জন্য রাজ্যশ্রীর অভিভাবক হিসেবে কনৌজের শাসনকার্য তত্ত্বাবধান করছিলেন। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে ‘কনৌজের সম্রাট’ বলে ঘোষণা করেন। এই সময় তিনি শিলাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি থানেশ্বর থেকে কনৌজে রাজধানী সরিয়ে আনেন। কনৌজের রাজনৈতিক মর্যাদা, ধনসম্পদ ও অবস্থান নিঃসন্দেহে হর্ষবর্ধনের মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছিল।
হর্ষবর্ধনের সিংহাসনারোহণের অব্যবহিত পরে প্রথম কাজ ছিল ভগিনী রাজ্যশ্রীকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করা। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার হত্যাকাণ্ড এবং ভগিনীর বন্দিদশার সংবাদে ক্ষুব্ধ ও বিব্রত হর্ষবর্ধন কিছু প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বলে সমকালীন সূত্র থেকে জানা যায়। তবে হিউয়েন সাঙ ও বাণভট্টের বক্তব্যে কিছু অমিল আছে। হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ মতে, তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, “যতদিন তিনি অগ্রজের শত্রুদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারবেন না, ততদিন তিনি দক্ষিণ হস্তে খাদ্যগ্রহণ করবেন না।” কিন্তু ‘হর্ষচরিত’ গ্রন্থে বাণভট্ট লিখেছেন যে, হর্ষ বলেছিলেন, “আমি প্রতিজ্ঞা করছি অল্পকালের মধ্যে গৌড়কে পৃথিবী থেকে উচ্ছেদ করব, অন্যথায় পতঙ্গের মতো জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে এই পাপী জীবন বিসর্জন দেব” (“I swear that unless in a limited number of days I clear this earth of guada…then will I hurl my self like a moth into an oil-fed flame.”)। যাইহোক, হর্ষবর্ধন প্রথমেই রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করার কাজে অগ্রসর হন। যাত্রাপথে প্রাগজ্যোতিষ (আসাম)-এর রাজা ভাস্করবর্মনের প্রতিনিধি হর্ষের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর সাথে মিত্রতা স্থাপনের প্রস্তাব দেন। হর্ষ সানন্দে সেই প্রস্তাব মেনে নেন। যাত্রাপথে কনৌজের প্রধানমন্ত্রী ভান্ডির কাছ থেকে সংবাদ পান যে, তাঁর ভগিনী রাজ্যশ্রী কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বিন্ধ্য পর্বতের গহন অরণ্যে প্রবেশ করেছেন। অতঃপর ভান্ডির হাতে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অর্পণ করে হর্ষ বিন্ধ্য পর্বতের অভিমুখে যাত্রা করেন। বহু অনুসন্ধানের পর গভীর অরণ্যে অগ্নিকুণ্ডে আত্মহননের মুহূর্তে তিনি রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করেন।
হর্ষবর্ধনের রাজ্যজয় :
অনুমান করা হয় যে, গৌড়ে শশাঙ্কর ক্ষমতাবৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে ভাস্করবর্মন তাঁর ‘শত্রুর শত্রু’ হিসাবে হর্ষবর্ধনের মিত্রতা চেয়েছিলেন। সম্ভবত রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করার জন্য পুষ্যভূতি ও কামরূপের যৌথ বাহিনী শশাঙ্কর বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়েছিল। তবে উভয়পক্ষে আদৌ কোনো সংঘর্ষ হয়েছিল কিনা, কিংবা হলেও তার ফল কী হয়েছিল, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। কারণ এই যুদ্ধ প্রসঙ্গে বাণভট্ট প্রায় নীরব থেকেছেন। তবে আর্যমঞ্জুশ্রী-মূলকল্প গ্রন্থের মতে, শশাঙ্ক এই যুদ্ধে হর্ষবর্ধনের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। ৬১৯ থেকে ৬২১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু ড. আর. এস. ত্রিপাঠী, সুধাকর চট্টোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ এই বিবরণের যথার্থতা সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কারণ গঞ্জাম জেলায় প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, ৬১৯ খ্রিস্টাব্দের পরেও শশাঙ্ক গৌড়, মগধ, বুদ্ধগয়া, উড়িষ্যা ও কঙ্গোদ প্রভৃতি অঞ্চলে সগৌরবে রাজত্ব করেছিলেন। এ ছাড়া হিউয়েন সাঙ ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে বুদ্ধগয়া পরিদর্শনে এসে জানতে পেরেছিলেন যে, অতিসম্প্রতি শশাঙ্ক গয়ার বোধিবৃক্ষটি ছেদন করেছেন। ক্ষমতাসীন না-থাকলে তিনি এ কাজ করতে পারতেন না বলেই মনে হয়। অর্থাৎ ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দের কিছুকাল আগে পর্যন্ত যতদিন শশাঙ্ক জীবিত ছিলেন, শশাঙ্ক-মণ্ডল (শশাঙ্ক শাসিত অঞ্চল)-এর ওপর তাঁর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন মগধ, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা ও কঙ্গোদ অঞ্চল তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিলেন। শশাঙ্কের রাজ্যের অবশিষ্ট অংশ অর্থাৎ উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গ কামরূপের রাজা ভাষ্করবর্মনের রাজ্যের সাথে যুক্ত হয়েছিল। এইভাবে শশাঙ্কের গৌড়রাজ্য দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়।
বাণভট্টের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, হর্ষবর্ধন বিশ্বজয়ের সংকল্প নিয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর মন্ত্রীকে নাকি নির্দেশ দেন যে, ভারতের সকল রাজার কাছে এই সংবাদ প্রেরণ করা হোক যে, তাঁরা যেন হর্যের আনুগত্য মেনে নেন, অন্যথায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকেন। এই বক্তব্যের সত্যতা নিরূপণ করা কঠিন, তবে হর্ষবর্ধন তাঁর শাসনকালের প্রায় পুরো সময়টাই যে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। হিউয়েন সাঙ তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখেছেন যে, ছয় বছর ধরে হর্ষ ক্রমাগত যুদ্ধ করে ‘পঞ্চভারত’-এর অধিপতি হয়েছিলেন। পঞ্চভারত বলতে তিনি সম্ভবত পাঞ্জাব (বরসত্র), কনৌজ (কান্যকুব্জ), বাংলা (গৌড়), বিহার (মিথিলা) এবং উড়িষ্যা’কে বুঝিয়েছেন। এই বিবরণ খুব স্পষ্ট নয়। কারণ হর্ষবর্ধন তাঁর একচল্লিশ বছর রাজত্বকালের অধিকাংশটাই যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু হিউয়েন সাঙ মাত্র ছয় বছর যুদ্ধের কথা লিখেছেন। যাইহোক, শশাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযানের পর হর্ষ সৌরাষ্ট্রের বলভীর মৈত্রকদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। বলভীরাজ দ্বিতীয় ধ্রুবসেন হর্ষের কাছে পরাজিত হন। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই ধ্রুবসেন ব্রোচ অঞ্চলের শাসক গুর্জর অধিপতি দ্বিতীয় দন্দ’র সহযোগিতায় বলভী পুনরুদ্ধারের উদোগ নেন। শেষ পর্যন্ত হর্ষবর্ধন নিজ কন্যার সাথে ধ্রুবসেনের বিবাহ দেন। এই বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ধ্রুবসেন স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার সুযোগ পান। এইভাবে বলভী এবং তার অধীনস্থ এলাকাসমূহ, যেমন— আনন্দুপর, কচ্ছ ও দক্ষিণ কাথিয়াবাড় হর্ষবর্ধনের রাজনৈতিক প্রভাবাধীনে স্থাপিত হয়।
নেপালের সাথে হর্ষবর্ধনের সম্পর্কের বিষয়টিও স্পষ্ট নয়। অধ্যাপক রাধাগোবিন্দ বসাক, বি. ইন্দ্রজী প্রমুখ মনে করেন, নেপাল পর্যন্ত হর্ষের সাম্রাজ্য প্রসারিত ছিল। এই মতের সমর্থনে দুটি প্রধান যুক্তি হল –(১) বাণভট্ট তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, হর্ষ হিমালয়-সংলগ্ন একটি রাজ্য জয় করেছিলেন। (২) নেপালের মহারাজা অংশুবর্মন তাঁর লেখগুলিতে হর্ষাব্দের ভিত্তিতে বর্ষ উল্লেখ করেছেন। যেমন ৩০-তম ৩২-তম, ৩৪-তম বা ৪৯-তম বর্ষে খোদিত লেখগুলির বর্ষ গণনা করা হয়েছে ৬০৬ খ্রিস্টাব্দের হর্যাব্দের ভিত্তিতে। তাই এঁরা মনে করেন যে, হর্ষের অনুগত শাসক হিসেবেই অংশুবর্মন এই কাজ করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন।
এই অভিমত যথেষ্ট তথ্যনিষ্ঠ নয়। এই মতের বিরোধিতা করেছেন ড. সিলভা লেভি (Sylvianes Levi)। তাঁর মতে, ওই সময় নেপাল তিব্বতের অধীনে ছিল, হর্ষের অধীনে নয়। তিব্বতীয় উপাখ্যানের ভিত্তিতে ড. লেভি এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, তিব্বতের রাজা অং সান (Srong Tsan) এবং তাঁর পুত্র অং সান গাম্পো খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে তিব্বত শাসন করেছিলেন। অং সান নেপালের মধ্যে দিয়ে অভিযান চালনার পর ওই অঞ্চলও দখল করে নেন এবং তাঁর পুত্র নেপালের রাজকন্যাকে বিবাহ করে ওই অঞ্চলে নিজ অধিকার সুদৃঢ় করেছিলেন। চৈনিক উপাদান থেকেও সিলভা লেভি এই সিদ্ধান্ত প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। হিউয়েন সাঙ-এর বর্ণনা মতে, তাঁর বৈশালী পরিভ্রমণের (৬৩৭ খ্রিঃ) প্রাক্কালে অংশুবর্মন মারা গিয়েছিলেন। তখন নেপাল শাসন করছিলেন লিচ্ছবী শাসক উদয়দেব। তিব্বতের অনুমোদনক্রমে লিচ্ছবীরা নেপালে কর্মরত ছিলেন বলে মনে করা হয়। সুতরাং নেপালের ওপর হর্ষবর্ধনের সার্বভৌম অধিকার ছিল-এ মত গ্রহণযোগ্য নয়।
কথিত আছে, হর্ষবর্ধন সিন্ধু ও কাশ্মীরে অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। তবে এ বিষয়ে সঠিক তথ্যের অভাবে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া হিউয়েন সাঙ স্বয়ং সিন্ধুকে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী রাজ্য বলে বর্ণনা করেছেন। অন্যদিকে হর্ষচরিত গ্রন্থে বাণভট্ট ‘তুষারশৈল’ অভিযানের কথা বলেছেন। ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় ‘তুষারশৈল’ বলতে কাশ্মীরকে সনাক্ত করেছেন। কিন্তু কাশ্মীরের স্বাধীন অস্তিত্বের আভাস চৈনিক পর্যটকের বিবরণ থেকে পাওয়া যায়। ড. নগেন্দ্রনাথ ঘোষ ‘তুষারশৈল’কে উত্তরপ্রদেশের গাহড়ওয়াল ও কুমায়ুনের পর্বতশৃঙ্গকে শনাক্ত করেছেন। উল্লেখ্য যে, এই সকল পর্বতশৃঙ্গ প্রায়শই বরফাবৃত থাকত এবং এই অঞ্চলের ওপর হর্ষের আধিপত্য স্থাপিত হয়েছিল।
চৈনিক বিবরণ থেকে জানা যায় যে, দক্ষিণ ভারতের বাতাপির চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সাথে হর্ষবর্ধনের সংঘর্ষ হয়েছিল। হর্ষবর্ধনের পিতা প্রভাকরবর্ধনের আমল থেকেই মালব, লতা (গুজরাট) ও গুর্জরদের সাথে থানেশ্বরের রাজনৈতিক শত্রুতা ছিল। হর্ষবর্ধন উত্তরাধিকারসূত্রে এদের সাথে ক্ষমতার সংঘাতে নেমেছিলেন। পশ্চিম ভারতে হর্ষবর্ধনের সামরিক অভিযানের ঘটনায় এই রাজ্যগুলি সম্ভাব্য আক্রমণের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে বাতাপির চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সাথে আনুগত্যপূর্ণ মিত্রতা গড়ে তোলে। ফলে চালুক্যবংশের সাথে হর্ষের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়। হর্ষবর্ধন স্বয়ং বিশাল বাহিনী নিয়ে পুলকেশীর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। তবে যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে হিউয়েন সাঙ এবং বাণভট্ট নীরব থেকেছেন। সম্ভবত এই সংঘর্ষে হর্ষবর্ধন পরাজিত হয়েছিলেন। চালুক্যরাজ পুলকেশীর আইহোল প্রশস্তি’র বিবরণ থেকে এই তথ্য সমর্থিত হয়। এই প্রশস্তির ২৩-তম স্তরকে বলা হয়েছে “…হর্ষের হর্ষ চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে, ভূতলে ধরাশায়ী হয়েছে তাঁর সুদক্ষ যুদ্ধ হস্তীবাহিনী।” নর্মদা নদীর বেশ কিছুটা উত্তরে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এখানে পরাজয়ের পরে হর্ষের সেনাবাহিনী এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে, তিনি আরও দক্ষিণদিকে অগ্রসর হতে সাহস করেননি। ‘আইহোল প্রশস্তি’ থেকে স্পষ্ট হয় যে, নর্মদার খানিকটা উত্তরেই হর্ষকে থামতে হয়েছিল। কারণ এর পরেই ছিল দ্বিতীয় পুলকেশীর অনুগত সামন্ত রাজ্যসমূহ।
হর্ষের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি : ‘সকলোত্তরপথনাথ’
হর্ষবর্ধনের সামরিক অভিযানগুলির সাফল্য ও ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর সাম্রাজ্যের পরিধির একটা আভাস পাওয়া যায়। হিউয়েন সাঙ ও বাণভট্ট তাঁদের রচনায় হর্ষবর্ধনের রাজ্যবিস্তার প্রসঙ্গে বহুক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ বা অস্পষ্ট বিবরণ দিয়েছেন। এঁদের রচনার ওপর নির্ভর করে ঐতিহাসিক কে. এম. পানিক্কর, আর. এস. ত্রিপাঠী, ভিনসেন্ট স্মিথ প্রমুখ হর্ষবর্ধনকে একজন ‘অপরাজেয় যোদ্ধা ও সাম্রাজ্যের সংগঠক’ বলে বর্ণনা করেছেন। রাধাকুমুদ মুখার্জী তাঁর Harsha শীর্ষক গ্রন্থে তাঁকে ‘সমগ্র উত্তর ভারতে সার্বভৌম অধিপতি’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “With all reservations it can not be doubted that Harsha achieved the proud of being the paramount sovereign of the whole of Northern India.” এই বিতর্কে নতুন মাত্রা দিয়েছে চালুক্যবংশের কিছু শিলালিপি। দ্বিতীয় পুলকেশীর উত্তরাধিকারী প্রথম বিক্রমাদিত্য ও দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের আমলে খোদিত নিরপান, কর্নল ও টোগেরছেদু প্রভৃতি শিলালেখতে পুষ্যভূতিবংশীয় হর্ষবর্ধনকে ‘সকলোত্তরপথনাথ’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই লেখমালার ভিত্তিতে হর্যকে ‘সমগ্র উত্তর ভারতের অধিপতি’ বলে গ্রহণ করা হয়েছে। এই সকল উপাদানের ভিত্তিতে নির্ভর করে পানিক্কর (K. M. Panikkar) তাঁর ‘সার্ভে অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ গ্রন্থে বলেছেন, “বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরের সকল দেশ, নেপাল ও কাশ্মীর হর্ষের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল।” একইভাবে এটিং হাউজেনের মতে, “কামরুপ থেকে কাশ্মীর, হিমালয় থেকে বিন্ধ্য পর্বত ছিল হর্যের রাজ্যসীমা।”
ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার এই মতের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে, হর্যের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য হিউয়েন সাঙ কিংবা হর্ষের সভাকবি বাণভট্টের বিবরণকে এককভাবে ইতিহাসসম্মত মনে করা সঠিক নয়। হর্ষ সম্পর্কে এঁদের বিবরণে অতিকথন থাকা অস্বাভাবিক নয়। উপরন্তু অপরাপর তথ্যাদি বিশ্লেষণ করলে উল্লিখিত মন্তব্যের সত্যতা সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি হয়। যেমন, হিউয়েন সাঙ, বাণভট্ট কেউই হর্ষকে সকল উত্তরাপথের অধিপতি জাতীয় কোনো অভিধা দেননি। হর্যের নিজস্ব লেখমালা যেমন, মধুবন ও বাঁশঘেরা তাম্রশাসন কিংবা সোনপাত তাম্রলিপি কোথাও তিনি নিজেকে উত্তরাপথপতি বলে দাবি করেননি। আবার দ্বিতীয় পুলকেশীর ‘আইহোল লিপি’তে বলা হয়েছে “…হর্ষের আনন্দ চূর্ণ হয়েছে, তাঁর হস্তিবাহিনী ভূপতিত হয়েছে।” অর্থাৎ হর্ষ এই যুদ্ধে অবশ্যই বিজয়ী হতে পারেননি। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় যে, চালুক্য পুলকেশীর বংশধররা হর্ষকে ‘সকল উত্তরাপথনাথ’ বলে সম্মানিত করেছিলেন কেন? এর উত্তরে আধুনিক ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, এই আখ্যা দিয়ে চালুক্য রাজারা তাঁদের পূর্বসূরি দ্বিতীয় পুলকেশী তথা চালুক্যবংশের গৌরববৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ ‘সকলোত্তরপথনাথ’ হর্ষকে পরাজিত করে যোদ্ধা দ্বিতীয় পুলকেশীর সামরিক আধিপত্যের ধারণাকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছিল।
হর্ষবর্ধনকে ‘সকলোত্তরপথনাথ’ বলা সঠিক কিনা এই বিতর্কে কোন্ কোন্ এলাকা তাঁর দখলে ছিল না তা জানা যেমন জরুরি, তেমনি কোন্ কোন্ রাজ্য তিনি প্রকৃত জয় করেছিলেন তাও জানা প্রয়োজন। যেমন—(১) উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি থানেশ্বর বা পূর্ব পাঞ্জাব পেয়েছিলেন। (২) ভগিনী রাজ্যশ্রীর অভিভাবক হিসেবে তিনি কনৌজ বা উত্তরপ্রদেশের দোয়াব ও তার সংলগ্ন অঞ্চল পান। (৩) শশাঙ্কের মৃত্যুর পর হর্ষ পশ্চিমবাংলা, উড়িষ্যা, কঙ্গোদ (গঞ্জাম) ও মগধ (বিহার) দখল করেছিলেন। অর্থাৎ হর্ষের রাজ্যসীমা ছিল উত্তরে হিমালয় থেকে নর্মদা নদীর কিছুটা উত্তরভাগ এবং পূর্বে সমতট বা পশ্চিমবাংলা থেকে পশ্চিমে পাঞ্জাবের কিয়দংশ। কাশ্মীর, সিন্ধুদেশ এবং নেপাল নিঃসন্দেহে হর্ষের রাজ্যসীমার বাইরে ছিল। সুতরাং আক্ষরিক অর্থে হর্ষকে সকল উত্তর ভারতের অধীশ্বর বলা চলে না। তবে এ কারণে তাঁর কৃতিত্বকে ছোটো করে দেখা যথার্থ নয়। কারণ, গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের যুগে উত্তর ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলকে কনৌজের শাসনাধীনে স্থাপিত করে তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। গুপ্তবংশের পতনের পরে উত্তর ভারতের সর্বত্র যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দানা বেঁধেছিল, হর্ষবর্ধন সাময়িকভাবে হলেও তার বিস্তীর্ণ এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা প্রবর্তন করে ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করেছেন।
অধ্যাপক মজুমদার যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, হর্ষের বিপুল রাজনৈতিক খ্যাতির পেছনে অবশ্যই তাঁর ব্যক্তিগত গুণাবলি ও সাফল্য সক্রিয় ছিল ; কিন্তু তার চেয়েও বেশি সক্রিয় ছিল বাণভট্ট ও হিউয়েন সাঙ-এর মতো সভাকবি ও পর্যটকের বিবরণ। ভি. স্মিথ প্রমুখ ইতিহাসবিদ বিনা বিশ্লেষণে চালুক্য লেখগুলিকে আক্ষরিক অর্থে সঠিক বলে গ্রহণ করায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। তিনি হর্ষকে ‘প্রাচীন ভারতের শেষ হিন্দু সম্রাট’ বলে মন্তব্য করেছেন, যা নিশ্চিতভাবেই অতিশয়োক্তি দোষে দুষ্ট। কারণ, চালুক্যরাজ বিনয়াদিত্যর লেখতে আরও একজন ‘সকলোত্তরপথনাথ’-এর উল্লেখ আছে। রামশংকর ত্রিপাঠীর মতে, ইনি ছিলেন সম্ভবত পরবর্তী গুপ্তদের জনৈক বংশধর। তাই এমন একটি অভিধা এককভাবে প্রকৃত সত্য তুলে ধরে না। আবার হর্ষের পরে গুর্জর-প্রতিহার বা পালবংশের নেতৃত্বে হর্ষের সাম্রাজ্যের থেকে বড়ো এবং স্থায়ী সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। তাই হর্ষকে শেষ হিন্দু সম্রাট বলা সঠিক নয়।
এইভাবে নানাদিক বিচার করে অধ্যাপক মজুমদার বলেছেন যে, হর্ষবর্ধন-সম্পর্কিত উপাদানগুলিকে ঐতিহাসিক বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত। হর্যের অনুরাগী ও পৃষ্ঠপোষকতাধন্য বাণভট্ট এবং হিউয়েন সাঙ হর্যের জীবন ও কৃতিত্বের যে ছবি তুলেছেন, তা প্রকৃত ইতিহাস নয়। তিনি যথার্থই বলেছেন, “হর্ষবর্ধনের ঘটনা থেকে আমাদের এমন শিক্ষা হয় যে, নায়ক যেমন তাঁর কৃতিত্ব দ্বারা ইতিহাস সৃষ্টি করেন, তেমনি ইতিহাসও অনেক সময় নায়ক তৈরি করে দেয়” (“The case of Harshavardhana teaches us that while the heroes make history, sometimes history also make heroes.”)
হর্ষবর্ধনের শাসনব্যবস্থা :
সাম্রাজ্যের সংগঠক হিসেবে হর্ষবর্ধনের কৃতিত্ব কম নয়। সমগ্র উত্তর ভারতের তিনি অধিপতি ছিলেন কিনা—সে প্রশ্নে বিতর্ক থাকলেও, নর্মদা নদীর উত্তরে তাঁর অধিকৃত সাম্রাজ্যের পরিধি খুব কম ছিল না। গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভাঙনের পর উত্তর ভারতে একই শাসনব্যবস্থার অধীনে এত বৃহৎ সাম্রাজ্য আর গড়ে ওঠেনি। যাইহোক, হর্ষ সচেতন ছিলেন যে, সুবিন্যস্ত এবং সুনিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা ছাড়া এই সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে না। প্রাথমিকভাবে তিনি মৌর্য শাসনকাঠামোর অনুসরণে নিজের শাসনসংগঠন রূপায়ণের প্রয়াস নেন। তবে মৌর্যযুগের অনুরূপ কেন্দ্রীকরণ নীতি থেকে সরে এসে বাস্তব পরিস্থিতি অনুসারে তিনি গুপ্তযুগের মতো বিকেন্দ্রীকৃত শাসনকাঠামো প্রণয়ন করেন। মৌর্যকাঠামো এবং গুপ্তধারার সমন্বয়ে গঠিত তাঁর শাসনসংগঠনের কার্যকারিতা ছিল প্রশ্নাতীত।
ভারতবর্ষের প্রথাগত রাজতন্ত্রের ধারা অনুসারে হর্ষবর্ধন ছিলেন সমগ্র শাসনক্ষমতার কেন্দ্রীয় উৎস। সামরিক ও বেসামরিক উভয় বিষয়েই মহারাজা হর্যের সিদ্ধান্ত ছিল চূড়ান্ত। সমস্ত স্তরের কর্মী নিয়োগ ও পদচ্যুতি ছিল হর্ষের ইচ্ছাধীন। তবে হর্ষবর্ধন স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। উপরন্তু হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ থেকে বোঝা যায় যে, তিনি প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন। চৈনিক মতে, তিনি ছিলেন পরিশ্রমী ও প্রজাদরদী। হিউয়েন সাঙ-এর মতে, হর্ষের শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ছিল প্রজাদের সাথে রাজার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ সম্পর্কে সচেতন উপলব্ধি। এজন্য তিনি নিয়মিত রাজ্য পরিদর্শনে বের হতেন। প্রজাদের অভাব-অভিযোগ শুনতেন এবং প্রতিবিধানের উদ্যোগ নিতেন। তিনি নিজেকে ‘রাজকীয় পরিদর্শক’ বলেই গণ্য করতেন। হিউয়েন সাঙ লিখেছেন যে, হর্ষ একটি দিনকে তিনভাগে বিভক্ত করে রাজকর্তব্য সম্পাদন করতেন। তিনভাগের একভাগ থাকত রাজকীয় প্রশাসনের জন্য, এক অংশ ব্যয় করতেন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কাজে এবং অবশিষ্ট সময় প্রজাকল্যাণের কাজে ব্যয় করতেন।
শাসনকার্য পরিচালনার কাজে মন্ত্রিপরিষদ ও বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মচারী হর্ষবর্ধনকে সাহায্য করতেন। হর্ষের সভাকবি বাণভট্টের রচনা এবং বিভিন্ন শিলালেখ থেকে সমকালীন রাজকর্মচারীদের নাম ও কাজের বিবরণ পাওয়া যায়। অবশ্য সূত্র দুটির মধ্যে বিশেষ মিল নেই। হর্ষচরিতে উল্লিখিত মন্ত্রিপরিষদের দুজন মুখ্য সদস্য ছিলেন, যথা—’মহাসন্ধিবিগ্রহাধিকৃত’ এবং ‘মহাবলাধিকৃত’। প্রথমজন ছিলেন যুদ্ধ ও শাস্তির দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং দ্বিতীয়জন ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান। এরা ছাড়াও কিছু উচ্চপদস্থ ব্যক্তি মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হিসেবে বিবেচিত হতেন। হর্ষবর্ধন মন্ত্রিসভার সাথে ধৈর্য সহকারে মতবিনিময় করতেন এবং নিজের বিচারবিবেচনা অনুযায়ী পরামর্শ গ্রহণ বা পরিমার্জন করতেন। মন্ত্রিসভার পাশাপাশি একদল সুদক্ষ আমলা প্রাত্যহিক কার্যপরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। এঁদের অন্যতম ছিলেন জেলার প্রশাসনিক প্রধান বিষয়পতি, বিষয়পতির সহকারী ছিলেন আয়ুক্তক। মীমাংসক এবং মহাপ্রতিহার ছিলেন যথাক্রমে বিচারবিভাগ ও প্রসাদের তত্ত্বাবধায়ক। রাজস্ব আদায়ের কাজ পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলা ছিলেন ভোগিকা বা ভোগপতি। হর্ষচরিতে অমাত্য-রাজন নামক কর্মচারীর উল্লেখ আছে। কাওয়েল ও টমাসের (E. B. Cowell and F. W. Thomas) মতে, এঁরা ছিলেন রাজকীয় পরামর্শদাতার পর্যায়ভুক্ত কর্মচারী। রামশরণ শর্মার মতে, হর্যের আমলে সামন্তশ্রেণীর মধ্যে ‘অমাত্য’ উপাধি গ্রহণের রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। এ ছাড়া ডাক চলাচল, সরকারি নথিপত্র রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি কাজের জন্য বিভিন্ন কর্মচারী ছিলেন। হর্ষের শাসনব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল সরকারের প্রাত্যহিক কাজকর্মের নথিভুক্তকরণ। দুর্ভাগ্যবশত সেগুলি অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যথায় সমকালীন ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে সেগুলি সাহায্য করত।
হর্ষবর্ধনের বাঁশঘেরা ও মধুবন তাম্রশাসন থেকেও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু পদাধিকারী হলেন উপরিক, মহারাজ, মহাসামন্ত, মহাপ্রমাতার ইত্যাদি। সামন্ত বা মহাসামন্ত উপাধিগুলি ভিন্ন ভিন্ন নামে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন—মহাক্ষপটলা ধিকরণাধিকৃত-সামন্ত-মহারাজ, মহাক্ষপটলিক-সামন্ত মহারাজ, মহাপ্রমাতার-মহাসামন্ত ইত্যাদি। সামত্ত ও সামন্ত-মহারাজ পদাধিকারীগণ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসক হিসেবে হর্ষকে সাহায্য করতেন। ‘হর্ষচরিতে’ স্বীকার করা হয়েছে যে, সামন্তরা তখন বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা পেতেন। অবশ্য সে কারণে মহারাজা শ্রীহর্ষের স্বাধীন কর্তৃত্ব আদৌ সংকুচিত হত না। মহাক্ষপটলাধিকরণ অর্থাৎ কেন্দ্রীয় হিসাবরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন সামন্ত-মহারাজরা। মহাসামন্তরা সম্ভবত করপ্রদানকারী আঞ্চলিক শাসক ছিলেন এবং এঁরা কিছুটা স্বশাসনের অধিকার ভোগ করতেন। দস্যু-তস্করদের দমন করার কাজ করতেন দুঃসাধ্যসাধনিক নামক কর্মীরা। বর্তমানের পুলিশ-বিভাগের সমগোত্রীয় ছিলেন এঁরা। মহাপ্রমাতারা সম্ভবত ছিলেন বিচারবিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মী। এঁদের সহকারীরা প্রমাতা নামে পরিচিত ছিলেন। তবে মহাপ্রমাতার-মহাসামন্ত নামক কর্মচারী সম্ভবত তাম্রশাসনগুলি প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। কুমার-মাত্যরা ছিলেন শিক্ষানবীশ মন্ত্রী ও কর্মচারী। এঁরা সম্রাটের খুব বিশ্বাসভাজন ছিলেন। এ ছাড়াও পুষ্টকৃত, করণিক প্রভৃতি সহকারী কর্মীবৃন্দের অস্তিত্ব ছিল। হর্ষ তাঁর কর্মচারীদের মূলত বেতন হিসেবে জমি বন্দোবস্ত দিতেন। নিম্নস্তরে কর্মীদের মধ্যে নগদ অর্থে বেতন দানের রেওয়াজ ছিল। সর্বোপরি হর্ষের ছোটো-বড়ো পদাধিকারীর নামের সাথে সামন্ত, মহাসামন্ত বা মহারাজা ইত্যাদি অভিধা যুক্ত থাকার কারণ প্রসঙ্গে ড. ইউ. এন. ঘোষাল মনে করেন যে, হর্ষ তাঁর শাসন-পরিচালনার কাজে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সামন্তশ্রেণীকে ব্যবহার করেছিলেন।
হর্ষের সাম্রাজ্যের পরিধি বিশাল না-হলেও তিনি বিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা অনুসরণ করেছিলেন। তাঁর রাজ্য কয়েকটি ছোটো ছোটো প্রদেশে বিভক্ত ছিল। এগুলি ‘ভুক্তি’ নামে পরিচিত হত। ভুক্তিগুলি ‘বিষয়’ বা জেলায় বিভক্ত ছিল। ভুক্তির প্রধান পরিচালক রাজস্থানিক বা উপরিক নামে অভিহিত হতেন। বিষয় বা জেলার শাসনকর্তাকে বলা হত বিষয়পতি। হর্ষের শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন একক ছিল ‘গ্রাম’। হর্যের তাম্রশাসক এবং বাণভট্টের রচনা থেকে স্থানীয় প্রশাসনে যুক্ত কর্মচারীদের নামোল্লেখ পাওয়া যায়। এঁদের অন্যতম ছিলেন ভোগপতি, আয়ুক্তক, গ্রামাক্ষপটলিক, করণিক প্রভৃতি। ‘ভোগপতি’ ছিলেন সম্ভবত ভূস্বামী শ্রেণীর প্রতিনিধি এবং জেলা-প্রশাসনের সাথে যুক্ত ‘গ্রামাক্ষপটলিক’ ছিলেন গ্রাম-প্রশাসনের আয়-ব্যয়ের হিসাবরক্ষক। করণিক শ্রেণী বিভিন্ন বিভাগের দপ্তর পরিচালনার সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মধুবন তাম্রশাসনে কুমারামাত্য নামক পদস্থ কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে গুপ্ত আমলের একই নামধারী কর্মী এবং মধুবনে উল্লিখিত কর্মী সম্ভবত একই ছিল না। পূর্বে সামন্ততান্ত্রিক উপাধি হিসেবে কুমারামাত্য ব্যবহৃত হত। রামশরণ শর্মার মতে, ষষ্ঠ শতকের পরবর্তীকালে এই কর্মীগোষ্ঠী মূলত গ্রাম-শাসনের সাথে যুক্ত ছিলেন।
সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষা এবং রাজ্যজয়ের প্রয়োজনে হর্ষবর্ধন একটি বিশাল ও শৃঙ্খলাপরায়ণ সামরিক বাহিনী সংগঠিত করেন। হিউয়েন সাঙ হর্ষের সামরিক শক্তির বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। প্রথমদিকে হর্ষবর্ধন ৫ হাজার হস্তী, ২ হাজার অশ্বারোহী এবং ৫ হাজার প্রাতিক বাহিনী নিয়ে রাজ্যজয়ের কাজ শুরু করেন। কালক্রমে হর্ষ সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেন। শেষদিকে তিনি প্রায় ৬০ হাজার হস্তী এবং ১ লক্ষ অশ্বারোহী সেনার অধিকারী হয়েছিলেন। এই বর্ণনা কিছুটা অতিরঞ্জিত। কারণ, প্রায় সারা ভারতে প্রসারিত মৌর্য সাম্রাজ্যের চরম উন্নতির কালে রণহস্তী ও অশ্বারোহী সেনার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৯ হাজার ও ৩০ হাজার মাত্র। যাইহোক, হর্ষ যে একটি বিশালাকার সেনা সংগঠনের অধিকারী ছিলেন—এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই বিভ্রান্তির কারণ সম্ভবত ভারতের সমকালীন রাজনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে হিউয়েন সাঙ-এর সম্যক ধারণার অভাব। সেকালে সামন্ত ও সামন্ত রাজারা যুদ্ধকালে সম্রাটকে সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করতেন। দ্বিতীয় পুলকেশীর বিরুদ্ধে অভিযানের সময় হর্ষবর্ধন যে বিশাল সামন্তবাহিনী দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছিলেন, তা ‘আইহোল প্রশস্তি’তে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত, হিউয়েন সাঙ হর্ষের ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী ও সামস্তবাহিনীকে একীভূত করেই হর্ষের সেনাসংখ্যা নির্দিষ্ট করেছিলেন।
একটি বিশাল রাজ্য ও সেনাবাহিনীর অবাধ অগ্রগতি নির্ভর করে সকল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর। ‘হর্ষচরিত’, ‘চৈনিক বিবরণ’ এবং হর্ষের ‘তাম্রশাসনগুলি’ থেকে হর্ষের রাজস্বব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। রাজকোষের আয়ের প্রধান সূত্র ছিল ভাগ, হিরণ্য, বলি ইত্যাদি কর। ভূমিরাজস্বকে ভাগ বলা হত। উৎপাদিত শস্যে এই কর প্রদান করতে হত। অন্যদিকে কৃষক ও বণিকেরা নগদ অর্থে যে কর প্রদান করত, তাকে বলা হত হিরণ্য। বলি নামক করের অন্তর্ভুক্ত কোন্ কোন্ পণ্য বা বিষয় ছিল, সে বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। এ ছাড়া অন্যান্য কিছু করের উল্লেখ সমকালীন তথ্যে পাওয়া যায়। যেমন, বণিকেরা বাণিজ্য-পণ্য চলাচলের জন্য স্বল্প পরিািণ শুষ্ক প্রদান করত। বাজারে পণ্য ক্রয়বিক্রয়ের জন্যও কিছু কর দিতে হত। এ ছাড়া খনি থেকে প্রাপ্য আয়, শত্রুর সম্পত্তি লাভজাত আয়, রাজকীয় জরিমানা ইত্যাদি খাতেও রাজকোষে অর্থাগম ঘটত। সাধারণভাবে উৎপাদিত পণ্যের এক-ষষ্ঠাংশ রাজস্ব বাবদ দিতে হত। হিউয়েন সাঙ-এর মতে, হর্ষের রাজত্বে করভার প্রজাদের কাছে অসহনীয় ছিল না।
হর্ষবর্ধন রাজ্যের আদায়ীকৃত বার্ষিক রাজস্ব চারটি নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করতেন। পঁচিশ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ হত সরকারি কাজকর্ম পরিচালনার জন্য। পঁচিশ শতাংশ ব্যয়িত হত সরকারি কর্মচারীদের বেতন দানের জন্য। তৃতীয় ভাগটি নির্দিষ্ট ছিল পণ্ডিত, গবেষক তথা শিল্প-সংস্কৃতির উৎসাহবৃদ্ধির কাজে। অবশিষ্ট পঁচিশ শতাংশ বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে তাদের মহৎ কার্যাবলির পুরস্কার হিসেবে দান করা হত। রাজস্ব আরোপ এবং সরকারি অর্থব্যয়ের কাজ হর্ষ স্বয়ং তত্ত্বাবধান করতেন।
হর্ষবর্ধন একটি সৎ ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে যত্নবান ছিলেন। বিচারবিভাগের সর্বোচ্চে ছিলেন হর্ষ স্বয়ং। ফৌজদারি আইনবিধি ছিল যথেষ্ট কঠোর। আইনভঙ্গকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। রাজা ও রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান ছিল। আনুগত্যহীনতা, বিশ্বাসভঙ্গ ইত্যাদি অপরাধের ক্ষেত্র অপরাধীর হাত, পা, নাক, কান ইত্যাদি অঙ্গচ্ছেদ করে শাস্তি দেওয়া হত। অপরাধের গুরুত্ব নির্ধারণের জন্য অগ্নি, জল, বিষ প্রভৃতির সাহায্যে প্রাচীন বিচার প্রণালী (তু-অগ্নিপরীক্ষা) অনুসরণ করা হত। ছোটোখাটো অপরাধমূলক কাজের জন্য আর্থিক জরিমানার ব্যবস্থা চালু ছিল। বিচারবিভাগের সাথে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারীদের মধ্যে দুঃসাধ্যসাধনিক ও প্রমাতা’র নাম উল্লেখযোগ্য। এঁরা যথাক্রমে দস্যু-তন্ত্ররদের গ্রেপ্তার করা এবং বিচারবিভাগের সামনে উপস্থিত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। শাস্তির কঠোরতা থেকে অনুমান করা যায় যে, তখন সমাজে অপরাধমূলক কাজের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভাঙনের পরবর্তীকালে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা পরিণামে সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিয়েছিল বলে অনুমিত হয়। অবশ্য হিউয়েন সাঙ সমকালে মানুষের উন্নত নৈতিকবোধ ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, সাধারণ মানুষ অন্যায়ভাবে কোনো কিছুই নিতেন না। সৎপথে উপার্জনের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা ছিল। পরলোকে সুস্থজীবন লাভের বাসনা থেকে মানুষ ইহলোকে ন্যায় কাজে আগ্রহী ছিলেন (“They (people) will not take anything wrongly and they yield more than fairness requires. They fear the retribution for sins in other lives, and make light of what conduct produces in this life.”)\ তবে তাঁর এই বর্ণনা ও বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে মিল ছিল না। হিউয়েন সাঙ নিজেই তস্করদের হাতে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছিলেন। যাইহোক, আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে হর্ষের আন্তরিকতার অভাব ছিল না।
সমসাময়িক তথ্যাদি থেকে হর্ষের আমলের উজ্জ্বল সামাজিক চিত্র পাওয়া যায়। হিউয়েন সাঙ-এর মতে, তৎকালীন সমাজ জাতি বা বর্ণব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়েছিল। চারটি প্রধান বর্ণ ছিল—ব্রায়ণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। ব্রাহ্মণদের সামাজিক মর্যাদা ছিল সর্বোচ্চে। ক্ষত্রিয়রা সৎ ও সাহসী হিসেবে মানুষের আস্থা পেতেন। বৈশ্যদের মূল জীবিকা ছিল বাণিজ্য এবং শূদ্ররা মূলত কৃষিকাজসহ শ্রমজীবী মানুষ হিসেবে বসবাস করতেন। তবে বর্ণব্যবস্থার কঠোরতা তখন অনেকটাই শিথিল হয়েছিল। শূদ্রদের সামাজিক অবস্থান অনেকটা ঊর্ধ্বমুখী ছিল। পারস্পরিক মেলামেশা এবং বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে সমাজ অনেকটাই উদার ছিল। তবে সমাজে নারীর মর্যাদা ও অধিকার কিছুটা নিম্নগামী ছিল। পর্দা-প্রথার কঠোরতা না থাকলেও, সতীদাহ প্রথার রেওয়াজ ছিল। বাল্যবিবাহ-প্রথাও জনপ্রিয় ছিল। পুষ্যভৃতি রাজকন্যা রাজশ্রীর বিবাহ বয়ঃসন্ধিকালের আগেই সম্পন্ন হয়েছিল। কন্যাসন্তানের জন্ম অনভিপ্রেত ছিল। পক্ষান্তরে পুত্রসন্তান জন্ম হলে সামাজিক উৎসব পালন করা হত। পুত্রসন্তান লাভের কামনায় মেয়েরা নানাপ্রকার ব্রত উদযাপন করতেন।
হর্যের রাজত্বকালে সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা ছিল মোটামুটিভাবে সহনীয়। মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। একইসঙ্গে বাণিজ্য ও শিল্পেও অগ্রগতি ঘটেছিল। কৃষিক্ষেত্রে জলসেচের সুবন্দোবস্ত ছিল। পশুচারণের জন্য বিশাল ক্ষেত্র সংরক্ষিত ছিল। কৃষকদের ওপর রাজস্বের হার ছিল খুবই সহনশীল, মাত্র ছয় শতাংশ। কলকারখানার মধ্যে জনপ্রিয় ছিল বস্ত্রবয়ন, সুতো রঙিন করা, সোনার অলংকার নির্মাণ ইত্যাদি। এই সময় কয়েকটি নতুন শহরের পত্তন ঘটে। সাধারণভাবে বিনিময়ের মাধ্যমে বাণিজ্য চলত। তবে সোনা, রূপার কিছু মুদ্রা চালু ছিল বলে জানা যায়। বড়ো বড়ো শিল্পক্ষেত্রে বাণিজ্য সংঘ বা গিল্ড-এর অস্তিত্ব ছিল।
হর্ষবর্ধনের ধর্ম :
হর্ষবর্ধনের পূর্বপুরুষরা ছিলেন সূর্য ও শিবের উপাসক। হর্ষবর্ধন প্রথমদিকে শৈব ছিলেন। প্রায় পঁচিশ বছর পর্যন্ত তিনি শিবের উপাসক ছিলেন। সম্ভবত পরবর্তীকালে হিউয়েন সাঙের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রতি তিনি অনুরক্ত ছিলেন। বৌদ্ধধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য তিনি কাশ্মীর থেকে বুদ্ধের দাঁত সংগ্রহ করে কনৌজের সংঘারামে সংরক্ষিত করেন। একাধিক সংঘারাম প্রতিষ্ঠা করে এবং জীবহিংসা নিরোধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করে তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তাঁর আমলে কনৌজ অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তবে বৌদ্ধধর্মের প্রতি অনুরক্ত হলেও, হর্ষ ধর্ম বিষয়ে উদারনীতি অনুসরণ করতেন। শিব ও সূর্যের (আদিত্য) প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা পূর্ববৎ বহাল ছিল। হিউয়েন সাঙ-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য হর্ষ কনৌজে এক বৌদ্ধ সম্মেলন আহ্বান করেন। বিভিন্ন দেশের কয়েক হাজার বৌদ্ধ পণ্ডিত এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া বহু অনুগত সামন্ত ও মিত্র রাজাও এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। কনৌজ সম্মেলন চলেছিল প্রায় চার মাস। হিউয়েন সাঙ ছিলেন সম্মেলনের সভাপতি। এখানে মহাযান বৌদ্ধধর্মের ওপর আলোচনা হয় এবং বুদ্ধের স্বর্ণমূর্তি শোভাযাত্রা সহকারে ঘুরিয়ে পূজা করা হয়।
কনৌজে বুদ্ধ, মহাযানবাদ এবং সংঘের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শিত হলেও, প্রয়াণের পঞ্চবার্ষিকী মেলায় হর্ষ ধর্মসমন্বয়ের আদর্শ তুলে ধরেন। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আয়োজিত এই মেলা ব্রাক্ষ্মণ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বৌদ্ধভিক্ষু, সাধারণ মানুষসহ অসংখ্য মানুষের সমাবেশ ঘটত। প্রয়াগ সম্মেলনের প্রথম দিন বুদ্ধ, দ্বিতীয় দিন আদিত্য (সূর্য) এবং তৃতীয় দিন শিবের উপাসনা করা হত। চতুর্থ দিনে দশ হাজার বৌদ্ধভিক্ষুকে উদার হস্তে হর্ষ দান করতেন। পরবর্তী কুড়ি দিন ব্রাহ্মণদের দান করা হত। পরবর্তী দশ দিন জৈন ও অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে দান বিতরণ করা হত। হর্ষবর্ধন নিজের সকল অলংকার, পরিধেয় রাজবস্তুটিও দান করে সাধারণ পোশাক পরে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করতেন। এই সম্মেলন মহামোক্ষ পরিষদ নামে খ্যাত।
হর্ষবর্ধনের শিক্ষা :
হর্ষ স্বয়ং ছিলেন সুপণ্ডিত ও বিদ্যোৎসাহী। হর্ষের বিদ্যাশিক্ষা ছিল ধর্মভিত্তিক এবং বিভিন্ন সংঘারাম ও বৌদ্ধবিহারগুলি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে কাজ করত। ব্রাহ্মীলিপি ব্যবহৃত হত। উচ্চশিক্ষার ভাষা-মাধ্যম ছিল সংস্কৃত। বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র পুস্তকাকারে (পুঁথি) পাঠকের কাছে থাকত। সাধারণভাবে নয় বছরে শিক্ষালাভ শুরু করা হত। তিরিশ বছর বয়স পর্যন্ত বিদ্যাভ্যাস চলত। তবে বিদ্যোৎসাহীরা সারাজীবন বিদ্যাচর্চা করতেন। বিদ্যালাভের পর সাধারণভাবে মানুষ কর্মজীবনে প্রবেশ করত। পাণ্ডিত্য যাচাইয়ের জন্য হর্ষ তর্কযুদ্ধের আহ্বান করতেন এবং তিনি স্বয়ং তর্কযুদ্ধে অংশ নিতেন। তর্কযুদ্ধে বিজয়ীকে তিনি অভিনন্দিত ও পুরস্কৃত করতেন।
হর্ষবর্ধনের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় :
হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ থেকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতার বিবরণ জানা যায়। বর্তমান বিহার রাজ্যের রাজগিরের সন্নিকটে এই বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রটি গড়ে উঠেছিল। গুপ্তবংশীয় রাজাদের উদ্যোগে এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ছয়টি বৌদ্ধ বিহারের সমন্বয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয়। ছয় জন রাজার দানে এই ছয়টি বৌদ্ধবিহার গড়ে উঠেছিল। এঁদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন গুপ্তবংশীয় রাজা—শক্রাদিত্য, বুধগুপ্ত, তথাগতগুপ্ত, বালাদিত্য ও বজ্র। ষষ্ঠ জন ছিলেন হর্ষ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল আটটি মহাবিদ্যালয় এবং তিনটি গ্রন্থাগার-রত্নসাগর, রত্নদধি ও রত্নরঞ্জক। শতাধিক শিক্ষকের সান্নিধ্যে থেকে দশ সহস্রাধিক ছাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণ করতেন। প্রাথমিকভাবে নালন্দা ছিল একটি মহাযান বৌদ্ধদর্শনচর্চার বিদ্যাপীঠ। কালক্রমে চতুর্বেদ, হেতুবিদ্যা বা তর্কশাস্ত্র, শব্দবিদ্যা বা ব্যাকরণ, চিকিৎসাবিদ্যা, সাংখ্য, যোগ, ন্যায় ইত্যাদি বিভিন্ন শাস্ত্রে পাঠদান শুরু করা হয়।
বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী দেশবিদেশের ছাত্ররা নালন্দায় পাঠগ্রহণের জন্য আকুল হতেন। নালন্দায় পাঠগ্রহণ করে বহু ভিক্ষুপণ্ডিত তিব্বত, চীন প্রভৃতি দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য যাত্রা করেছিলেন। এঁদের অন্যতম ছিলেন শান্তরক্ষিত, পদ্মসম্ভব, স্থিরমতি, বুদ্ধকীর্তি, কুমারজীব, ধর্মদের, পরমার্থ প্রমুখ। বহু বিখ্যাত পণ্ডিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। এঁদের মধ্যে বিশেষ খ্যাত ছিলেন নাগার্জুন, শীলভদ্র, জিনমিত্র, বসুবন্ধু, দিমাগ, ধর্মপাল, চন্দ্রপাল, প্রভামিত্র প্রমুখ। শীলভদ্র ছিলেন হিউয়েন সাঙ-এর শিক্ষক ও সমকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ভার বহন করা হত একশত গ্রামের রাজস্ব থেকে। হর্ষবর্ধন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচালনা ও উন্নয়নের জন্য অকাতরে আর্থিক ও নৈতিক সমর্থন জানাতেন।
হর্ষবর্ধনের সাহিত্যচর্চা :
হর্ষবর্ধন স্বয়ং ছিলেন সাহিত্যরসিক। কবি-শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি তিনি নিজেও সাহিত্যচর্চা করতেন। সম্ভবত বাঁশঘেরা ও মধবন তাম্রশাসনের স্তবকগুলি তাঁরই রচনা। কারণ রচনার অন্তে তাঁর স্বাক্ষর ছিল। বাণভট্ট এবং দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেব হর্ষের কাব্যপ্রতিভার প্রশংসা করেছেন। চীনা পর্যটক ই-সিং-এর বিবরণীতেও (সপ্তম শতক) সাহিত্যরসিক হিসেবে হর্যের প্রশংসা স্থান পেয়েছে। জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের উৎসাহদানের কাজে হর্ষ ছিলেন উদার ও আন্তরিক। হুই-লিপ্রণীত ‘লাইফ অব হিউয়েন সাঙ’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, জয়সেন নামক জনৈক বৌদ্ধ পণ্ডিতকে হর্ষ উড়িষ্যার আশিটি গ্রামের রাজস্ব উপহারস্বরূপ দান করেছিলেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য তিনি উদারহস্তে সাহায্য দেন। হর্ষচরিত ও কাদম্বরী প্রণেতা বাণভট্ট তাঁর সভাসদ ছিলেন। এ ছাড়া ময়ুর মাতঙ্গ, দিবাকর প্রমুখ কবি হর্ষের সভা অলংকৃত করতেন।
হর্ষ স্বয়ং নাট্যকার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। প্রিয়দর্শিকা, রত্নাবলী ও নাগানন্দ নামক তিনটি নাটক হর্ষ রচনা করেছেন বলে মনে করা হয়। প্রিয়দর্শিকা’ ও ‘রত্নাবলী’ নাটক দুটিতে শিব, বিষ্ণু ও ইন্দ্রের গুণকীর্তন করা হয়েছে। ‘প্রিয়দর্শিকা’ নাটকের পরিবেশনে তিনি কিছুটা নতুনত্ব আরোপ করেছেন। এখানে নাটকটি মাঝে মাঝে মূল বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে আনুসাঙ্গিক পার্শ্ব ঘটনার ছবি তুলে আনতে প্রয়াসী হয়েছে। ‘নাগানন্দ’ নাটকের বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলী স্বতন্ত্র। নাটকটিতে ছন্দোবদ্ধ রূপ দেওয়া হয়েছে এবং শ্লোকগুলি সুরবদ্ধ রূপে পরিবেশন করা হত। মূলত বৌদ্ধধর্মকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে তিনি এটি রচনা করেছেন। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘জীমূতবাহন’। বৌদ্ধধর্মের মহিমাকীর্তনের পাশাপাশি এই নাটকে হিন্দু-দেবী গৌরীর মহিমা কথিত হয়েছে। তাই এই নাটকের পরিকল্পনাতেও হর্ষবর্ধনের ধর্মসহিঞ্চুতার পরিচয় পাওয়া যায়।
সপ্তদশ শতকের কোনো কোনো লেখক মনে করেন যে, এই নাটকগুলি মহারাজা হর্ষবর্ধনের রচনা নয়। পিসচেল (Pischel), নাগোজী (Nagoji) প্রমুখ মনে করেন, এই নাটকগুলির রচয়িতা জনৈক ধাবক। ‘হর্যদেব’ ছদ্মনামে ধাবক এগুলি রচনা করেছেন। আবার কাওয়েল (E. B. Cowell)-এর মতে, তিনটি নাটক স্বতন্ত্র ব্যক্তির রচনা। তাঁর মতে, ‘রত্নাবলী’র রচনাকার বাণভট্ট, নাগানন্দ লিখেছেন, ধাবক এবং কোনো অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি ‘প্রিয়দর্শিকা’ রচনা করেছেন। বস্তুত ইতিহাসের বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের মতো এ বিষয়েও কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। তবে নাট্যকার হর্যদেব একজন রাজপুরুষ ছিলেন বলেই বলা হয়েছে। সেই রাজপুরুষ হিসেবে হর্ষবর্ধনকে সনাক্ত করা অযৌক্তিক নয়। এই মতটি অধিকাংশ পণ্ডিত সমর্থন করেন।